শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪৬ অপরাহ্ন

দেশে জ্বালানি তেলের দাম আরেকদফা বাড়তে পারে

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২১

বাজেট ঘাটতি সহনীয় রাখতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। সেই সাথে সারের দামও বাড়তে পারে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামালের সভাপতিত্বে গত বুধবার বিকেলে সচিবালয়ে জাতীয় কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের সভায় এ সুপারিশ করা হয়। অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে সুপারিশে সার ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি আগামী অর্থবছরের জন্য মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণের কথা বলা হয়।
সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, অর্থ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার, এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমসহ অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরের জন্য জিডিপির যে প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে, তা অর্জিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সে জন্য সংশোধিত বাজেটে তা অপরিবর্তিত রাখা হবে। আগামী এপ্রিলে সংশোধিত বাজেট চূড়ান্ত করা হবে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করা হয় ৭ দশমিক ২ শতাংশ। ফলে সংশোধিত বাজেটে এটি বহাল থাকছে বলে জানা গেছে।
তবে বহুজাতিক ঋণদানকারী সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ সরকারের প্রাক্কলনের চেয়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধি কম হবে বলে বলে মত দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, এ বছর বাংলাদেশের জিডিপি হবে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। আইএমএফ বলেছে, ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি যেভাবে এগোচ্ছে তাতে অর্থবছর শেষে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ অর্জিত হবে বলে অর্থমন্ত্রী মনে করেন। করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনসহ কিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও আমরা তা মোকাবিলা করতে প্রস্তুত আছি।’ উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া সারের দামও বেড়ে গেছে বিশ্ববাজারে। এসব কারণে সরকারের বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর ঘাটতি সহনীয় রাখতেই সার ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। এবার বাজেটে কৃষিতে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে সার ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় এ খাতে অতিরিক্ত দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি লাগতে পারে।
বাজেট ঘোষণার সময় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বর্তমানের চেয়ে অর্ধেক ছিল। ফলে সরকার এ খাতে কোনো বরাদ্দ রাখেনি। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম প্রায় দ্বিগুণ বাড়ায় এ খাতে ভর্তুকি লাগতে পারে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাড়তি ভর্তুকির চাপ কমাতে হলে সার ও জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা ছাড়া আমাদের কাছে বিকল্প কিছু নেই। এটা যত দ্রুত করা যায়, ততই চাপ প্রশমিত হবে।’ বাজেট তৈরিতে জড়িত অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘নতুন বছরের শুরুতে আরেক দফা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হতে পারে।’
বাংলাদেশে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বৃদ্ধির পর সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
তেলের মূল্য বৃদ্ধির পর গণপরিবহনে ভাড়া বেড়ে গেছে। পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণে বাজারে নিত্য পণ্যের দামও বেড়েছে। কৃষি, শিল্প উৎপাদনসহ এই তেলের মূল্য বৃদ্ধি অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলবে বলেও আশঙ্কা করছেন ভোক্তা এবং অর্থনীতিবিদেরা। করোনা মহামারির ধকল কাটিয়ে অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে এমন সময় এই সময়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না ভোক্তারা। অর্থনীতিবিদরাও মনে করেন বর্তমান পরিস্থিতিতে তেলের মূল্য বৃদ্ধি অযৌক্তিক।
