নীলফামারী শহরের গাছবাড়ি এলাকার বৃদ্ধ রিকশাচালক মকবুল হোসেন বলেন, ‘এবার ঠান্ডা দেরিতে নামিছে। কয়েক দিন থাকি বেশি ঠান্ডা লাগেছে। বিকালের পর থেকে খুব ঠান্ডা নামে। এত ঠান্ডাত রাস্তাত মানসি (মানুষ) না থাকায় কামাই কমি গেইছে।’ ‘হামার (আমার) গ্রামত (গ্রামে) অনেক শীত বাহে। সূর্য পড়িলেই (অস্ত গেলেই) শীত আরও বেশি লাগেছে (লাগে)। কম্বলত শীত মানিবার চায় না।’ বলছিলেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বালিয়া গ্রামের ৭৫ বছর বয়সী আমজাদ হক।
আমজাদের মতোই শীতে জর্জরিত উত্তরের এই জেলা। ঘন কুয়াশায় তেমন দেখা মিলছে না সূর্যের। ডিসেম্বরের শুরু থেকে শীত পড়তে শুরু করলেও তীব্রতা বেড়ে যায় মাসের শেষ দিক থেকে।
ঠাকুরগাঁওয়ে এ বছর সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ৭ দশমিক ৪ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়েছে গত সোমবার। আবহাওয়া অফিস বলছে, আগামী কয়েক দিনে তাপমাত্রা আরও কমে ৭-এ নেমে আসবে। গত কয়েক দিন ধরে দিনের বেশির ভাগ সময় থাকছে কুয়াশাচ্ছন্ন। যখন সূর্যের দেখা মিলছে তখন বয়ে যাচ্ছে কনকনে ঠান্ডা বাতাস। রাতে বৃষ্টির মতো ঝরছে কুয়াশা। এমন ঠান্ডায় বিপাকে পড়েছেন এই অঞ্চলের নি¤œ আয়ের মানুষ। তারা প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে কাজে যেতে পারছেন না। আবার ঠান্ডার মধ্যে কাজ করায় অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন শীতজনিত রোগে। পর্যাপ্ত গরম কাপড়ের অভাবে শিশু ও বয়স্করাও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
সদর হাসপাতালের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ঠাকুরগাঁওয়ে প্রতি বছর শীতজনিত রোগে দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। জেলা সিভিল সার্জন নূর নেওয়াজ আহমেদ বলেন, ‘এ জেলায় শীতের তীব্রতা অনেক বেশি। এত মানুষ শীতের সময় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয় যে হাসপাতালে জায়গা দেয়া সম্ভব হয় না। ‘শীতের তীব্রতা থেকে বাঁচতে পর্যাপ্ত গরম কাপড় পরতে হবে। শিশুদের যেন ঠান্ডা না লাগে সে জন্য বিশেষ করে মায়েদের সচেতন থাকতে হবে।’ দরিদ্র মানুষকে শীতের হাত থেকে বাঁচাতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কম্বল দেয়ার কথা জানানো হলেও অনেকের অভিযোগ তারা কিছুই পাননি।
বৃদ্ধ আমজাদ হক বলেন, ‘হামার কপালত (ভাগ্যে) কোনো দিন একটাও শীতের কাপড় জুটেনি।’ তবে জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এরই মধ্যে ২৬ হাজার ৩০০ কম্বল পেয়েছে প্রশাসন। আরও ৮ লাখ টাকা এসেছে শীতবস্ত্র ও কম্বল কেনার জন্য। এমন তথ্যে স্থানীয় একজন বলেন, ‘শীত পালাইলে কি হামাক কম্বল দেবে সরকার?’
