আজ পহেলা জানুয়ারি ২০২২ শনিবার, ঈসায়ী বা খ্রিস্টীয় নববর্ষ । বছর ঘুরে আবারো এসেছে ইংরেজি নববর্ষ। মহামারি করোনার মধ্যে গতকাল শুক্রবার পশ্চিমাকাশে সূর্যাস্তের মাধ্যমে কালের অতলে হারিয়ে গেছে ২০২১ সাল। আবার এই করোনার মধ্যেই নতুন একটি বছরে পা রাখলো মানুষ। হিমেল বাতাসে, কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে সূর্য উদয়ের মধ্য দিয়ে এলো আরও একটি বছর। ঘরবন্দী আর নানা ঘটনাবহুল ২০২১-এর অনেক ঘটনার রেশ নিয়েই মানুষ এগিয়ে যাবে। অনেক ঘটনা তলিয়ে যাবে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে।
শুভনবর্ষ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নববর্ষ ২০২২ উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণী দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এবং জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান । বাণীতে তারা ইংরেজি নতুন বছর উপলক্ষে দেশবাসী, প্রবাসী বাঙালিসহ বিশ্ববাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। নতুন বছরের জন্য নতুন পরিকল্পনা সবারই। করোনায় গত বছর অনেকেই হারিয়েছে অনেক কিছু। অনেকে হারিয়েছেন স্বজন-প্রিয়জন। অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অনেকে। আবার কারো কারো প্রাপ্তিযোগও হয়েছে কোনো না কোনোভাবে। নববর্ষ সকলের মাঝে জাগায় প্রাণের নতুন স্পন্দন, নতুন আশা, নতুন সম্ভাবনা। বিগত বছরের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা পেছনে ফেলে নতুন বছরের অমিত সম্ভাবনার পথে এগিয়ে যাওয়া। স্বভাবতই নতুন বছর নিয়ে এবার মানুষের প্রত্যাশা একটি করোনা মুক্ত বিশ্ব। তবে, করোনার টিকা ছাড়াও অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনাসহ মানবসম্পদ তৈরির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হচ্ছে আগামী বছরের মোটা দাগের চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে জাতি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে, এটাই নতুন ইংরেজি বছরে সবার প্রত্যাশা। সারা বিশ্বে ২০২১ সাল, বিষাদের বছর হিসেবে ইতিহাসে থেকে যাবে। অনেকেই মনে করেন, জীবন ও জীবিকার ওপর আঘাতের যে চিত্র বছরজুড়ে মানুষ দেখেছে, গত ১০০ বছরেও তা দেখা যায়নি। কোভিড-১৯-এর আগের বিশ্ব আর পরের বিশ্বের মধ্যে মিল কোন দিনই হবে না।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর এই প্রথম আন্তর্জাতিক কোন নিষেধজ্ঞার কবলে পড়লো। গুরুতর মানবাধিকার লংঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশের বিশেষ পুলিশ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর ছয়জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন অর্থ দফতরের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরের ১০ তারিখে খবর প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, শুক্রবার (গত ১০ ডিসেম্বর) আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসের এই দিনে মার্কিন অর্থ দফতরের ফরেন অ্যাসেটস কনট্রোল অফিস (ওএফএসি) বিভিন্ন দেশের মোট ১০টি প্রতিষ্ঠান ও ১৫ জন ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে- যারা মানবাধিকার লংঘন এবং নিপীড়নের সাথে সংশ্লিষ্ট। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত ছয়জন কর্মকর্তা হচ্ছেন: চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন (র্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক), বেনজীর আহমেদ (সাবেক র্যাব মহাপরিচালক, জানুয়ারি ২০১৫-এপ্রিল ২০২০), খান মোহাম্মদ আজাদ (বর্তমান অতিরিক্ত মহাপরিচালক-অপারেশন্স), তোফায়েল মুস্তাফা সরওয়ার (সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক-অপারেশন্স, জুন ২০১৯-মার্চ ২০২১), মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক-অপারেশন্স, সেপ্টেম্বর ২০১৮-জুন ২০১৯), এবং মোহাম্মদ আনোয়ার লতিফ খান (সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক-অপারেশন্স, এপ্রিল-২০১৬-সেপ্টেম্বর ২০১৮)। এতে বলা হয়, গুরুতর মানবাধিকার লংঘনে জড়িত থাকার জন্য বেনজীর আহমেদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করার কথা ঘোষণা করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর- যার ফলে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অযোগ্য হবেন। বিজ্ঞপ্তিটিতে বলা হয়, বাংলাদেশের বেসরকারি সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে যে র্যাব এবং অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ২০০৯ সাল থেকে প্রায় ৬০০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, ৬০০-এরও বেশি লোকের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, এবং নির্যাতনের জন্য দায়ী। কিছু রিপোর্টে আভাস পাওয়া যায় যে এসব ঘটনায় বিরোধীদলীয় সদস্য, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের টার্গেট করা হয়েছে – বলা হয় বিজ্ঞপ্তিতে। এতে গুরুতর মানবাধিকার লংঘনমূলক কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশের বিশেষ পুলিশ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর ৬ জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে মাদকবিরোধী অভিযানের সময় র্যাবের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের ব্যাপক অভিযোগ- আইনের শাসন, মানবাধিকার, মৌলিক স্বাধীনতা, ও বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে হেয় করার মাধ্যমে – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থকে হুমকির মুখে ফেলছে।’ সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল আজিজের ভিসা বাতিল করেছে। পদত্যাগী তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা: মুরাদ হাসানকে কানাডার বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠনো হয়েছে।
বিদায়ী বছরে যেসব ঘটনা প্রশাসনকে নাড়া দিয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের ফোনকল ফাঁস ও পদত্যাগের ঘটনা ছিল অন্যতম। এ ছাড়া একজন জনপ্রতিনিধির সঙ্গে বিরোধের জেরে বরিশাল সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জোড়া মামলার ঘটনা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদের সংখ্যা নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যের জের ধরে গাজিপুর সিটি করপোরেশনের মেয়রের পদ থেকে মো. জাহাঙ্গীর আলমকে বরখাস্ত, জাতির পিতাকে নিয়ে কটূক্তি এবং দুর্নীতির অভিযোগে রাজশাহীর কাটাখালী পৌরসভার মেয়র মো. আব্বাস আলীর বরখাস্তের ঘটনা, এবং শিক্ষা কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মো. শাহনেওয়াজ শাহানশাহের বরখাস্ত হওয়ার ঘটনা উল্লেখযোগ্য।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জামালপুর-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ডা. মুরাদ হাসান। ২০১৮ সালের মন্ত্রী সভায় তিনি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পান। মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় তাঁকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে ২০১৯ সালের ১৯ তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর কখনও গান গেয়ে, কখনও ওয়াজ নসিহত করে, আবার কখনও বিতর্কিত ও আপত্তিকর বক্তব্য-মন্তব্য করে আলোচনায় আসেন ডা. মুরাদ।
গত অক্টোবরে শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষ্যে দেওয়া এক বক্তব্যে মুরাদ হাসান বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। তাঁর সে বক্তব্যে সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাদ এবং ১৫তম সংশোধনী বাতিল করে ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনর্বহাল রাখার দাবি পেশ করেন। কিন্তু, বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা উল্লেখ থাকায় এবং সব ধর্মের প্রতি সমান মর্যাদা উল্লেখ থাকায় তাঁর প্রস্তাবটি ইন্টারনেট দুনিয়ায় ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হয়। ডা. মুরাদের এ দাবি সরকার ও প্রশাসনকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। সংবিধান সংরক্ষণের শপথ নিয়ে তিনি নিজেই সংবিধান সংশোধনের দাবি জানানোয় তাঁকে নিয়ে প্রশাসনজুড়ে প্রশ্ন দেখা দেয়।