গণপরিবহনে খরচ বৃদ্ধি: তেলের মূল্য বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে। যোগাযোগ খাতে ডিজেলের চাহিদা ৬৪ শতাংশের মতো। সরকারি ঘোষণায় ২৩ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে গণপরিবহনে ২৭ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু পরিবহনে ভাড়া বেশি আদায় হচ্ছে বলেই অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দাবি তেলের দামের কারণে ভাড়ার বৃদ্ধির ফলে বছরে ৭৩ হাজার কোটি টাকা জনগণের পকেট থেকে বেরিয়ে যাবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের পরিবহন ভাড়া হিসেব করে সংগঠনটি বলছে, দৈনিক ২৫-৩০ লক্ষ টাকা অতিরিক্ত আদায় হচ্ছে এই পথে। এক কিলোমিটার দূরত্বের জন্যে গাড়িতে চড়লেই এখন ৫ টাকার পরিবর্তে দশ টাকা দিতে হচ্ছে। লঞ্জ স্টিমার ভাড়াও বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। সাধারণ মানুষের যাতায়াত খরচের বাজেটে এ এক বড় ধাক্কা। রাজধানীতে একজন যাত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছিলেন, “আমাদের পকেট থেকে টাকাটা বেরিয়ে যাচ্ছে না। যে টাকাটা আপনি হয়তো জমা করতাম, সে টাকাটা জমা করতে পারছি না। এখনতো জমা করার কোনো সুযোগই নেই।” তেলের দাম বৃদ্ধির বড় প্রভাব পড়বে কৃষি খাতে। কৃষি খাতে ডিজেলের চাহিদা মোট ডিজেল আমদানির ১৮ শতাংশ। নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে মার্চ-এপ্রিল এই সময়টাতেই ডিজেলের চাহিদা চাহিদা থাকে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে ধান উৎপাদনের সবচেয়ে বড় আবাদ হয় এই বোরো মৌসুমে।
কৃষকরা বলছেন, তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বোরো চাষে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। মুন্সীগঞ্জের একজন কৃষক কামাল তালুকদার বলছিলেন, সামনে বোরো মৌসুমে চাষের খরচ বৃদ্ধি নিয়ে কৃষকরা এখন হতাশ। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে ডিজেলের দাম বাড়ানো কোনোভাবেই উচিত হয়নি। ” হঠাৎ করে পনরো টাকা লিটারে বাইড়া গেলগা! এই টাকাটা কোথা থাইকা দিব? আমাগো খুব ক্ষতি হইছে। কৃষি আর কৃষক বাঁচলে বাংলাদেশ কিন্তু সরকার কৃষকদের দিকটা দেখলো না।” হাবিব নামে আরেকজন কৃষক বলেন, কৃষি যন্ত্রের সবই চলে ডিজেলে। তেলের অতিরিক্ত দাম খরচ বাড়াবে জমি চাষ, সেচ থেকে ধান কাটা পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই। “একবারে ১৫ টাকা বাড়াইছে, আপনার সবার বিবেকে নাড়া দিয়ে দিছে। এই সরকার চাচ্ছে কী? এই সরকার কি জনগণের সরকার না? এই সরকার কি কৃষকের সরকার না?”
জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি: নিত্য পণ্যের বাজারেও তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে। পণ্য পরিবহনের বাড়তি খরচ যোগ হয়েছে নিত্য পণ্যের দামের সাথে। নিয়মিত বাজার করা দেলোয়ারা খাতুন বলছিলেন, সবদিকে খরচ বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের কষ্ট আরো বাড়লো। “তরি-তরকারি, চাইল ডাইল সবকিছুর উপরে দাম বাড়ায় দিছে এই তেলের দাম বাড়ানোর জন্য। এমনিই করোনার মানুষ সমস্যায় আছে। সাধারণ মানুষ মধ্যবিত্ত মানুষের বেহাল অবস্থা।” তেলের দাম বৃদ্ধির এই প্রভাবে সবচেয়ে সংকটে পড়বে সাধারণ খেটে খাওয়া গরিব মানুষ। নায্যমূল্যের পণ্যের জন্য ক্রেতাদের লাইনও তাই দীর্ঘ হচ্ছে।
শিল্প-কারখানার ওপর প্রভাব: এদিকে ২৩ শতাংশ তেলের দাম বৃদ্ধির বড় প্রভাব পড়বে শিল্প কারখানার উৎপাদন খরচে। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা বলছেন, তেলের বাড়তি দামের কারণে ১ শতাংশ উৎপাদন খরচ বাড়বে। ফলে রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হবে তাদের। বাংলাদেশে মোট তেল আমদানির ৭৩ শতাংশই ডিজেল। জ্বালানি বিভাগের তথ্যে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি দামে আমদানি করে কমদামে বিক্রি করায় গত ৫ মাসে ১১শ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।
দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা: সরকারের দাবি, আন্তর্জাতিক দরের সঙ্গে সমন্বয় করে দাম না বাড়ালে দৈনিক ২০ কোটি টাকা লোকসান হবে। জ্বালানি বিভাগের সচিব আনিসুর রহমান বলেন, “অক্টোবরে প্রতিদিন ২০ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছিলো। এবং তাতে মাসে ৬শ কোটি বা তারও অধিক। “এই মুহূর্তে বিপিসির হাতে আর অন্য কোনো অস্ত্র ছিল না দাম বাড়ানো ছাড়া। কারণ আমরা ভর্তুকী পাওয়া যাবে না – এরকম একটা ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল।” তিনি জানান, “জানুয়ারি মাসের যে শিডিউল আছে, তখনকার জন্য যদি আমরা তেল আমদানি করতে চাই তাহলে এই বৃদ্ধি যদি না হতো তাহলে কিন্তু এলসি ওপেন করা কঠিন হয়ে যেতো।” অন্যদিকে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডির হিসেবে, গত ৭ বছর ধরে তেল বিক্রি করে ৪৩ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা মুনাফা হয়েছে, কিন্তু সেই তুলনায় তেলের দাম কমানো হয়নি। এছাড়া প্রতি লিটার ডিজেল আমদানিতে সরকার ভ্যাট ট্যাক্স বাবদ ১৯ টাকা আদায় করে। শুল্ক হ্রাস করেও লোকসান কমানো যেত। আয় ব্যয় আর অর্থনৈতিক বাস্তবতার সাথে তেলের মূল্য বৃদ্ধির বিরূপ প্রভাব বিবেচনা করে এই মুহূর্তে ডিজেল কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বৃদ্ধির কোনো যুক্তি দেখেন না ভোক্তা এবং অর্থনীতিবিদরা।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com