এলাকার ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং জনঘনত্ব বিবেচনা করে ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়েছে রাজউকের নতুন ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) এ। এমনটাই জানিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ- রাজউক। সংস্থাটি বলছে, বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকা শহরের অতি নি¤œ অবস্থানের অন্যতম প্রধান কারণ অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও অধিক জনঘনত্ব। তাই ঢাকার বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে নাগরিক সুবিধাদি ও পরিষেবার বিপরীতে জনসংখ্যা নির্ধারণ করেই ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক নগর পরিকল্পনা অনেকদূর এগিয়ে গেলেও দেশের নগর এলাকায় সঠিক পরিকল্পনার ধারণা এখনও সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। বাসযোগ্য নগর গড়তে জনঘনত্ব পরিকল্পনার বিষয়টি উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য নগর এলাকার পরিকল্পনায় এই মৌলিক বিষয়টি অনুপস্থিত। সে কারণে শহর এলাকাগুলো বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকা শহর অতি নি¤œ মানে অবস্থানের অন্যতম কারণও এই অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও অধিক জনঘনত্ব। পরিকল্পনাবিদরা আরও বলছেন, উন্নয়ন পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় জনসংখ্যা, জনঘনত্ব এবং শহরের বিদ্যমান অবকাঠামো ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সাপেক্ষে শহরের ভারবহন ক্ষমতা বিবেচনা না করা হলে যে কোন শহর তার বাসযোগ্যতা হারাবে। ঢাকা যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাই গ্রহণ করা পরিকল্পনা অতিদ্রুত বাস্তবায়ন করে ঢাকাকে বাঁচানোর তাগিদ তাদের। ড্যাপের জরিপে বলা হয়েছে, একটি বড় শহরের জনঘনত্বের জন্য মানদ- ধরা হয় প্রতি একরে ৭০ থেকে ৮০জন। যা কেন্দ্রীয় শহর এলাকায় সর্বোচ্চ ১২০ পর্যন্ত হতে পারে। জাপানের টোকিও শহরের কেন্দ্রীয় এলাকার ওয়ার্ড সমূহের জনঘনত্ব একরপ্রতি ৯০ জনের নিচে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে প্রতি একরে সর্বোচ্চ জনঘনত্ব ৫৮ জন।
ড্যাপে আরও বলা হয়েছে, সব পরিকল্পিত শহরের জনঘনত্ব প্রতি একরে ৮০ জনের নিচে। নিউইয়র্ক শহরের ম্যানহাটনের জনঘনত্ব যেখানে ১১২ এবং অন্যান্য এলাকার ঘনত্ব প্রতি একরে ৬০ এর নিচে। আর এসবের বিপরীতে ঢাকার লালবাগ, বংশাল, সবুজবাগ, গেন্ডারিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার জনঘনত্ব প্রতি একরে ৭০০ থেকে ৮০০ জন বা তার ঊর্ধ্বে। যা পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ। কিন্তু সেখানে অবকাঠামো ও নাগরিক সুবিধা পরিকল্পনার সকল মানদ- ও সূচকে খুবই অপ্রতুল।
এ অবস্থায় নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, যথাযথভাবে জনঘনত্বের বিষয়টি প্রয়োগ না করায় ঢাকা শহরের সরকারি ও বেসরকারি আবাসিক এলাকাগুলোও ক্রমান্বয়ে বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। বসুন্ধরা ও আফতাবনগরসহ অন্যান্য বেসরকারি আবাসন প্রকল্পে জনঘনত্ব প্রতি একরে ৩৫০ জন ধরে অনুমোদন প্রদান করা হলেও সর্বোচ্চ পার এরিয়া রেশিও (পার) সুবিধা নিয়ে এ সকল এলাকার জনঘনত্ব এখন ৭০০ থেকে ৮০০ পরিণত হচ্ছে। রাজউকের উত্তরা মডেল টাউন প্রকল্পে শুরুতে প্রতি একরে জনঘনত্ব ৯৫ জন করে ধরা হয়েছিল। সে অনুযায়ী নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার কাজ করা হয়। কিন্তু বর্তমানে উত্তরা এলাকার জনঘনত্ব অনেক বেশি। পূর্বাচল প্রকল্পটির প্রতি একরে ২৪৫ জন ধরে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার কাজ শুরু করা হয়। এ অবস্থায় বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জনঘনত্ব বিবেচনায় নিয়ে ভবনের অনুমোদন দিতে হবো। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ বলছে, বর্তমানে শুধু ভবনের সামনের রাস্তার উপর ভিত্তি করে ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করে অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু নগর পরিকল্পনার দৃষ্টকোণ থকে একটি প্লটের উপর নির্মিত ভবনের আকার আয়তন কেমন হওয়া উচিত তা শুধুমাত্র প্লটসংলগ্ন রাস্তার প্রশস্থতার উপর নির্ভর করে না। বরং সেই নগর এলাকার পরিকল্পনা সম্পর্কিত অবকাঠামো ও নাগরিক সুযোগ সুবিধার বিষয়গুলোও বিবেচনায় রাখতে হয়। এরমধ্যে সড়ক অবকাঠামো, সামাজিক সুবিধা, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, বাজার, উন্মুক্ত স্থান ও খেলার মাঠ, পার্ক, উদ্যান, জলাশয় ও জলাধার অন্যতম। এসব নিশ্চিত হলে ওই এলাকার ভারবহন ক্ষমতা নির্ণয় করে সর্বোচ্চ জনসংখ্যা নির্ধারণ করবার মাধ্যমে সেই এলাকার জনঘনত্ব নির্ধারণ করে প্রতি প্লটে কি পরিমাণ পরিবার বা মানুষকে ধারণ করা যেতে পারে সে ব্যাপারে পরিকল্পনার কৌশল ও পন্থা নির্ধারণ করা হয়। আর প্রস্তাবিত ড্যাপে এসবই সুপারিশ করা হয়েছে।
সার্বিক বিবেচনায় ঢাকাকে বসবাস অযোগ্যতার হাত থেকে বাঁচাতে হলে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই বলে মনে করছে ড্যাপ। এছাড়াও ঢাকার খোলা জায়গা, জলাভূমি কমে যাবার ফলে এবং পরিকল্পনামাফিক অবকাঠামো ও নাগরিক সুবিধাদি তৈরি না করবার ফলে জনসংখ্যা ধারণ ক্ষমতা কমে গিছে। তাই এলাকাভিত্তিক জনঘনত্বকে গুরুত্ব দিয়ে নির্ধারিত জনসংখ্যা ঠিক করতে হবে। তা না হলে সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হবে বলে মনে করছে রাজউক। সংস্থাটি আরও বলছে, ইতিপূর্বে ঢাকাসহ দেশের পরিকল্পনা এবং আইন ও বিধিমালাগুলোতে জনঘনত্বের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যার ফলে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা অত্যধিক বেড়ে গেছে। একইসাথে পরিবহন ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা ভেংগে পড়েছে । ড্যাপ পরিচালক ও রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বর্তমানে ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০১৬-৩৫) প্রণয়নে জনঘনত্ব পরিকল্পনার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যা বাসযোগ্য ঢাকা গড়বার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। এই মহাপরিকল্পনায় ব্লক-বেসড উন্নয়ন, মেট্রো স্টেশনের আশে পাশে ট্রানজিট ভিত্তিক উন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে জনঘনত্বের ইনসেনটিভ দেওয়ার প্র-বিধান রয়েছে। এছাড়া সময়ের বিবর্তনে একটি এলাকার নাগরিক সুবিধাদি ও সড়ক নেটওয়ার্কের উন্নতি ঘটলে অধিক জনঘনত্ব প্রদানের বিধান রাখা হয়েছে। নি¤œ আয়ের মানুষের জন্য গড়ে ৬৫০ বর্গ ফুট আয়তনের ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পের প্রস্তাবনা এই মহাপরিকল্পনায় রয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, নানা বাধার কারণে ২০১০ সালের প্রথম ড্যাপ বাস্তবায়ন করা যায়নি। বর্তমান ড্যাপের গ্যাজেট দ্রুত প্রণয়ন করা দরকার। তা না হলে প্রভাবশালীরা বাধা দিতে থাকবে। এরই মধ্যে তার নমুনাও দেখা যাচ্ছে। আবাসন ব্যবসায়ীরা ড্যাপের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে। তাদের অভিযোগ আবেগ নির্ভর, যুক্তি নির্ভর নয়। এটা দুঃখজনক। -বাংলাট্রিবিউন