শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৪৬ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::
ধনবাড়ীতে আধুনিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে শুরু প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী রৌমারীতে বড়াইবাড়ী সীমান্ত যুদ্ধ দিবস পালিত মাধবদীতে জ্যান্ত কই মাছ গলায় ঢুকে কৃষকের মৃত্যু বদলগাছীতে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী কালীগঞ্জে কৃষক মাঠ দিবস ও কারিগরি আলোচনা লতিফ মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবিতে মানববন্ধন নড়াইলের কালিয়া উপজেলার শ্রীনগর গ্রামে ভ্যানচালককে পুলিশি হয়রানির প্রতিবাদে মানববন্ধন বরিশালে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী মেলার উদ্বোধন হাতিয়ায় দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থার ক্যাম্পাসে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদুর রহমান বেলায়েত স্মৃতি কর্ণার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র উদ্বোধন গজারিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী আমিরুল ইসলামের পক্ষে ছাত্রলীগের গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ

জেনে শুনে বিষ করেছি পান?

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২২

আপনি কি পান খান? উত্তর : না, আমি পানাহারে অভ্যস্ত নই। ব্যাকরণের ভাষায় উত্তরটি সঠিক, কিন্তু ভাবের দিক থেকে অর্থহীন। একটি বিয়ের অনুষ্ঠানও অনেক সময় যেন অর্থহীন হয়ে যায় যদি ভূরিভোজনের পর সেখানে পান সুপারির আয়োজন না থাকে।
পান সুপারির ব্যবহার প্রায় চার হাজার বছরের। পৃথিবীর কয়েকটি শহর সুপারির নামে নামকরণ করা হয়েছে। যেমন- ভারতের গুয়াহাটি, মালয়েশিয়ার পেনাং প্রভৃতি। পূর্ব আফ্রিকা, ভারত উপমহাদেশ থেকে শুরু করে তাইওয়ান পর্যন্ত প্রায় ৬০ কোটি লোক পান সুপারি খেয়ে থাকেন। ভারত, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়ার পর বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ সুপারি উৎপাদনকারী দেশ। পান সুপারি খেলে শরীর কিছুটা গরম হয়, কর্মদক্ষতা ও মনের সতর্কতা বৃদ্ধি পায়। যেমন- একজন ড্রাইভার গাড়ি চালানোর সময় ঘুম পেলে গাড়ি থামিয়ে একটি পান খেয়ে নেন, তাতে তার ঘুম চলে যায়।
পান সুপারি ও রকমারি জর্দার গুণাগুণ নিয়ে কিছু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নানা রকম প্রচারণা করে থাকে। এমনকি কোনো কোনো প্রখ্যাত আলেমও এগুলোর মধ্যে অনেক উপকারিতা খুঁজে পেয়েছেন (বেহেশতি জেওর, নবম খ-)। হিন্দু ধর্মের ও বৌদ্ধ ধর্মের কোনো কোনো শাখার কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পান সুপারির ব্যবহার অপরিহার্য বিবেচনা করা হয়। পান সুপারি সহজলভ্য ও সস্তা। এর ব্যবহারও ব্যাপক। কোনো বৃদ্ধ লোকের দাঁত নড়বড়ে হলে বা না থাকলে পান সুপারিকে হামান দিস্তা দিয়ে গুঁড়ো করে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তবুও পান তার খাওয়া চাই। আমার এক আত্মীয়া প্রায় প্রতি ঘণ্টায় পান খান। এক দিন হঠাৎ পান ফুরিয়ে গেলে রাত ১১টায় প্রতিবেশিনীর বাসায় গিয়ে হাজির ‘পান ভিক্ষার’ জন্য। তিনি তো রীতিমতো অবাক। কোনো দিন তার এই প্রতিবেশিনী কোনো কিছু চাইতে আসেননি। পানের জন্য এত রাতে হাজির! অর্থাৎ পান সুপারি নির্ভরশীলতা