গত ১ ডিসেম্বর রাতে এক ফেসবুক লাইভে মুরাদ হাসান বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং তাঁর কন্যা জাইমা রহমানকে নিয়ে কটূক্তি করেন। তিনি জাইমা রহমানকে অশালীন ও মারাত্মক আপত্তিকর বক্তব্য দেন। এসব অশ্রাব্য বক্তব্যের কারণে তিনি নেট দুনিয়ায় ‘মুরাদ টাকলা’ নামে হাসাহাসির কারণ হন। এ ঘটনায় বিএনপি তাঁর পদত্যাগ দাবি করে। তবে, বিবিসিকে তিনি বলেনÍএসব বক্তব্য দিয়ে তিনি কোনো ভুল করেননি। এগুলো তিনি প্রত্যাহারও করবেন না কিংবা প্রত্যাহার করার ব্যাপারে সরকার ও দলের ওপর থেকে কোনো চাপও নেই। উলটো তিনি বলেন, ‘আমি যা বলি ও করি, তা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েই করি। ডা. মুরাদ কথা বলা বন্ধ করবে না। ডা. মুরাদ কথা বলবে। আমাকে থামাতে হলে হত্যা করতে হবে।’
৬ ডিসেম্বর ২০২১ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুরাদ হাসানের সঙ্গে চিত্রনায়ক মামনুন হাসান ইমন এবং নায়িকা মাহিয়া মাহি একটি ফোনালাপ ভাইরাল হয়। যেখানে তিনি মাহিয়া মাহির সঙ্গে অশ্লীলভাবে কথা বলেন এবং তাঁর কাছে যেতে বলেন। ওই কথোপকথনে তথ্য প্রতিমন্ত্রী মাহিকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি তাঁকে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সহায়তায় তুলে আনার হুমকি দেন। পুরো বক্তব্যে অশ্রাব্য ও অশ্লীল কথা বলেন ডা. মুরাদ। বিষয়টি দেশজুড়ে সমালোচনার জন্ম দেয়। পর পর দুটি ঘটনায় রাজনৈতিক অঙ্গন, নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীসহ বিভিন্ন মহল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেমন সমালোচনার ঝড় ওঠে, তেমনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যেও প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তিনি ৭ ডিসেম্বর ইমেইলের মাধ্যমে তাঁর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। তবে, পদত্যাগের জন্য তিনি ব্যক্তিগত কারণের কথা উল্লেখ করেন। তাঁকে প্রতিমন্ত্রী এবং জামালপুর জেলার আওয়ামী লীগের কমিটির পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। তিনি দেশ ত্যাগ করে কানাডার উদ্দেশে দেশ ছাড়েন। কিন্তু, কানাডায় প্রবেশ না করতে পেরে দুবাই গিয়ে সেখানেও প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়ে ১২ ডিসেম্বর দেশে ফিরে আসেন ডা. মুরাদ। সে থেকে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন।
গত ২৫ নভেম্বর মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। তাঁর এ বহিষ্কারও ছিল দেশজুড়ে আলোচনার অন্যতম বিষয়।
২০১৮ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়রের চেয়ারে বসেন ৩৫ বছর বয়সি জাহাঙ্গীর। মেয়রের পদে বসে প্রথম আলোচনার জন্ম দেন ২০২০ সালে। ওই সময় তিনি চীন থেকে ৫০ হাজার র্যাপিড টেস্ট কিট নিয়ে আসেন, যদিও দেশে তখনও র্যাপিড টেস্টের অনুমোদন ছিল না। আর নিয়ম অনুযায়ী ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কোনো অনুমতিও তিনি নেননি।
সে সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়। এর জবাবে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেছিলেন, ‘মানুষ মরে গেলে আইন দিয়ে কী করব! ৃ কিন্তু, আমার এখানে ৪০ লাখ মানুষ আমাকে ভোট দিয়েছে। যেকোনোভাবে হোক, আগে তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করা আমার দায়িত্ব। মানবিক কারণে আমি আনছি, বাঁইচা থাকলে তখন আইন আদালত।’
