বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৫৪ অপরাহ্ন

বঞ্চিত মানুষের ভাগ্য ঝুলে আছে সংজ্ঞার জালে

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় সোমবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০২২

বাংলাদেশের বঞ্চিত মানুষের ভাগ্য ঝুলে আছে সংজ্ঞার জালে। দেশে দরিদ্র, হত দরিদ্র ও বিপন্ন মানুষের সঠিক সংখ্যা কারো জানা নেই। কারণ এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কোন সংজ্ঞাই ঠিক হয়নি। এ প্রসঙ্গে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশে দরিদ্র কাকে বলব অথবা দরিদ্র না বললে বিপন্ন মানুষ কাকে বলব এমন স্বীকৃত মাত্রা ঠিক করা প্রয়োজন। করোনা না থাকলেও এর প্রয়োজন আছে। এ হিসাবের জন্য যে প্রাথমিক তথ্য থাকে সেটা হলো খানা জরিপ। খানা জরিপ তো চার-পাঁচ বছরের আগে হয় না। এ বছর আরো পিছিয়ে গেছে। অর্থাৎ আমাদের প্রাথমিক তথ্যের ঘাটতি আছে। সরকার এখন বহু ধরনের কর্মসূচি পরিচালনা করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব কর্মসূচির মাধ্যমে কেউ একাধিকাবার সুবিধা পাচ্ছে, আবার অনেক মানুষই এর আওতায় নেই। বাস্তবায়নকারীরা দরিদ্রের সংখ্যা ও মাত্রা জানেন না। ফলে জনসংখ্যার ভিত্তিতে টাকা দেন। এতে বিত্তশালী এলাকায় যা দেয়া হয়, দারিদ্র্যপীড়িত এলাকাও তা পায়। অর্থাৎ বড় ধরনের তথ্য ঘাটতি রয়েছে। অন্যদিকে তথ্য যেটুকু আছে, সেটিরও সঠিক ব্যবহার করা যাচ্ছে না। একটা অবিভাজ্য জাতীয় তথ্যভা-ারের প্রয়োজনীয়তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জানা গেছে, প্রকল্পের বরাদ্দ ৭২৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকার মধ্যে গত বছরের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ব্যয় হয়েছে ৬২২ কোটি ২০ লাখ টাকা। অর্থাৎ অগ্রগতির হার হচ্ছে ৮৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে এ প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে গত ছয় মাসে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ চলতি বছরের ছয় মাসে বাস্তবায়ন অগ্রগতির হার মাত্র ১৬ দশমিক ৭২ শতাংশ। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এমপি বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হয় নিশ্চয়ই কোনো কারণে। দেরি হয় সেটা অস্বীকার করছি না। তবে এর নানা কারণ থাকতে পারে। গলদ আছে, যা ধীরে ধীরে দূর হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি।
করোনা মহামারীর শুরুতে ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। তবে দরিদ্রের সঠিক তালিকা না থাকায় ১৫ লাখ পরিবারের কাছে এ অর্থ পৌঁছানো যায়নি। যদিও অতিদরিদ্রের নির্ভুল তালিকা তৈরিতে ২০১৩ সালেই একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধির পরও প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এখন প্রকল্পের কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে এলেও করোনার প্রভাবে অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে দারিদ্র্যের হারে। তাই এ প্রকল্পের আওতায় এখন পর্যন্ত যেটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা আগামীতে কাজে না আসার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফলে ৭০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের এ প্রকল্পটি থেকে পাওয়া তথ্য কোনো কাজে আসছে না বলছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তা ও কারিগরি সহায়তায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের এসএমওডিআরপিএ প্রকল্প ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ন্যাশনাল হাউজহোল্ড ডাটাবেজ (এনএইচডি) প্রকল্পের আওতায় দেশের অতিদরিদ্র মানুষের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয় সরকার। দেশের সব খানার তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিটি খানার আর্থসামাজিক অবস্থার ভিত্তিতে দারিদ্র্যের এ তালিকা করা হচ্ছে। জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশলপত্রে (এনএসএসএস) সব সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপকারভোগী নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমআইএসের মাধ্যমে এ প্রকল্পের তথ্য নেবে সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-বিভাগ।