তৈরি করে এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে না খেলে প্রত্যাহারজনিত সমস্যা (Withdrawl Syndrome) বা নানা রকম শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। আমার এক বন্ধু ঘুম থেকে উঠে পান না খেলে প্রাতক্রিয়া করতে পারেন না। আরেকজন রোগী পান ফুরিয়ে গেলে মাঝ রাতে পানের দোকানদারকে বাধ্য করেন দোকান খুলতে। কয়েকজন রোগীর সাথে আলাপচারিতায় জানা যায়, তারা সিগারেট ছাড়তে সক্ষম হয়েছেন, কিন্তু পানের নেশা ছাড়তে পারেননি।
পান সুপারির উপকারিতা নিয়ে বৈজ্ঞানিক কোনো গবেষণা হয়নি। এর অপকারিতার ওপর অনেক গবেষণা হয়েছে। পানের সাথে যেসব উপাদান ব্যবহার করা হয় তা হচ্ছে সুপারি, চুন, খয়ের, জর্দা, লবঙ্গ প্রভৃতি। এসব উপাদানের বেশির ভাগই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক।
সুপারি : এতে অ্যারেকোলিন (Arecoline), অ্যারেকাইডিন (Arecaidine), গাভাকাইনসহ (Gavacaine) বেশ কিছু ক্ষারজাতীয় পদার্থ রয়েছে, যা রক্তনালীকে সঙ্কুচিত করে। সুপারিতে অ্যাডরেনালিন আছে। ফলে নিয়মিত ও অতিরিক্ত সুপারি ব্যবহার করলে উচ্চ রক্তচাপ, বুক ধড়ফড় করা, ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়া, হাঁপানি বৃদ্ধি পাওয়া এবং হৃদরোগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আসলে সুপারি প্রতিটি অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে। লিভার ইনজুরি, কিডনি রোগ, বিপিএইচ, ইনফার্টিলিটি, হাইপারলিপিডোমিয়া, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, মানসিক রোগ বৃদ্ধি পাওয়া, দাঁতের মাড়ি ক্ষয় ও দাঁত পড়ে যাওয়া ইত্যাদির সাথে সুপারি জড়িত। গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে অকালে সন্তান প্রসব (Preterm birth), শিশুর ওজন ও উচ্চতা কম হতে পারে। সুপারির সাথে মেটাবলিক সিন্ড্রোম ও Obesityবা স্থূলতা জড়িত। সুপারির সাথে ক্যান্সারের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিকে কারসিনোজেন (ক্যান্সারের উপাদান) হিসেবে উল্লেখ করেছে। আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণা সংস্থা (IARC) সুপারিকে ১৯৮৫ সাল থেকে ‘কারসিনোজেন’ হিসেবে গণ্য করে আসছে। ২০০৯ সালে ৩০ জন বিজ্ঞানী আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণা সংস্থায় নিশ্চিত করেছেন, সুপারিতে ক্যান্সার জীবাণু রয়েছে। পৃথিবীর যেসব এলাকায় সুপারি ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে মুখের ও খাদ্যনালীর ক্যান্সার সবচেয়ে বেশি। এ অঞ্চলে এক লাখ লোকের মধ্যে ২০ জনের এবং সব ধরনের ক্যান্সারের মধ্যে শতকরা ৩০ জনের শুধু মুখের ও খাদ্যনালীর ক্যান্সার হয়ে থাকে। আমারই পরিচিত তিনজন আলেম ছিলেন যারা প্রচুর পান-সুপারি খেতেন এবং তারা মুখের ও খাদ্যনালীর ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি (CDC) নির্ভরযোগ্য, গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মৃত্যুর প্রধান কারণ হচ্ছে ক্যান্সার।
সিডিসির তথ্য অনুযায়ী, সুপারির সাথে Oral submucous fibrosis, মুখের ক্যান্সার, নেশা (Addiction), প্রজনন সমস্যা প্রভৃতি জড়িত। যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান এফডিএ (FDA), সুপারিকে বিষাক্ত গাছের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং সুপারিকে চিবানো বা খাওয়ার জন্য নিরাপদ মনে করে না।