গত সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে মেয়র জাহাঙ্গীরের একটি মন্তব্যের অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে নতুন করে তোলপাড় শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ এবং বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেন জাহাঙ্গীর আলম। এ ঘটনার পর দল ও প্রশাসনের ভেতরে তাঁকে নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে মেয়রের পদ হারাতে হয়।
জাতির পিতাকে নিয়ে কটূক্তি ও দুর্নীতির অভিযোগে গত ১০ ডিসেম্বর রাজশাহীর কাটাখালী পৌরসভার মেয়র মো. আব্বাস আলীকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। জাতির পিতার ম্যুরাল স্থাপনের বিরোধিতায় বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এক মামলায় গ্রেপ্তার করে তাঁকে কারাগারে নেওয়া হয়েছে। মো. আব্বাস আলীকে সাময়িক বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নিয়ে আব্বাসের যে ‘বিতর্কিত অডিও’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, সে বিষয়ে ২৫ নভেম্বর তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, তিনি কোনো জবাব দেননি। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ওই অডিও টেপে বলতে শোনা যায়, রাজশাহী সিটি গেইটে বঙ্গবন্ধুর যে ম্যুরাল করার নকশা দেওয়া হয়েছে, সেটা ‘ইসলামি শরিয়ত মতে সঠিক নয়’। এটা করতে দিলে ‘পাপ হবে’।
শিক্ষা কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করে বরখাস্ত হন জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মো. শাহনেওয়াজ শাহানশাহ। গত ২১ ডিসেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে।
গত ১৬ ডিসেম্বর সকালে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে পুষ্পস্তবক অপর্ণের সময় ঘোষণা মঞ্চ থেকে পৌরসভার মেয়র শাহনেওয়াজ শাহানশাহর নাম দেরিতে ঘোষণা করায় তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে অনুষ্ঠানের উপস্থাপক উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। শিক্ষাকর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করার এ ঘটনা গোটা প্রশাসনে তোলপাড় সৃষ্টি করে।
বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনিবুর রহমানের সরকারি বাসভবনে হামলার ঘটনায় সিভিল প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ কয়েকদিন ধরে ছিল মুখোমুখি অবস্থানে। ১৮ আগস্ট মধ্যরাতে বরিশালে পোস্টার-ব্যানার অপসারণকে কেন্দ্র করে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সরকারি বাসভবনে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় পুলিশ-আনসার ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে ওসি ও প্যানেল মেয়রসহ সাত জন গুলিবিদ্ধ এবং ২৫ জন আহত হয়। দফায় দফায় সংঘর্ষের পরই ইউএনওর বাসভবনে বিপুল পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
ঘটনার পর ১৯ আগস্ট প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে হামলাকারী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দুর্বৃত্ত হিসেবে আখ্যায়িত করে জানায়, ‘আইনের মাধ্যমেই দুর্বৃত্তদের মোকাবিলা করা হবে এবং আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ এবং তাঁর দুর্বৃত্ত বাহিনী সিটি করপোরেশনের কর্মচারীদের দিয়ে নানা প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে ও সব জেলায় (বরিশাল) ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে।’ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের এই বক্তব্য নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে নানা আলোচনা হয় ওই সময়। সিভিল প্রশাসন একজন নির্বাচিত মেয়রকে এভাবে বলতে পারে কি না, তা নিয়ে নানা কথা ওঠে দলটির নেতাদের মধ্যে। কেউ কেউ মনে করেন, এ বক্তব্য আওয়ামী লীগের প্রতি প্রচ্ছন্ন হুমকি বা আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে।
