শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২৮ পূর্বাহ্ন

দীর্ঘদিন অবহেলিত নৌপথ

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৭ জানুয়ারী, ২০২২

দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগ অবহেলিত থাকার সুস্পষ্ট প্রভাব পড়েছে নৌপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে। ১৯৭৫ সালে দেশে রেল, সড়ক ও নৌপথ মিলে যাত্রীর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭০০ কোটি প্যাসেঞ্জার কিলোমিটার (পিকেএম)। ওই বছর ২৭২ কোটি প্যাসেঞ্জার কিলোমিটার যাত্রী পরিবহন হয়েছিল নৌপথে, যা ছিল দেশের মোট যাত্রীর ১৬ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৯ সালে দেশে সাড়ে ১৯ হাজার কোটি প্যাসেঞ্জার কিলোমিটার যাত্রীর মধ্যে নৌপথে পরিবহন হয় ৯৭৫ কোটি প্যাসেঞ্জার কিলোমিটার যাত্রী, যা পরিবহন হওয়া মোট যাত্রীর মাত্র ৫ শতাংশ। দেশে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে এখন খুবই নগণ্য ভূমিকা রাখছে নৌপথ। যদিও নদীমাতৃক বাংলাদেশে একসময় পণ্য পরিবহনসহ সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় নৌপথকেই দেখা হতো সবচেয়ে সম্ভাবনাময় হিসেবে। কিন্তু উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোয় ক্রমেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ার পাশাপাশি ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ কমতে থাকায় দিনে দিনে জৌলুস হারিয়েছে দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথ। একই অবস্থা পণ্য পরিবহনেও। ১৯৭৫ সালে পরিবহন হওয়া ২৬০ কোটি টন কিলোমিটার পণ্যের মধ্যে ৯৬ কোটি টন কিলোমিটার পণ্য পরিবহন হয়েছিল নৌপথে। সড়ক ও রেলপথের চেয়েও ওই বছর নৌপথে পণ্য পরিবহনের হার ছিল বেশি, ৩৭ শতাংশ। সাড়ে চার দশক পরে এসে সংখ্যাটি ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১৯ সালে দেশে সব মিলিয়ে ৩ হাজার ১০০ কিলোমিটার টন পণ্য পরিবহন হয়। এর মধ্যে নৌপথে পরিবহন হয় মাত্র ১৮৬ টন কিলোমিটার পণ্য।
নৌ-পরিবহন খাত দিনে দিনে এভাবে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ার পেছনে বিনিয়োগ কমে আসাকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। পরিসংখ্যানেও এসেছে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পরিবহন খাতে বরাদ্দ ছিল ৫২৮ কোটি টাকা। এর ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ বা ১৮৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল নৌ-পরিবহনের উন্নয়নে। আর সপ্তম পঞ্চবার্ষিক (২০১৬-২০) পরিকল্পনায় পরিবহন খাতে বরাদ্দ হয় ৩ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে নৌ-পরিবহনের উন্নয়নে বরাদ্দ হয় ৪ দশমিক ২ শতাংশ অর্থ। পাঁচ বছরের জন্য খাতটির উন্নয়নে বরাদ্দ হয় ১২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। যদিও একই সময়ে দেশের সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়নে বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। ৭১ হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ ছিল রেলপথের উন্নয়নে।
১৯৭৫-পরবর্তী সরকারগুলো উন্নয়ন সহযোগীদের পরিকল্পনামতো সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়নে বাড়তি গুরুত্ব দেয়ায় দেশের সম্ভাবনাময় নৌ-খাত আজ অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, স্বাধীনতার পর প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দিকে আমরা যদি তাকাই, দেখতে পাব আমাদের দূরদর্শী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন সড়ক, রেল, নৌপথকে সমান গুরুত্ব দিয়ে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু পরে আমরা সেটিকে আর ধরে রাখতে পারিনি। এর পেছনে দাতা সংস্থাগুলোর ভূমিকা যেমন রয়েছে তেমনি জনগণের চাহিদা বুঝে উন্নয়ন করতে গিয়ে আমাদের রাজনীতিবিদরাও প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সেই ধারা থেকে সরে গিয়েছেন।
সার্বিক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের নৌ-পরিবহন খাতে যতটা বিনিয়োগ দরকার, বর্তমান সরকার ঠিক ততটাই বিনিয়োগ করছে। বাজেট বরাদ্দ বড় বিষয় নয়, বড় বিষয় হলো সক্ষমতা। এখন আমাদের যতটুকু প্রয়োজন, ততটাই বরাদ্দ হচ্ছে। গত ১২ বছরে বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেক নৌপথ সচল হয়েছে। বন্দর সচল হয়েছে। নৌপথে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্রমেই বাড়ছে। নৌ-পরিবহন খাতের উন্নয়নে আমরা সঠিক পথেই আছি।
