দারিদ্র্যপীড়িতদের জন্য থাকবে বিশেষ প্রণোদনা
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ায় বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটির সভায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করে অর্থ বিভাগ। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুতের দাম ঠিক কী পরিমাণ বাড়ানো হবে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে বিদ্যুৎ বিভাগের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, বিষয়টি অনেকটাই নির্ভর করছে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাব্য হারের ওপর।
বিপুল ভর্তুকির চাপ কমাতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরও যাতে জীবনযাত্রায় মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সেজন্য কৃষক ও কর্মহীন দরিদ্রদের জন্য পৃথক প্রণোদনা প্যাকেজ এবং ওএমএস বিতরণের পরিকল্পনা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর অংশ হিসেবে দারিদ্র্যের হার ৩০ শতাংশের বেশি এমন ৬০ উপজেলার দরিদ্র কর্মহীনদের জন্য কর্মসৃজন কর্মসূচিতে পৃথক প্রণোদনা দেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। স¤প্রতি গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ও তার প্রভাব মোকাবেলায় করণীয় বিষয়ে একটি কৌশলপত্র উপস্থাপন করেছে অর্থ বিভাগ। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটির সভায় প্রণোদনা দেয়ার এ পরিকল্পনার কথা উঠে এসেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দেশে গ্যাসের চাহিদা পূরণের জন্য আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করছে সরকার। স্থানীয় পর্যায়ে উত্তোলনের পাশাপাশি আমদানীকৃত এলএনজিও জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম ক্রমেই বেড়েছে। যদিও জ্বালানি বিভাগ গ্যাস বিক্রি করছে আগের মূল্যেই। এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি হিসেবে দিতে হচ্ছে সরকারকে। এ অবস্থায় দাম না বাড়িয়ে ভর্তুকি দিয়ে গ্যাসের সরবরাহ অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়।
তিনি জানান, কভিড মহামারীর আগে স্বাভাবিক অবস্থায় এক কার্গো এলএনজি আমদানিতে খরচ হতো ২৫০ থেকে ২৭০ কোটি টাকার মতো। বর্তমানে একই পরিমাণ এলএনজিবাহী কার্গো আমদানিতে খরচ হচ্ছে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। সে হিসেবে বর্তমানে দেশে এলএনজি আনতে হচ্ছে আগের চেয়ে অন্তত পাঁচ গুণ বেশি দামে। জ্বালানি পণ্য আমদানিতে গত এক বছরের ব্যয় বিবেচনায় নিলে দেখা যাচ্ছে, এতে ব্যয় হয়েছে বরাদ্দকৃত অর্থের চেয়ে অনেক বেশি। তাই বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছর বাজেটে সারে ৯ হাজার ২০০, জ্বালানিতে ৪ হাজার ও বিদ্যুতে ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রয়েছে। সব মিলিয়ে ভর্তুকি বরাদ্দ রয়েছে ৪৮ হাজার কোটি টাকা। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় চলতি বাজেটে জ্বালানি তেল, এলএনজি ও সারে ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়াবে ৭০ হাজার কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের প্রাক্কলন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর ইউরিয়ায় ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকাসহ সারে মোট ভর্তুকি দাঁড়াবে ২৫ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া, এলএনজি আমদানিতে ১০ হাজার কোটি টাকা ও বিদ্যুতে ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এদিকে জ্বালানি বিভাগ এলএনজি আমদানি অব্যাহত রাখতে অর্থবিভাগের কাছে ৯ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে গত নভেম্বরে চিঠি দিয়ে পেয়েছে মাত্র ১ হাজার কোটি টাকা।