চুন : মানে, ক্যালসিয়াম হাইড্রক্সাইড পান সুপারির সাথে অল্প পরিমাণ ব্যবহার করা হয়। এতে মুখগহ্বরের পিএইচ (Ph) ১২.৫ এর উপরে উঠে যায়, ফলে সুপারির আগে উল্লিখিত ক্ষারজাতীয় পদার্থগুলো জিহ্বার নিচে দিয়ে সরাসরি রক্তে প্রবেশ করে। চুন মুখে কেমিক্যাল বার্ন বা ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। ঘন ঘন পান খাওয়ার সাথে অতিরিক্ত চুন সেবনে হাইপারক্যালসেমিয়া, মেটাবলিক অ্যালকালসিস, মিল্ক অ্যালকালি সিন্ড্রোম, কিডনি ইনজুরি এবং কিডনিতে পাথর হতে পারে।
জর্দা : পান-সুপারি ও চুনের সাথে জর্দার সংযোজন সা¤প্রতিক সময়ের; অ্যামেরিকা মহাদেশ থেকে তামাক আমদানির পর থেকে। জর্দা এই তামাক পাতা থেকে তৈরি করা হয়। তামাকে ২৮টি কার্সিনোজেন (ক্যান্সারের উপাদান) রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীর প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ তামাক সেবন করেন। এর মধ্যে প্রায় ১১ শতাংশ ধোঁয়াযুক্ত তামাক (সিগারেট, বিড়ি প্রভৃতি) সেবন করে থাকে এবং প্রায় ২২ শতাংশ ধোঁয়াবিহীন তামাক (SLT) যেমন জর্দা, গুল প্রভৃতি ব্যবহার করে থাকে। এতে ধোঁয়াযুক্ত তামাকের চেয়ে নিকোটিনের পরিমাণ তিন-চার গুণ বেশি। কাজেই জর্দার ক্ষতি সিগারেটের চেয়েও বেশি হতে বাধ্য। ল্যাবরেটরিতে প্রাণীদের ওপর পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, নিকোটিন প্রায় প্রতিটি অঙ্গে ক্যান্সার করতে পারে।
খয়ের : এর মধ্যে ১২ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ আছে। খয়েরের অত্যধিক ব্যবহার লিভার ইনজুরি করতে পারে এবং এতে শরীরের রক্তচাপ কমে যেতে পারে।
পান : এর মধ্যে ইউজেনল (Eugenol) রয়েছে, যা রক্তনালীকে সঙ্কুচিত করতে পারে। পানের মধ্যে ভিটামিন সি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, রেচক প্রভৃতি থাকতে পারে। তবে ‘বিষাক্ত গাছের ফল’ (সুপারি) খেলে পানের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বা ভিটামিন সি কিইবা উপকার করবে?
উপরের আলোচনা থেকে আশা করি স্পষ্ট হয়েছে যে, সহজলভ্য ও সস্তা পান সুপারি আমাদের জন্য ব্যয়বহুল ক্যান্সার রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যান্য মাদকদ্রব্যের মতো পান সুপারিও নির্ভরশীলতা (Dependency) এবং প্রত্যাহার উপসর্গ (Withdrawl Syndrome) তৈরি করে। পৃথিবীতে নিকোটিন (বিড়ি, সিগারেট), মদ, ক্যাফেইনের (কফি) পর পান সুপারি হচ্ছে চতুর্থ বহুল ব্যবহৃত নেশা সৃষ্টিকারী বস্তু। অথচ জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হওয়ার পরও পান সুপারি বা পান মাসালা হচ্ছে অবহেলিত একটি আলোচ্য বিষয়। এই উপমহাদেশের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা এরই মধ্যে এ ব্যাপারে সরব হচ্ছেন। অস্ট্রেলিয়াতে সুপারির ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ এবং পান খাওয়া একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। থাইল্যান্ডে শিক্ষিতদের মধ্যে পান সুপারির ব্যবহার অনেক কমে যাচ্ছে। তাইওয়ান বছরে এক দিন ‘সুপারি প্রতিরোধ দিবস’ পালন করে থাকে এবং সরকারিভাবে কৃষকদের সুপারি উৎপাদন না করার জন্য নানা রকম প্রণোদনা দিচ্ছে। আমাদেরও সময় এসেছে এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করার।
লেখক : মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com