ঘটনার পর সরকারের মন্ত্রীরা এ ঘটনা নিয়ে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানান। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, তিনি পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছেন। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না, নিজ দলেরও নেতাকর্মী হলেও ছাড় দেওয়া হবে না। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, বরিশালের ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবস্থা নেওয়া হবে। বেশ কয়েকদিন এ নিয়ে প্রশাসন ও সরকারি দল আওয়ামী লীগের মধ্যে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বিরাজের পর আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হয় ও পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে আসে।
সাংবাদিক রোজিনাকে হেনস্তা: পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য গত ১৭ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গেলে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে সেখানে পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় আটকে রেখে হেনস্তা করা হয়। একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাত সাড়ে আটটার দিকে পুলিশ তাঁকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায়। রাত পৌনে ১২টার দিকে পুলিশ জানায়, রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা হয়েছে। তাঁকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় আটকে রাখা হয় রোজিনাকে। সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে তিনি মেঝেতে পড়ে যান। রাত সাড়ে আটটায় তাঁকে ধরাধরি করে নারী পুলিশ সদস্যরা ওই কক্ষ থেকে বের করে নিচে নামিয়ে আনেন এবং গাড়িতে তুলে নিয়ে যান। এ সময় সাংবাদিকেরা পুলিশের কাছে জানতে চান, রোজিনাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? তখন পুলিশ জানায়, চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর জানা যায়, তাঁকে হাসপাতালে নয়, শাহবাগ থানায় নেওয়া হয়েছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে সাংবাদিকেরা বিকেলে সচিবালয়ে এবং রাতে শাহবাগ থানার সামনে বিক্ষোভ করেন। এর নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয় কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে),অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংগঠন। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা ঘটনার প্রতিবাদ জানায়। পরে আদালত জামিন মঞ্জুর করলে ২৩ মে বিকেলে গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি মেলে রোজিনা ইসলামের।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ১৭টি নথি গায়েব: স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ১৭টি নথি গায়েবের ঘটনা ঝড় তুলে গোটা প্রশাসনে। নথি গায়েবের ঘটনা জানা যায় মন্ত্রণালয়ের করা একটি সাধারণ ডায়েরি থেকে। সতেরোটি ফাইল সরানোর ঘটনায় গত ২৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় শাহবাগ থানায় জিডি করে মন্ত্রণালয়। জিডিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ফাইলগুলো ছিল স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) শাহাদৎ হোসাইনের কক্ষের লাগোয়া কক্ষে। সে কক্ষে বসেন ক্রয় ও সংগ্রহ শাখা-২-এর সাঁট মুদ্রাক্ষরিক ও কম্পিউটার অপারেটর মো. জোসেফ সরদার ও আয়েশা সিদ্দিকা। ফাইলগুলো এ দুই কর্মীর কেবিনেটে ছিল এবং এ কেবিনেটের চাবিও ছিল তাঁদের দুজনের কাছেই। এ ঘটনায় মন্ত্রণালয়ের ছয় কর্মচারিকে হেফাজতে নিয়ে তিন দিন ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিআইডি। তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোয় সরঞ্জামাদি সরবরাহের ঠিকাদার রাজশাহীর নাসিমুল গনি টোটনের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাঁকেও আটক করে সিআইডি। এ ঘটনায় মোট ১০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। বাংলাদেশ সচিবালয় প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র। এখানে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। দেশের অত্যন্ত নিরাপদ ও গুরুত্বপূর্ণ এ স্থান থেকে সরকারি নথি চুরির ঘটনা প্রশাসনকে ভাবিয়ে তোলে।
