শত্রুতার বশবর্তী হয়ে নিরীহ মানুষও হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ
বেনামি অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতির ‘অনুসন্ধান’ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির মতে, অভিযোগকারী নয়; অভিযোগের বিষয়বস্তুকে গুরুত্ব দিয়ে চলছে এই অনুসন্ধান। এর ফলে ব্যক্তিগত শত্রুতার বশবর্তী হয়ে নিরীহ মানুষও সংস্থাটির কর্মকর্তা দ্বারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কমিশন প্রতিষ্ঠার দেড় যুগেও সংস্থাটির নিজস্ব সোর্স প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফলে বেনামি অভিযোগের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি বিরোধী একমাত্র প্রতিষ্ঠানটিকে। ফলে এই সীমাবদ্ধতার নির্মম শিকার হচ্ছেন অনেক নিরীহ মানুষ। তবে সংস্থাটির কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, নিরীহদের হয়রানি রোধে কারো বিরুদ্ধে দাখিলকৃত অভিযোগের চেয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্নীতির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ওপর কমিশন বেশি নির্ভর করছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতির অনুসন্ধান, মামলা দায়ের এবং তদন্ত দুদকের মূল কাজ। আইন, বিধি এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় এসব কার্যক্রম সম্পাদনের প্রক্রিয়া সুনির্দিষ্ট করা রয়েছে। তা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটি জড়িয়ে পড়ছে কিছু অনির্দিষ্ট, অনির্ধারিত বিষয় নিয়ে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে দুদকের কার্যক্রম। দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে দুদকের ‘অভিযোগ প্রাপ্তি’র বিষয়টি। দুর্নীতির বস্তুনিষ্ঠ অভিযোগ পাওয়ার মতো বিশ্বাসযোগ্য, নির্ভরযোগ্য নিজস্ব কোনো উৎস নেই দুদকের। নির্ভর করতে হচ্ছে বেনামি অভিযোগের ওপর। নাম-পরিচয় গোপন কিংবা মিথ্যা পরিচয়ে যে কেউ যে কারো বিরুদ্ধে দুদকে দাখিল করছে অভিযোগ। তফসিলের আওতায় পড়লেই অবৈধ সম্পদ অর্জনের কথিত সেই অভিযোগের পেছনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে দুদক। কমিশনের ‘অনুমোদনপত্র’ গেঁথে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চিঠি লেখা হচ্ছে তথ্য-উপাত্ত চেয়ে। সেই সঙ্গে চলে সংবাদ মাধ্যমে ফলাও প্রচার। দেশের অন্যান্য সংস্থা অনুসন্ধান-তদন্ত চালালেও সেটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া কেউ টের পান না। কিন্তু দুদক অনুসন্ধানে নামলে সেটি যেন মিডিয়ায় প্রচার পেতে বাধ্য।
গোপন কাজটি করা হয় প্রকাশ্যে। এর ফলেচূড়ান্ত পর্যায়ে দুর্নীতি প্রমাণ হোক কিংবা না হোকÑ একটি মিডিয়া ট্রায়াল দুদক আগেই করে ফেলে। এ ক্ষেত্রে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পান না। তার সাংবিধানিক এবং আইনগত অধিকার মারাত্মক রকম ক্ষুণ্ন হয়। যেটির আর্থ সামাজিক ক্ষত অনেক গভীর। কথা হয় দুদক দ্বারা সা¤প্রতিক সময়ে নির্যাতিত কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে। একজন ব্যবসায়ী জানান, তার প্রতিষ্ঠানের সাবেক হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় অত্র প্রতিষ্ঠানে তিনি কত টাকা বেতন পেতেন, তার সেলারি শিট, সার্ভিস বুক, বেতন কাঠামো ইত্যাদি চেয়ে চিঠি দেয়া হয়। তাকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরিণতিতে সাবেক ওই হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তার কথাবার্তা সব ঠিকঠাক হওয়ার পরও মেয়ের বিয়েটা ভেঙে যায়। অন্যদিকে যে প্রতিষ্ঠানে তিনি এখন চাকরি করেন না সেই প্রতিষ্ঠানের নাম নেতিবাচকভাবে গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। যা ওই ব্যবসায়ীর ব্যবসায় বিরূপ প্রভাব ফেলে।
একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস সহায়ককে কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে কারণদর্শানো হয়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওই অফিস সহায়ক অভিযোগ করেন দুদকের ‘১০৬’ নামক হটলাইনে। বলা হয়, এখানে আউট সোর্সিংয়ের জনবল নিয়োগে ভয়াবহ রকম দুর্নীতি হচ্ছে। কোটি কোটি টাকার লেনদেন। ঘণ্টা দুইয়ের মধ্যে বিশেষ ধরনের জ্যাকেট পরিহিত দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযোগকারীর দফতরে হাজির। খুন-খারাবির মতো বড় ধরনের কিছু একটা ঘটে গেছেÑ এমন ভাব নিয়ে ওই সরকারি অফিসের প্রতিটি কক্ষে তল্লাশি চালানো হয়। টেবিলের ড্রয়ার, আলমিরা তন্ন তন্ন করা হয়। সার্চ করা হয় কম্পিউটার। ঘণ্টা ২ ধরে তা-ব সৃষ্টি করে টিমের সদস্যরা ওই সময় কর্মরত ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা ফোন নম্বর নিয়ে আসেন। টিমের সদস্যরা তাদের পিয়ন-কনস্টেবল দিয়ে ওই অফিসের কর্মরতদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদের বিরুদ্ধে মামলার ভয় দেখান। এক পর্যায়ে তারা সাক্ষাৎ করেন। অর্থের বিনিময়ে সমঝোতায় পৌঁছায়। পরে টাস্কফোর্স এই মর্মে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল হয় যে, ওখানে কোনো দুর্নীতি হয়নি। জনবল নিয়োগের বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
দুদক সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানালেন এক নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের মালিক। একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক অঙ্কের টাকা। এই টাকার বড় একটি অঙ্ক জমা পড়েছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের মালিকের স্বাক্ষরিত চেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যাংকটির এমডি’র বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ আনা হয়। অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের মালিককেও চিঠি দেয়া হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়। এক পর্যায়ে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট জব্দের আবেদন জানান দুদক কর্মকর্তা। বাহবা নেয়ার লোভে প্রতিটি পর্যায়ে বিষয়টি রাষ্ট্র করে দুদক। ফলশ্রুতিতে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো এই নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে গড়িমসি করে। পাইপলাইনে থাকার পরও ব্যাংক ঋণটি তিনি আর পাননি। কয়েকশ’ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন ওই নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের মালিক। বিগত কমিশনের মেয়াদে এমন ঘটনা ঘটেছে বহু। বিশ্লেষকদের মতে, দুদক দুর্নীতি দমনে কাজ করবেÑ এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে যদি বাড়াবাড়ি হয় তাহলে এটি জাতীয় অর্থনীতি, ব্যাংকিং, শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। সর্বক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই দুর্নীতিবিরোধী লড়াই। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে যদি সমন্বিত কৌশল প্রয়োগ করা না হয়। যদি তালিকা প্রণয়ন করে ভীতির সঞ্চার করা হয় তাহলে হিতে বিপরীত হতে বাধ্য। শিল্প ও অর্থনীতিও কলাপস করবে। তাই হুজুগের উন্মাদনায় গা না ভাসিয়ে মানুষ দুদকের কাছে দায়িত্বশীল এবং সতর্ক আচরণ আশা করে। না হলে জাতীয় জনমত দুদকের বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে।
দুদকের মিথ্যা তথ্যেও নেই প্রতিকার : মিথ্যা তথ্য দিয়ে হয়রানির অপরাধে কারাভোগ করার মতো অপরাধ দুদক বহু আগেই সংঘটিত করেছে। বিশেষ করে সালেকের কৃত অপরাধে জাহালমকে কারাগারে পাঠানোর ঘটনা উচ্চ আদালত দ্বারাই প্রমাণিত। এখন শুধু কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিকার চাইলেই সংস্থাটির বর্তমান নেতৃত্বকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব। কিন্তু সেটি করা হয়নি। আইনজ্ঞদের মতে, এ কাজটি করার জন্য ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪’র ২৮(গ) ধারাই যথেষ্ট। ‘মিথ্যা তথ্য প্রদানের দ-’ সংক্রান্ত এই ধারায় বলা হয়েছে (১) মিথ্যা জানিয়া বা তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত না হইয়া কোনো ব্যক্তি ভিত্তিহীন কোনো তথ্য, যে তথ্যের ভিত্তিতে এই আইনের অধীন তদন্ত বা বিচার কার্য পরিচালিত হইবার সম্ভাবনা থাকে, প্রদান করিলে তিনি মিথ্যা তথ্য প্রদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।’ ২৮(গ) এর (১) উপ-ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত কোনো মিথ্যা তথ্য প্রদান করিলে তিনি একই ধারার অধীন অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে এবং উক্ত অপরাধের জন্য তিনি অন্যূন ২ (দুই) বৎসর বা অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর সশ্রম কারাদ- বা অর্থদ- বা উভয় দ-ে-দ-িত হইবেন।’ একই ধারার (৩) উপ-ধারায় বলা হয়েছে, ‘তথ্য প্রদানকারী কমিশনের বা সরকারি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী হইলে এবং তিনি উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত কোনো মিথ্যা তথ্য প্রদান করিলে তাহার বিরুদ্ধে উপ-ধারা (২) এ উল্লিখিত দ- প্রদান করা হইবে।’ দুদকের অনেক কর্মকর্তাকেই এ ধারায় জবাবদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব। কিন্তু কমিশন প্রতিষ্ঠার পর আইনের এ ধারাটির ব্যবহার হয়েছে কদাচিৎ। সেটিও ব্যবহৃত হয়েছে দুদকের বাইরে, ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে। যেমন সর্বশেষ মিথ্যা তথ্য দিয়ে মামলা করার অপরাধে ২০২০ সালে সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। গতবছর ১ নভেম্বর মামলাটির চার্জশিট হয়েছে। তাতে সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঘুষ দাবির অভিযোগ আনা হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ২৮(২) ধারা প্রয়োগ করা হয়েছে মামলাটিতে। কিন্তু দুদকের সাবেক আইনজীবী ব্যারিস্টার আকবর আমীনের মতে, আইনের এ ধারাটি দুদক কর্মকর্তাদের জন্যও প্রযোজ্য। কারণ দুদক প্রতিষ্ঠার ১৮ বছরে আইনের এই ধারাটি খুব একটা ব্যবহার করেনি। ধারাটি যদি অপ্রয়োজনীয়ই হতো তাহলে একাধিকবার দুদক আইন সংশোধন করা হলেও ধারাটি বাদ দেয়া হলো না কেন? আইনটির অপরিহার্যতা রয়েছে বলেই ২৮(গ) (১), (২), (৩) রেখে দেয়া হয়েছে। ধারাটি রাখা হয়েছে দুদকের কর্মকর্তা এবং কমিশনকে আইনের আওতায় আনার লক্ষ্যেই। আইনটির যথাযথ প্রয়োগ হলে দুদকের অনেক কর্মকর্তাকেই কাঠগড়ায় উঠবেন। কারণ তারাই অনেক নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করেন, চার্জশিট দেন। যা বিচারে পরে প্রমাণিত হয় না। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাটি মিথ্যা। মিথ্যা দায়েরের অভিযোগে দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ২৮(২) ধারায় পাল্টা মামলা হতে পারে। তিনি বলেন, দুদক আইনে বাড়াবাড়ির কোনো সুযোগ নেই। যদি করা হয় সেটির প্রতিকার দুদক আইনেই রয়েছে। ২৮ (গ) ধারায় দুদক কর্মকর্তাদেরও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যেতে পারে। মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধান, মামলা, তদন্তের নামে হয়রানি, মিথ্যা চার্জশিট দাখিল করলে উক্ত ধারায় উল্লেখিত শাস্তি পতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকেও। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পীস ফর বাংলাদেশ’র প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, এ আইনে কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি দুদকের যেকোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রতিকার চাইতেই পারেন। মিথ্যা অভিযোগ কিংবা মামলার শিকার হলে ২৮(গ) ধারার আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। তবে এ বিষয়ে ভিন্ন কথা বলছেন দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান। তিনি বলেন, জাহালমের মতো ঘটনায় ২৮ (গ) ধারা প্রযোজ্য হবে না। আইনের ৩১ ধারায় দুদককে ইনডেমনিটি দেয়া আছে। সরল বিশ্বাসে করা কাজের জন্য শাস্তি পেতে হবে না। দুদক যখনই জাহালমের ঘটনাটি অবহিত হলো সঙ্গে সঙ্গে তাকে অব্যাহতি দিয়েছে। (-দৈনিক ইনকিলাব)