স্বাধীনতার পর প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পরিবহন খাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ পেয়েছিল দেশের নৌ-পরিবহন খাত। পরিবহন বাজেটের ৩৫ শতাংশের বেশি বরাদ্দ হয়েছিল নৌ-পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে। ওই সময়ে সবচেয়ে বেশি পণ্য পরিবহন হতো নৌপথে। যাত্রী পরিবহনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল নৌপথের। পরের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলোয় ক্রমেই গুরুত্ব হারায় নৌপথের উন্নয়ন। কমে যায় বিনিয়োগ। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নৌ-পরিবহন খাতে বরাদ্দ পরিবহন বাজেটের মাত্র ৪ শতাংশে নেমে আসে।
১৯৭৫ সালে দেশে নৌপথের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ১৪০ কিলোমিটার। চলাচল করত প্রায় ২৫ হাজার নৌযান। পরের সাড়ে চার দশকে নৌপথ কমে ছয় হাজার কিলোমিটারের নিচে নেমে এসেছে। অর্ধেক হয়েছে নৌযানের সংখ্যা। প্রথম শ্রেণীর নৌপথের পরিমাণ মাত্র ৬৮৩ কিলোমিটার। অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে নৌপথ। কিছুদিন পর পরই ঘটছে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা। বন্দর আর ঘাটগুলোর অপ্রতুল অবকাঠামো বাড়িয়েছে যাত্রীদের দুর্ভোগ। অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধার কারণে নৌপথে পণ্য পরিবহনে আগ্রহ হারাচ্ছেন ব্যবসায়ীরাও। দেশের নৌপথের এ বেহাল দশার জন্য এখন সময়োপযোগী বিনিয়োগ না হওয়াকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশের অন্যতম প্রধান নদীবন্দর ঢাকার সদরঘাট। রাজধানীর প্রধানতম নৌঘাট হিসেবে এখানে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে যেমন সুযোগ-সুবিধা তৈরি হওয়ার কথা ছিল, তার অনেক কিছুই এখানে অনুপস্থিত। অবকাঠামোগতভাবে পিছিয়ে থাকা নদীবন্দরটির সবখানেই দৈন্যের চিত্র। যাত্রী বা পণ্য পরিবহন কোনোটির জন্যই সময়োপযোগী পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই এখানে। সম্প্রতি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে উপস্থাপিত একটি প্রতিবেদনেও বন্দরটির দৈন্যদশার চিত্র উঠে আসে।
সম্প্রতি অভিযান-১০ লঞ্চ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ব্যপাক প্রাণহানি ঘটে। সে ক্ষত না কাটতেই বুধবার শীতলক্ষ্যায় ট্রলার ডুবে নিখোঁজ হয়েছে বেশ কয়েকজন। দুটি ঘটনায়ই দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে ত্রুটিপূর্ণ নৌযান চলাচলকে দায়ী করা হয়েছে। অথচ নৌবন্দর থেকে নৌযান ছাড়ার আগে নৌযানটির ফিটনেস, মেয়াদ, চালকের লাইসেন্সসহ কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখার দায়িত্ব নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর ও বিআইডব্লিউটিএর নৌ-ট্রাফিক বিভাগের পরিদর্শকদের। দুটি সংস্থার হাতে দায়িত্ব থাকার পরও জনবল সংকটের কারণে নিয়মিত নৌযান তদারকির কাজ সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
যোগাযোগের অন্য মাধ্যমগুলোর তুলনায় নৌপথে ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ না হওয়ায় দেশের নৌপথগুলো আজ বেহাল দশায় পড়েছে বলে মনে করেন নদী ও নৌ-পরিবহনবিষয়ক গবেষক আশীষ কুমার দে। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, প্রয়োজনীয় ড্রেজিং না হওয়ায় বহু নদী স্রোত ও নাব্য হারিয়ে নৌ-চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। নৌপথ সংকুচিত হওয়ায় এবং ক্রয় ও নির্মাণে ঋণ সুবিধা না পাওয়ায় কমেছে জলযানের সংখ্যা। পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না হওয়ায় দেশের সামগ্রিক নৌ অবকাঠামোগুলো জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। অন্যদিকে নৌপথের বদলে সড়কপথের উন্নয়নে বাড়তি গুরুত্ব দেয়ার কারণেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের নৌপথ ও প্রাণ-প্রকৃতি। অপরিকল্পিতভাবে সড়ক ও সেতু নির্মাণ করে আমরা নৌপথগুলোকে একদিকে যেমন অচল করে দিয়েছি, তেমনি উন্মুক্ত জলাশয়গুলোর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহও বিঘিœত হয়েছে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com