২০২১ সালের বড় অংশ জুড়েই ছিল করোনাভাইরাসের দাপট। করোনাভাইরসের কারণে দেশের রাজনীতি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সরব হয়ে ওঠতে পারেনি। ঘরোয়া বৈঠক,মানববন্ধন ও অন লাইনে সীমাবব্ধ ছিল রাজনীতি এবং শিক্ষা কার্যক্রম। এরমধ্যে আশার আলো জ্বালিয়ে ছিলো বছরের ১ম মাস জানুয়ারির ১৬ তারিখে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল অব. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের আহবানে ২৫টি রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিশেষ গেট টুগেদার।
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ ইব্রাহিম গত ১৬ জানুয়ারি শনিবার রাজধানীর একটি চাইনিজ রেস্টেুরেন্টে এক প্রীতি সম্মিলনীর আয়োজন করেছিলেন। অনেকেই ভেবেছিলেন ২০ দলীয় জোট কি ফের চাঙ্গা হচ্ছে। চাঙ্গা হয়ে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তারা কি রাস্তায় নামছে। কিন্তু ২০ দলীয় জোটের অন্যতম প্রধান শক্তি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আমন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও ব্যস্ততার অজুহাতে গেট টুগেদারে উপস্থিত হননি। এর বিপরীতে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের উপস্থিতি অনেকেরই দৃৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। মেজর জেনারেল (অব.) ইব্রাহিম যে গেট টুগেদারের আয়োজন করেছিলেন,সেখানে উপস্থিত ছিলেন ২৫টি রাজনৈতিক দলের নেতা, সাবেক সচিবসহ ২০ আমলা, ৫০ সামরিক বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা, শিক্ষক এবং আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার দুই শতাধিক প্রতিনিধি। এই গেট টুগেদারে যারা বক্তব্য রাখেন, তাদের মধ্যে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ছাড়াও বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক মন্ত্রী মেজর হাফিজ, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, গণস্বাস্থ্যের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল, সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) ফখরুল আজম প্রমুখ। যারা উপস্থিত ছিলেন, তাদের মধ্যে আছেন সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলন, সাবেক মন্ত্রী আলমগীর কবির, নৌবাহিনীর সাবেক ভাইস অ্যাডমিরাল সারোয়ার জাহান নিজাম, মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর, মেজর জেনারেল (অব.) এহতেসামুল, সাবেক রিয়াল অ্যাডমিরাল (অব.) মুস্তাফিজুর রহমান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাসান নাসিম, খেলাফত মজলিসের ড. আহমেদ আবদুল কাদেরসহ আরো অনেকে। বছরের প্রথমে জ্বলে ওঠা এই আলোর প্রভাব বছরের শেষ পর্যন্ত আর কোন প্রভা ফেলেছে এমনটা দেখা যায়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে গত ২৬ মার্চ ঢাকায়এসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সকাল সাড়ে দশটার পর তাকে বহনকারী বিমানটি ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। উনিশবার তোপধ্বনির মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানানোর পর বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে বিমানবন্দরেই তাকে গার্ড অব অনার এবং লাল গালিচা সম্বর্ধনা দেয় সশস্ত্র বাহিনীর একটি দল। এ সময় দু দেশের জাতীয় সংগীত বাজানো হয় এবং তিনি গার্ড পরিদর্শন করেন। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে নরেন্দ্র মোদীকে বহনকারী মোটরবহর তেজগাঁও হেলিপ্যাডে যায় এবং সেখান থেকে হেলিকপ্টার যোগে সাভার স্মৃতিসৌধে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। সেখানে তিনি পুষ্পস্তবক অর্পণ, ভিজিটর বইয়ে স্বাক্ষর ও গাছের চারা রোপণ করেন।