সম্প্রতি পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিনের সভাপতিত্বে এ প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির ১৫তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার কার্যপত্র সূত্রে জানা গেছে, কয়েক দফায় সময় বাড়িয়ে নেয়া সাড়ে চার বছরের এ জরিপ প্রকল্প সাড়ে নয় বছরে গিয়ে ঠেকেছে। এ প্রকল্পের আওতায় ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবরের মধ্যে তিন ধাপে সারা দেশের দরিদ্রের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। ডাটাবেজও তৈরি আছে। তথ্যভা-ার ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) এখনো প্রস্তুত না হওয়ায় কাজ শেষ করা যাচ্ছে না। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে স্টিয়ারিং কমিটির সভায় অংশ নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রতিনিধি জানান, জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশলপত্রে (এনএসএসএস) সব সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপকারভোগী নির্বাচনে এনএইচডি ডাটা ব্যবহারের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। তবে এ প্রকল্পের তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম তিন বছর আগে সমাপ্ত হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে কভিড-১৯-এর দুর্যোগময় পরিস্থিতির কারণে মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। তাই বর্তমান পরিস্থিতি এ প্রকল্পের তথ্য ব্যবহার করা অনেক ক্ষেত্রেই উপযোগিতা হারিয়ে ফেলতে বসেছে।
জানা গেছে, ২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের এসএমওডিআরপিএ প্রকল্পের আওতায় চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান সিনার্জি ইন্টারন্যাশনাল এমআইএস তৈরির কাজ করছে। চুক্তির মেয়াদ কয়েক দফা বাড়ানোর পর গত বছরের ৩০ জুন মেয়াদ শেষ হয়েছে। তবে গত ডিসেম্বরেও এটির কাজ শেষ হয়নি।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক কাজী তোফায়েল হোসেন বলেন, এটা একটা লিংকড প্রজেক্ট। বিবিএস ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পটির ডিজাইনেই ত্রুটি ছিল। এ প্রকল্পের একটি অংশ হচ্ছে ডাটা সংগ্রহ করা। এরই মধ্যে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে বিবিএস ডাটা সংগ্রহ করেছে। কিন্তু ডাটাগুলো ব্যবহারের জন্য এমআইএস তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরকে। অধিদপ্তর এমআইএস তৈরির জন্য যে ফার্ম নিয়োগ দিয়েছিল তারা এখনো এমআইএস তৈরি করতে পারেনি, তাই এ ডাটাগুলো কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
কভিড-১৯-এর কারণে দারিদ্র্যের হার আগের চেয়ে বেড়েছে বলে একাধিক গবেষণায় উঠে এসেছে। তাই তিন বছর আগের তথ্য এখন উপযোগিতা হারিয়ে ফেলেছে কিনা এমন প্রশ্নে প্রকল্পটির পরিচালক বলেন, ‘আমরা তো ডাটা ব্যবহারই করতে পারিনি। ব্যবহার করতে না পারলে হালনাগাদ কীভাবে করব? এমআইএস কার্যক্রমটা সম্পন্ন হলে ডাটাগুলো শেয়ারিং শুরু হবে। শেয়ারিংয়ের পর যদি দেখা যায় যে এসব তথ্যের উপযোগিতা নেই, তখন আবার হালনাগাদ করার বিষয়ে ভাবব। এখন ৬২২ কোটি টাকারও বেশি ব্যয় হয়ে এ প্রকল্পের অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৮৫ শতাংশের বেশি।’
এ প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, এমআইএস তৈরির জন্য একটি বিদেশী প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা কাজ শেষ না করে মাঝপথেই চলে যায়। তাই এটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। ফলে এ প্রকল্পের পুরো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। তথ্য হালনাগাদ করা বিবিএসের কাজ। ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত চার বছর মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পায়। সে সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩২৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। প্রথম দফায় ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ে। একই সঙ্গে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৬৯৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকায়। দ্বিতীয় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৭২৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এছাড়া ব্যয় না বাড়িয়ে তৃতীয় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ এ বছরের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। তবে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ আরো দুই দফায় বাড়িয়ে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর করা হয়েছে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com