যানজট থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে দ্রুত এগিয়ে চলছে দেশের প্রথম মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ। এই প্রকল্পের উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার অংশের কাজ বলতে গেলে শেষ। চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে এই অংশে মেট্রোরেল চলাচল উদ্বোধন করা হবে। কাজ চলছে প্রকল্পের বাকি অংশেও।
প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুসারে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চলমান প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, অনুমোদিত ব্যয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। তবে মতিঝিল ছাড়িয়ে মেট্রোরেলের রুট কমলাপুর পর্যন্ত নেওয়ায় প্রকল্পের কাজ বেড়ে গেছে। সেজন্য পুরো প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করতে আরও প্রায় এক বছর বেশি সময় লাগবে। সেক্ষেত্রে মেট্রোরেল প্রকল্পটি শেষ করতে সময় লাগবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। আর খরচ হবে আরও ১১ হাজার কোটি টাকা।
এজন্য বর্তমান উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধন করছে মেট্রোরেল বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। এরই মধ্যে ডিপিপি সংশোধনের জন্য সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে পাঠানো হয়েছে। ডিএমটিসিএল সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন ছিদ্দিক জাগো নিউজকে বলেন, প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধন করতে হবে। আমরা এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিভাগে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। তারা এখন পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, প্রথমে মেট্রোরেল রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল পর্যন্ত নির্মাণ করার পরিকল্পনা ছিল। তবে সেটি মতিঝিলের পরিবর্তে কমলাপুর পর্যন্ত স¤প্রসারণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রথম পরিকল্পনা অনুসারে মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য প্রায় ২০ কিলোমিটার। আর মতিঝিল-কমলাপুর অংশটির দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার। এতে মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য দাঁড়াচ্ছে ২১ কিলোমিটারের কিছু বেশি। উড়ালপথে (এলিভেটেড) নির্মাণাধীন এ মেট্রোরেলে আগে ১৬টি স্টেশন ছিল। কমলাপুর যুক্ত হওয়ায় এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৭টিতে। এসব বাড়তি কাজ বাস্তবায়নসহ নানান খাতের কারণে প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়ছে, যার অংক ১১ হাজার ৪৮৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা। মেয়াদও বাড়বে এক বছর। ফলে সংশোধন হচ্ছে মেট্রোরেল (এমআরটি লাইন-৬) প্রকল্প।
এখন সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব (আরডিপিপি) তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে ডিএমটিসিএল। স্বল্প সময়ের মধ্যে সংশোধিত ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগে পাঠানো হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ডিপিপির দ্বিতীয় সংশোধন প্রস্তাবে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা-জাইকার ঋণ থেকে ১৯ হাজার ৬৭৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। সরকারি তহবিল থেকে ১৩ হাজার ৭৯৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। যদিও প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এখন নতুন করে যে ১১ হাজার ৪৮৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা বাড়ছে, তার মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে আসবে আট হাজার ৪০৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা এবং জাইকার ঋণ থেকে ব্যয় হবে তিন হাজার ৮১ কোটি ১১ লাখ টাকা।
অবশ্য জাইকার ঋণ বাড়ানোর জন্য এখনো অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) প্রস্তাবনা যায়নি। এ বিষয়ে ইআরডির যুগ্ম-সচিব (জাপান শাখা) মুহম্মদ আশরাফ আলী ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যয় বাড়তে পারে শুনেছি। তবে প্রস্তাব এখনো আমাদের হাতে এসে পৌঁছায়নি। ডিএমটিসিএলসহ সংশ্লিষ্টরা সিদ্ধান্ত ফাইনাল করার পরেই আমাদের কাছে আসবে। এরপর বাড়তি টাকা প্রয়োজন হলে জাপানে প্রস্তাব পাঠানো হবে।
