১৭৫০ খ্রিস্টাব্দে রুশো আক্ষেপ করে বলেছিলেন, মানুষ স্বাধীন সত্তা হিসেবে জন্মগ্রহণ করলেও সে তার সর্বত্র শৃঙ্খলাবদ্ধ।Fundamental rights, basic human rights. স্লোগান না যত চমকপ্রদ, তার চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক, মনুষ্যত্বহীনতা, মানবিকতা, পাশবিকতার বিকৃত বাস্তবতা নিয়ে নাগরিকরা সময় অতিবাহিত করছে।
সম্প্রতি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ ও ছয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বেনজীর আহমেদ বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক (আইজিপি)। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর জানিয়েছে, মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনের জন্য গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি নিষেধাজ্ঞা কর্মসূচির অধীনে দেশটির ট্রেজারি বিভাগ, র্যাব, বেনজীর আহমেদ ও অন্য ছয় কর্মকর্তাকে এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় এনেছে।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মতো মূল্যবোধকে সামনে রেখে বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাসহ যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটিকে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তনের পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে বাইডেন প্রশাসনের কৌশলগত অবস্থান হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে এ নিষেধাজ্ঞা আরো বাড়তে পারে। এতে উদ্বিগ্নতা-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে আওয়ামী লীগের মধ্যে চরমভাবে।
শুধু তাই নয়, সরকারের উচ্চপদস্থ এসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা মানে হচ্ছে তাদের মানসিক শক্তিকে দুর্বল করা। যাতে করে গুম, খুন, ক্রসফায়ার এবং রাজনৈতিক মতের ওপরে বল প্রয়োগ বন্ধ হয়। দেশের বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি যদি অন্যায়ভাবে হামলা-মামলা, গুম, খুন, ক্রসফায়ার ও বল প্রয়োগের মুখোমুখি থেকে মুক্ত হয়ে রাজপথে গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের লড়াই করতে পারে, তাহলে সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে পড়বে।
তাছাড়া গত বছর গণতন্ত্র সম্মেলন থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। মানবাধিকার দিবসে বিশেষ বাহিনী র্যাব ও কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। একইসঙ্গে লেখক অভিজিত রায়ের পলাতক খুনিদের তথ্যের জন্য ৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছে দেশটি।
মূলত পৃথিবীতে মৌলিক অধিকার ব্যতীত মানুষ স্বাধীনভাবে সম্মানের সাথে বসবাস করতে পারে না। জাতি, ধর্ম, গোত্র, বর্ণ সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু রাষ্ট্র যখন নাগরিক অধিকারের বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন মানুষের রক্ষা করবে কে?
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, সভা-সমিতি করার স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার, স্বাধীনভাবে ধর্মকর্ম পালন করার অধিকার, আইনের সুশাসন, ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, জীবিকা অর্জন, সম্পত্তির অধিকার ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে চাহিদা পূরণের অধিকার এ সবকিছুই মানুষের সাংবিধানিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার সুরক্ষা দেয়। এর কোনো কিছুই মানুষের প্রতি কারো করুণা নয়, সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার।
মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, মূল্যবোধ এবং চলাফেরার স্বাভাবিক অধিকার যখনই নষ্ট হয়, তখন মানুষ তার প্রকৃত নাগরিক অধিকার থেকেই শুধু বঞ্চিতই হয় না, বরং যে অথবা যারা এটিকে বাধাগ্রস্ত করে, মৌলিক অধিকার হরণ করে, তারা জঘন্যতম অপরাধে অপরাধী হয়ে পড়ে।
অর্থাৎ মানুষের প্রকৃতিগত চাহিদা ও মর্যাদা স্বাধীনতা, সমতা ও সমৃদ্ধি ইত্যাদি অধিকারের কথা ব্যক্ত করে থাকে। মানুষের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা করা রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের শপথেরই অংশ। এটি লঙ্ঘন শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
বাংলাদেশের র্যাব ও এ বাহিনীর বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার সময়সাপেক্ষ এবং জটিল হবে ধারণা করছেন মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সামনে রেখে দেয়া এ বিধিনিষেধ প্রত্যাহারে বাংলাদেশ সরকারের নানামুখী তৎপরতা চালাতে হবে।
কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত ১২ ডিসেম্বর মার্কিন এই সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এর পেছনে ‘বাংলাদেশবিরোধী কিছু ব্যক্তি ও অপশক্তির’ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। অর্থাৎ তিনি জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট এই বিষয়টি সমাধানের চেয়ে একে রাজনীতিকরণের দিকে ঠেলে দিয়ে অপরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছেন।