এ ভর্তুকির লাগাম টানতে মূল্য সমন্বয় করা হলে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই দেশের যে ৬০টি উপজেলায় দারিদ্র্যের হার ৩০ শতাংশের ওপরে, সেসব অঞ্চলে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণের কথা ভাবছে সরকার। অতি দরিদ্রপ্রবণ এসব অঞ্চলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসৃজন করবে এমন একটি লক্ষ্যভিত্তিক প্রণোদনা প্যাকেজ গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ বা তার বেশি হলে সারা দেশে সীমিত সময়ের জন্য ওএমএস কর্মসূচি চালুর পরিকল্পনাও রয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের। এ প্রসঙ্গে অর্থ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ভর্তুকির চাপ কমাতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে অর্থনীতিতে তার প্রভাব কেমন এবং সেটা কীভাবে পূরণ করা সম্ভব হবেÍসেগুলো নিয়ে পর্যালোচনা হচ্ছে। অর্থ বিভাগ বলছে, বর্তমানে ৫৩ শতাংশ সেচকাজে ডিজেল ব্যবহার হয়। যার দাম এরই মধ্যে বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া ৪৭ শতাংশের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়। যার দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়লে কৃষকরা ব্যাপক চাপে পড়বেন। তাই শুধু কৃষকদের জন্য একটি পৃথক লক্ষ্যভিত্তিক প্রণোদনা প্যাকেজ গ্রহণ করা যেতে পারে।
ভর্তুকির সার্বিক বিষয়ে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিশ্ববাজারে সার, তেল, গ্যাসের দাম বাড়ায় ভর্তুকির চাপ বাড়বে। তাই বাজেট থেকে এত পরিমাণ অর্থ দেয়ার সক্ষমতা নেই সরকারের। এজন্যই আমরা অনেক দিন থেকেই রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বাড়িয়ে সরকারের সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে আসছি। কিন্তু রাজস্ব আহরণ বাড়াতে পারছে না সরকার। সরকারের রাজস্বের পরিমাণ বাড়াতে পারলে এসব পণ্যে দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের কষ্ট দেয়া লাগত না।
তাই যদি দাম বাড়াতেই হয়, তাহলে সবদিক বিবেচনায় নিয়ে সহনীয় পর্যায়ে বাড়ানোর পরামর্শ দেন এ অর্থনীতিবিদ। একই সঙ্গে সরকার রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর ক্ষেত্রে পরিকল্পনা গ্রহণ করতেও বলেন তিনি। এছাড়া মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় কৃষক ও কর্মহীন দরিদ্রদের জন্য পৃথক প্রণোদনা প্যাকেজ এবং ওএমএস বিতরণের পরিকল্পনাকেও ভালো উদ্যোগ বলেন এ অর্থনীতিবিদ।
উচ্চ আমদানি ব্যয়, টাকার অবমূল্যায়ন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক জাহাজীকরণ ব্যয় কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ জনগোষ্ঠীর জীবনমানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এদিকে সারে ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে বরাদ্দের তিন গুণ হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও কভিড মহামারীর সময়ে দেশের খাদ্যনিরাপত্তার কথা চিন্তা করে কৃষি উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে আপাতত দাম বাড়ানোর কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে সারের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী মো. আবদুর রাজ্জাক। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সারে যতই ভর্তুকি প্রয়োজন হবে সেটা সরকার বহন করবে। খাদ্যনিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আপাতত সরকার সারের দাম বাড়াবে না।
সার, জ্বালনি তেল, গ্যাস এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ ও বিপণন ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। মূল্যস্ফীতি ও জনসাধারণের ওপর বিরূপ প্রভাবের দিকটি বিবেচনায় রেখেই সবসময় এসব পণ্য ও সেবার দাম নির্ধারণ করা হয়। সে কারণে দীর্ঘদিন ধরেই ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য সহনশীল রাখতে এসব ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্য বা সেবার দাম বাড়লে মাঝেমধ্যেই দেশেও দাম বাড়ানো হয়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের দাম ক্ষেত্রবিশেষে দ্বিগুণ হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে চলতি বাজেটে এসব ক্ষেত্রে যে পরিমাণ ভর্তুকি রাখা হয়েছে, তা কয়েক গুণ বেড়ে যেতে পারে। এতে বাজেট ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জটিল হয়ে যাবে। এছাড়া আর্থিক খাত একটি বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়তে পারে। তাই এবার সার, এলপিজি ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকির চাপ কমানোর প্রস্তাব করেছে অর্থ বিভাগ। এরই মধ্যে ডিজেল, কেরোসিন, এলপিজির দাম বাড়ানো হয়েছে।