প্রকল্পের সময়-ব্যয় বাড়া প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভাগ বলছে, মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার বাড়তি অংশে ভূমি অধিগ্রহণ, নির্মাণ এবং ই অ্যান্ড এম সিস্টেম সংগ্রহ করা হবে। পাশাপাশি ট্রানজিট অরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্টের (টিওডি) জন্য ভূমি বরাদ্দ ও নকশা তৈরি, ট্রেন পরিচালনার বিদ্যুৎ খরচ এবং এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সংগ্রহ করা হবে। এছাড়া স্টেশনে যাত্রী ওঠানামার জন্য লিফট, এস্কেলেটর ও সিঁড়ি তৈরি, ফুটপাত নির্মাণ, পরামর্শক ব্যয় এবং আনুষঙ্গিক কার্যক্রমের জন্যও ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পাশাপাশি উত্তরা সেন্টার স্টেশনকে কেন্দ্র করে একটি ট্রান্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড হাব (টিওডি) নির্মাণ, স্টেশন প্লাজাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরির জন্য নতুন করে জমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন খাতে খরচ করা হবে এ টাকা। এসব পরিকল্পনাও ছিল না প্রকল্পটির মূল ডিপিপিতে। মেট্রোরেল নির্মাণের ব্যয় বেশির পেছনে শুল্ক ও ভ্যাট খাতকে অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে ডিএমটিসিএল।
সংস্থাটি আরও বলছে, প্রকল্প ব্যয়ের একটি বড় অংশ চলে যায় বিভিন্ন পণ্য, নির্মাণসামগ্রী ও সেবা ক্রয় বাবদ সরকারকে শুল্ক-কর দিতে গিয়ে। এর বাইরে জমি অধিগ্রহণের পেছনেও একটা বড় ব্যয় হয়। সংশোধিত ডিপিপির প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রকল্পটির মোট ব্যয়ের প্রায় ২৩ শতাংশই খরচ হচ্ছে শুল্ক-কর ও জমি অধিগ্রহণ খাতে। পরামর্শক খাতেও ব্যয় বাড়বে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের যুগ্ম-সচিব (পরিকল্পনা ও পরিসংখ্যান অধিশাখা) মো. মাহবুবের রহমান জাগো নিউজকে বলেন, প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বাড়বে। এর যথেষ্ট কারণ আছে। নতুন করে মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার বাড়তি কাজ করতে হবে। এসব কারণেই মূলত ব্যয় বাড়বে। বাড়তি কাজ করতে গেলে সময়ও বাড়তি লাগবে। তবে সবকিছু এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ডিপিপি সংশোধন প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে। এরপরই কমিশন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মো. মামুন-আল-রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, মেট্রোরেল প্রকল্পের সময়-ব্যয় বৃদ্ধি সংক্রান্ত ডিপিপি এখনো আমাদের হাতে আসেনি। আমাদের হাতে আসার পর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সভা করবো। এরপরে ব্যয়-সময় বৃদ্ধির যৌক্তিকতা যাচাই-বাছাই করে একনেক (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) সভায় উপস্থাপন করা হবে।
প্রকল্পের সর্বশেষ অগ্রগতি প্রসঙ্গে ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, এমআরটি-৬ বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজের সার্বিক গড় অগ্রগতি ৭৪ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য নির্ধারিত উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে আগারগাঁও অংশের পূর্ত কাজের অগ্রগতি ৯০ দশমিক ০৮ শতাংশ। দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণের জন্য নির্ধারিত আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের পূর্ত কাজের অগ্রগতি ৭৩ দশমিক ০৮ শতাংশ। ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল সিস্টেম এবং রোলিং স্টক (রেলকোচ) ও ডিপো ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ কাজের সমন্বিত অগ্রগতি ৭০ দশমিক ৯১ শতাংশ। মতিঝিল থেকে কমলাপুর অংশে সোশ্যাল স্টাডি, হাউজহোল্ড সার্ভে, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন পরিকল্পনা, পরিবেশের ওপর প্রভাব এবং বেসিক নকশা সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে ডিটেইলড ডিজাইন ও ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলমান আছে। এসব কাজ সম্পন্ন করতেই মূলত বাড়ছে প্রকল্পের সময়-ব্যয়।-জাগোনিউজ২৪.কম