জেলা প্রশাসক মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত যে বরাদ্দ এসেছে তা যথেষ্ট নয়। আমরা আরও ২৫ লাখ টাকা ও ১ লাখ কম্বল চেয়েছি। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সঙ্গেও কথা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি বেসরকারি সংগঠন আমাদের মাধ্যমে কম্বল বিতরণ করেছে।’ একই অবস্থা উত্তরের আরেক জেলা নীলফামারীর। গত এক সপ্তাহে এখানে ১০ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে তাপমাত্রা ওঠানামা করছে। ঘন কুয়াশার কারণে সূর্য দেখা দিচ্ছে দুপুর ১২টার পর। তাও দুই থেকে তিন ঘণ্টার জন্য। এর সঙ্গে আছে দিন-রাতের বিভিন্ন সময় গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। ডিমলা আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষক বাবুল হোসেন জানান, আরও কয়েক দিন এরকম ঠান্ডা থাকবে। শীতে নি¤œ আয়ের মানুষের ভোগান্তি সবচেয়ে বেশি। বাড়ি থেকে বের হলেও ঠান্ডায় কষ্ট পেতে হয় আবার না বের হয়েও উপায় নেই।
নীলফামারী শহরের গাছবাড়ি এলাকার বৃদ্ধ রিকশাচালক মকবুল হোসেন বলেন, ‘এবার ঠান্ডা দেরিতে নামিছে। কয়েক দিন থাকি বেশি ঠান্ডা লাগেছে। বিকালের পর থেকে খুব ঠান্ডা নামে। এত ঠান্ডাত রাস্তাত মানসি (মানুষ) না থাকায় কামাই কমি গেইছে।’ শহরের উত্তর হাড়োয়া এলাকার আমিনা বেগম বলেন, ‘খুব কষ্ট করি থাকিবার নাগে (থাকতে হয়) রাইতোত। বয়স হয়া গেইছে। আগের কম্বলটা পুরান হয়া গেইছে। আরও কম্বল নাগে। ঠান্ডার জন্যে খুব কষ্ট হইছে এ্যালা (এখন)।’ শীত বাড়ায় হাসপাতালে বেড়েছে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও সর্দি-কাশি আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।
নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ আব্দুল আউয়াল জানান, গত এক সপ্তাহে ডায়রিয়ার রোগী ১০ গুণ এবং নিউমোনিয়া ও সর্দি-কাশির রোগী চারগুণ বেড়েছে। শীতার্তদের সহায়তার বিষয়ে ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ময়নুল হক বলেন, ‘আমাদের এই ইউনিয়ন তিস্তাবেষ্টিত হওয়ায় এখানে শীত বেশি। এখানকার অন্তত পাঁচ হাজার মানুষকে শীতবস্ত্র দেয়া প্রয়োজন। এখনও পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র পাওয়া যায়নি।’ এই বিষয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মেজবাহুর রহমান জানান, প্রথম দফায় প্রতি ইউনিয়নে ৪৭০টি করে কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। অধিদপ্তর থেকে ৮ লাখ ৮১ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। সেগুলো দিয়ে ৩ হাজার ২০টি কম্বল কেনার প্রক্রিয়া চলছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় জানিয়েছে, এই জেলার ৬০টি ইউনিয়ন ও চারটি পৌরসভায় ৩০ হাজার ৮০টি কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। অধিদপ্তর থেকে উপজেলা ও পৌরসভা পর্যায়ে কম্বল কেনার জন্য বরাদ্দ এসেছে। সেই টাকায় কেনার প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়া জেলা পর্যায়েও আট লাখ টাকার কম্বল কেনা হচ্ছে। ঘন কুয়াশার কারণে মেহেরপুরে বেশ বেলা পর্যন্ত যানবাহনগুলো হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে।
বাসচালক মো. গোলাম বলেন, ‘ঘন কুয়াশায় সামান্য দূরের জিনিসও ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না। সব সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কা নিয়ে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। আমরা দিনের বেলাতেও হেডলাইট জ্বালিয়ে ধীরগতিতে চলাচল করছি।’ ট্রাকচালক মো. সামাদ বলেন, ‘প্রচ- শীতে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে রাখাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’ চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, মেহেরপুরে মঙ্গলবার সকাল ৬টায় সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সোমবার সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল ১২ দশমিক ৪ ডিগ্রি। সবজি ব্যবসায়ী মনোয়ার বলেন, ‘আমাদের সকালবেলা ক্ষেতে গিয়ে সবজি তুলে এনে বিক্রি করতে হয়। কয়েক দিন ধরে ঘন কুয়াশা আর বাতাসে কাজ করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। ক্ষেতে গেলে গাছের সঙ্গে লেগে থাকা কুয়াশায় কাপড় ভিজে ঠান্ডা লাগছে।’ মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতাল থেকে জানা যায়, ঠান্ডা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত শিশু ও বৃদ্ধের সংখ্যাও বাড়ছে।- নিউজবাংলা