ভারতে মুসলিম নির্যাতন বিশেষ করে বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির নির্মাণ ও গুজরাটে দাঙ্গায় ভূমিকার কারণে নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ আগমনের খবরে গর্জে ওঠেছিল বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনতা এবং আলেম সমাজ। ২০২১ সালের মার্চের শেষ দিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আগমনকে কেন্দ্র করে সারা বাংলাদেশ জুড়ে আন্দোলন বিক্ষোভ শুরু হয়। এই আন্দোলন দমনের নামে পুলিশ সরকারের নির্দেশে ব্যাপক জুলুম নির্যাতন চালায়। এতে কমপক্ষে ১৭ জন নিহত; এবং ৫০০ জনের বেশি প্রতিবাদী মানুষ আহত হন। এই ঘটনা ২১ এর মোদী-বিরোধী বিক্ষোভ হিসেবে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। গুজরাট সহিংসতা, বাবরি মসজিদ ইস্যুর পাশাপাশি ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর নির্যাতন এবং উগ্র স্রম্প্রাদায়িক হিন্দুবাদী দৃৃষ্টিভঙ্গির জন্য মোদীকে অভিযুক্ত করে তাঁর বাংলাদেশ সফরের বিরোধীতা করে আসছিল হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও মানবাধিকার সংগঠন। গত ২০২১ সালের ২৬ মার্চ,শুক্রবার বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকায় পৌছান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার ঢাকায় আগমন উপলক্ষে সেদিন জুমার নামাজের পর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ শুরু হয়, যা সারা দেশে ছড়িয়ে পরে। এই বিক্ষোভে সরকার সমর্থকরা ও পুলিশ সহিংসতা শুরু করে। ২৮ শে মার্চ হেফাজতের একটি সংবাদ সম্মেলনে জানায়, ধর্মঘট চলাকালীন সময়ে বিক্ষোভের এক পর্যায়ে সারা দেশে ১৭ জন মৃত্যুবরণ করেন এবং প্রায় ৫০০ জন এর অধিক লোক আহত হন। তাদের দাবি অনুযায়ী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১২ জন, চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ৪ জন এবং নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় একজন মৃত্যুবরণ করেন। অপরদিকে ২৮শে মার্চ, ২০২১ ইং তারিখে স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ১৪ জন মৃত্যুবরণ করেন বলে খবর প্রকাশিত হয়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, এই বিক্ষোভের উত্তরে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকান্ডকে “রক্তাক্ত অভিযান” বলে অভিহিত করে এবং বলে যে, “বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই সমাবেশের স্বাধীনতাকে সম্মান করতে হবে এবং শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের সুরক্ষা দিতে হবে”।
বাংলাদেশের ২০ জন বিশিষ্ট নাগরিক যৌথ বিবৃতিতে মোদী বিরোধী বিক্ষোভকারীদের উপর হামলা এবং চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে সহিংসতা চালানোর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করেন। এইসব বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে আছেন:এম হাফিজ উদ্দিন খান, আলী ইমাম মজুমদার, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, বদিউল আলম মজুমদার, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সারা হোসেন, সিআর আবরার, ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, আসিফ নজরুল, শহীদুল আলম, হাসনাত কাইয়ুম, নূর খান লিটন, শিরীন হক, জাকির হোসেন, পারভিন হাসান, লুবনা মারিয়াম, শারমিন মুর্শিদ, ফেরদৌস হাসান, আজিম জামান ও রাহনুমা আহমেদ। ২৬ থেকে ২৮ মার্চ বাংলাদেশে সফরকালে প্রতিবাদ চলাকালীন সারা দেশে কমপক্ষে ১৪ জনের মৃত্যুর বিষয়ে তাৎক্ষণিক, নিরপেক্ষ ও স্বতন্ত্র তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে ১১টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বাংলাদেশ জাাময়াতে ইসলামী, ছাত্র দল ও ছাত্র শিবির মানুষ হত্যার প্রতিবাদ করে।
