ইসলাম যেভাবে ব্যক্তিগত ইবাদতে উৎসাহ দিয়েছে, তেমনি সমাজের মানুষের কল্যাণে কাজ করাকেও ইবাদত হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘সৎকর্ম শুধু এই নয় যে তোমরা পূর্ব ও পশ্চিমে মুখ ফেরাবে। বরং সৎ কাজ হলো, যে ঈমান আনবে আল্লাহর ওপর, পরকালের ওপর, ফেরেশতাদের ওপর এবং সব কিতাব ও নবী-রাসুলগণের ওপর। আর সম্পদ ব্যয় করবে তারই মহব্বতে আত্মীয়-স্বজন, এতিম, মিসকিন, মুসাফির, ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য। আর যারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত আদায় করে এবং যারা কৃতপ্রতিজ্ঞা পালনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য ধারণকারী; তারাই সত্যাশ্রয়ী এবং তারাই আল্লাহভীরু।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৭৭) আলোচ্য আয়াত থেকে বোঝা যায় যে ব্যক্তিগত ইবাদত-বন্দেগির পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্ব পালনও ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে। নি¤েœ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সামাজিক বিষয় আলোচিত হলো:
অসহায়দের সাহায্য-সহায়তা : সমাজের বিধবা, এতিম ও দুস্থদের সাহায্য-সহযোগিতা করা বড় ইবাদত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বিধবা ও মিসকিনদের সমস্যা সমাধানের জন্য ছোটাছুটি করে সে যেন আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে লিপ্ত। বর্ণনাকারী বলেন, আমার মনে হয় রাসুলুল্লাহ (সা.) এ কথাও বলেছেন, সে যেন ওই ব্যক্তির মতো, যে সারা রাত সালাত আদায় করে এবং সারা বছর সিয়াম পালন করে।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৯৮২)
রোগীর খোঁজ-খবর নেওয়া : সমাজের কেউ অসুস্থ হলে তার খোঁজ-খবর নেওয়া একজন মুসলিমের অন্যতম দায়িত্ব। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘একজন মুসলিম যখন তার কোনো রুগ্ণ মুসলমান ভাইকে দেখতে যায় তখন সে যেন জান্নাতের বাগানে ফল আহরণ করতে থাকে, যতক্ষণ না সে ফিরে আসে। (মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৮)
শোকাহতকে সান্ত¡না প্রদান : সমাজের কোনো ব্যক্তি কোনো দুর্ঘটনায় পতিত হলে তার পাশে দাঁড়ানো, তাকে সান্ত¡না প্রদান করা ও আশার বাণী শোনানো সওয়াবের কাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার মুমিন ভাইকে বিপদে সান্ত¡না প্রদান করবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তাকে সম্মানের পোশাক পরিধান করাবেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৬০১)
মৃত ব্যক্তির পরিবার-পরিজনের জন্য খাদ্য সরবরাহ : কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তার পরিবার-পরিজন শোকে মুহ্যমান থাকে। ওই সময় পাড়া-প্রতিবেশীদের কর্তব্য হলো তাদের খাদ্য সরবরাহ করা। মুতার যুদ্ধে জাফর (রা.) শহীদ হলে রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের বলেছিলেন, ‘তোমরা জাফর (রা.)-এর পরিবারের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করো। কেননা আজ তাদের প্রতি এমন বিষয় এসেছে, যা তাদের ব্যস্ত রেখেছে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৬১০)
প্রতিবেশীর খবর রাখা : পাড়া-প্রতিবেশীর খোঁজ-খবর নেওয়া একজন মুসলিমের কর্তব্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর ইবাদত করো তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক কোরো না। পিতা-মাতার সঙ্গে সৎ ব্যবহার করো এবং নিকটাত্মীয়, এতিম, মিসকিনদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো। নিকট প্রতিবেশী ও দূর প্রতিবেশী এবং সহকর্মীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৩৬)
প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণ করা সম্পর্কে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম! সে মুমিন নয়। আল্লাহর কসম! সে মুমিন নয়। আল্লাহর কসম! সে মুমিন নয়। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! কে সেই ব্যক্তি? তিনি বলেন, যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ থাকে না।’ (বুখারি, হাদিস : ৪৭৪৫)
সমস্যাগ্রস্তের সমস্যা সমাধান করা : সমাজের কোনো মানুষ যখন সমস্যায় আক্রান্ত হয় তখন সবার কর্তব্য হলো তাকে এ বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের কোনো দুঃখ দূর করবে তার বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার দুঃখ দূর করে দেবেন।’ (বুখারি, হাদিস : ২৪৪২)
রাসুল (সা.) আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব দুঃখ-কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ কিয়ামতে তার দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো সংকটাপন্ন ব্যক্তির সংকট নিরসন করবে, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় সংকট নিরসন করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দাকে সাহায্য করে থাকেন, যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা নিজ ভাইয়ের সাহায্যে রত থাকে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৯৩০)
ন্যায়সংগতভাবে বিচার-ফায়সালা করা : সমাজে কোনো বিষয়ে কোনো বিবাদ দেখা দিলে ন্যায়সংগতভাবে এর সমাধান করা ইসলামের নির্দেশ। এতে সদকার সওয়াব পাওয়া যায়। বিবাদ ফায়সালার জন্য আল্লাহর নির্দেশ, ‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমাদের ভাইদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আশা করা যায়, তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হবে।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত : ১০)
বিবাদ মীমাংসার বিষয়টি ইসলামে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমি কি তোমাদের সিয়াম, সালাত ও সদকার চেয়ে উত্তম মর্যাদাকর বিষয় সম্পর্কে খবর দেব না? সাহাবিরা বলল, অবশ্যই, হে আল্লাহর রাসুল! তিনি বলেন, ‘বিবদমান বিষয় মীমাংসা করা।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯১৯)
সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ : সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করা অন্যতম সামাজিক দায়িত্ব। সম্মিলিতভাবে এ দায়িত্ব পালন করতে হয়। এতে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন হয়। এ ব্যাপারে ইসলামের কঠোর নির্দেশ রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকতে হবে, যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে ডাকবে এবং ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায় থেকে নিষেধ করবে। তারাই হবে সফলকাম।’ (সুরা আলে-ইমরান, আয়াত : ১০৪) উপরোক্ত সামাজিক বিধান মেনে চললে আমরা একটি সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারব, ইনশাআল্লাহ।