নিয়ন্ত্রিত,হাইব্রিড সরল বাংলায় গণতন্ত্রহীন দেশ। তারপরও গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার উদ্ধারে হরতাল ধর্মঘট নেই। রাজনীতি সীমাবব্ধ ঘরোয়া বৈঠক, মানববন্ধন এবং প্রেসক্লাব, রিপোর্টারর্স ইউনিটি কেন্দ্রিক কিছু কর্মসূচিতে। দুঃখজনক হলেও সত্য দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামপন্থী দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ঘরের দরজাও বন্ধ (কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ অধিকাংশ অফিস)। কিন্তু তারপরও থেমে নেই মামলা, হামলা, অত্যাচার নির্যাতন, খুন-গুমসহ নানান কিশিমের রাজনৈতিক নিপীড়ন। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা বিএনপি চেয়ারপার্সন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তার চিকিৎসকরা বিদেশে চিকিৎসার কথা বললেও সরকার অনুমতি দিচ্ছে না। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কয়েক দফা ঘরে আসার পর আবার ফাইল গিয়ে আটকে আছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর টেবিলে।
গোপন বৈঠকের ভিত্তিহীন অভিযোগে রাজধানীর একটি বাসা থেকে ২০২১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পুলিশ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, নায়েবে আমির শামসুল ইসলাম, শাহজাহান চৌধুরী, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, হামিদুর রহমান আজাদ (সাবেক এমপি) সহ কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারাসহ ২০ দলীয় জোটের কয়েক হাজার নেতা-কর্মী মিথ্যা মামলায় জেল, হাজতে বন্দি আছেন।
ভারতের নরেন্দ্র মোদী বিরোধী আন্দোলনের জের ধরে এই ঘটনাকে ইস্যু করে সরকার ইসলামের পক্ষের কণ্ঠরোধ করতে আলেমসমাজ ও ইসলামপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন-পীড়ন চালানো হয়। নিদর্লীয় ও সরাসরি কোন রাজনীতির সাথে জড়িত নন এমন আলেমেদেরকেও গ্রেপ্তার ও তাদের চরিত্র হনন করা হয়। যেমন: মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানী, মাওলানা মামুনুল হক, মুফতি আমীর হামজা, মুফতি ইব্রাহিমসহ খ্যাতনামা অনেক আলেমকে গ্রেপ্তার করে। যাদের অনেকে এখনো জেলহাজতে আছেন।
২০২১ সালে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং জোর করে ভোট নেয়ার পরও আওয়ামী লীগের ব্যানার ও নৌকা মার্কায় প্রতীকের বিজয় সংখ্যা কমছে। আওয়ামী লীগের ভোট ও দলটির পক্ষে জনসমর্থন কমেছে। ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচনের প্রতিটি ধাপেই কমছে আওয়ামী লীগের ভোট। প্রথম ধাপে ৭৬ শতাংশ আসনে জয় পেলেও তৃতীয় ধাপে তা দাঁড়িয়েছে ৫৪ শতাংশে। যা দ্বিতীয় ধাপে ছিল ৫৯ শতাংশ।
এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত গত ২৬ ডিসেম্বর চতুর্থ ধাপের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এই ভোটের ফলে আরও পিছিয়েছে নৌকা। চতুর্থ ধাপের ভোটে ২৭টি ইউপিতে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী ছিল না। সে হিসাবে এই ধাপে আওয়ামী লীগ জয় পেয়েছে ৫১ দশমিক ৪৯ শতাংশ ইউপিতে। জয়ের এই হার এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত চার ধাপের মধ্যে সর্বনিন্ম। এর আগে ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের জয়ের হার এবারের তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপের চেয়ে ভালো ছিল। ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল। অবশ্য সে নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ছিল। ২০১৬ সালে ছয় ধাপে মোট ৪ হাজার ১০৪টি ইউপিতে ভোট হয়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ২ হাজার ৬৫২টি, অর্থাৎ প্রায় ৬৫ শতাংশ ইউপিতে জয় পেয়েছিল। নতুন বছরে আমাদের প্রত্যাশা বন্ধ হোক হত্যা, ষড়যন্ত্র ও হিংসার প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ হোক মুক্তি পাক অবরুদ্ধ গণতন্ত্র।