বিরোধী মতের রাজনীতিকরাও অবশ্য সরকারের পেশিশক্তির ব্যবহারের কারণেই এ নিষেধাজ্ঞা বলে দাবি করছেন। পাশাপাশি অনেকের ভিন্নমতও আছে বাংলাদেশের সকল মানুষের সামনে এটি একটি জাতীয় সমস্যা। আর জাতীয় সমস্যা জাতীয়ভাবে সবাইকে নিয়ে সমাধান করতে হয়। আর সেটা তখনই সম্ভব, যখন দেশ একটি গণতান্ত্রিক সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রহীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নতুন নয়। বর্তমান সরকারের শুরু থেকেই এ অভিযোগ হয়ে আসছে এবং তা ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে প্রবলতর হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, নির্বাচন কমিশনসহ সব প্রতিষ্ঠান সরকারের কুক্ষিগত হয়েছে। সেখানে বসানো হয়েছে অনুগত লোকদের। তারা যা ইচ্ছে তাই করছে। কোনো কিছুরই জবাবদিহি নেই কোথাও। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হওয়াসহ সব অপরাধ ব্যাপকতর হয়েছে।
মানবাধিকার রক্ষা করার জন্য দেশ-বিদেশের প্রায় সব মানবাধিকার সংগঠন বার বার আহ্বান জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান নিচে দেখানো হয়েছে। উপরন্তু কোনো কোনো রিপোর্টে বলা হয়েছে, হাইব্রিড গণতন্ত্র, কর্তৃত্ববাদী সরকার ইত্যাদি। তবু পরিস্থিতির বিন্দুমাত্র উন্নতি হয়নি। বরং ক্রমাবনতি হয়েছে। গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা মানববন্ধন করেছেন, তাদের স্বজনদের ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। কবর কোথায় দেওয়া হয়েছে জানতে চেয়েছেন, যাতে তারা গিয়ে কবর জিয়ারত করতে পারেন। গুম হওয়া ব্যক্তিদের কিছু ফেরত এসেছে। কিন্তু তাদের কেউই মুখ খোলেননি। কিন্তু ৫০ বছর ধরে স্বাধীন একটি দেশে। মানবাধিকারের এই পরিস্থিতি কেন চলমান?
যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের সেরা শক্তিধর। এটা আর্থিক, সামরিক, উদ্ভাবন তথা সব দিক দিয়েই। অবশ্য কতিপয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অভিমত, বর্তমানে সবচেয়ে বেশি শক্তিধর চীন। তারপর যুক্তরাষ্ট্র। শক্তির দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম হোক আর দ্বিতীয়ই হোক, তা বিবেচনার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বিশ্বে এখনো প্রভাব বেশি যুক্তরাষ্ট্রের। এমনকি সেটা জাতিসংঘে পর্যন্ত।
সংস্থাটি চলে সদস্যদের চাঁদায়, যার প্রায় অর্ধেক দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপেরও প্রায় সব দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সখ্য সর্বাধিক। বাংলাদেশের রফতানি মূলত গার্মেন্ট, যার অধিকাংশই যায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে সর্বাধিক সদস্য রয়েছে বাংলাদেশের। এ খাতেও দেশের প্রচুর অর্থ আয় হয়।
বাংলাদেশের আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রে সর্বাধিক হচ্ছে জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশগুলোর। ঋণের ক্ষেত্রেও তদ্রƒপ। তাই যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতার কারণে এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংকট সৃষ্টি হতে পারে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের খুবই ঘনিষ্ঠতা রয়েছে চীন ও ভারতের সাথে। ঋণ প্রদান ও উন্নয়ন কর্মে সহায়তার ক্ষেত্রে চীন সর্বাধিক। এ নিয়ে ভারত প্রায়ই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র সৃষ্ট নবতর সংকট থেকে উত্তরণের প্রধান উপায় হলো জাতীয় ঐক্য। তাই দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় জোর তৎপরতা চালাতে হবে। দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে কার্যকর গণতন্ত্র।
কিন্তু দেশে কার্যকর গণতন্ত্র কায়েম করতে হলে প্রথমে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন, যা চলমান সরকারের আমলে আর সম্ভব নয়, তা নির্বাচন কমিশন গঠনের নতুন আইন দেখেই বোধগম্য হয়।
কিন্তু জনগণ এ অচলবস্থা থেকে মুক্তি চায়, যার স্বরূপ পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে তুমুল জন আন্দোলন গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে নির্বাচন-পূর্ব সময়ে। শুধু সঠিক নেতৃত্বের অভাব এবং ভালো বিকল্প না থাকায় জনআন্দোলন গড়ে উঠছে না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
এক্ষেত্রে কোনো কোনো দল তাদের ব্যক্তিগত ও দলীয় ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত থাকায় জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। কিন্তু ছোট ছোট অনেক রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপ পরিহার করে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।
অনেকে মনে করছেন, বড় রাজনৈতিক দলগুলো যদি আগামী জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারে, তাহলে জনগণ ৩য় বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হবে। কারণ এদেশের মানুষ কখনো অন্যায়-অবিচার,?স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক শক্তির কাছেরনি।
Dr. D. P. khanna-এর কথা দিয়ে শেষ করতে চাই। তিনি বলেছেন, The most startling feature of the concept of Human rights is that it is so easy to understand. so difficult to define add impossible to ignore.
অর্থাৎ “মানবাধিকার ধারণাটির অত্যন্ত চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হলো, ইহা বোঝা অত্যন্ত সহজ, সংজ্ঞায়িত করা অত্যন্ত কঠিন এবং অবজ্ঞা করা অসম্ভব।” লেখক: গবেষক, সাংবাদিক, স্থায়ী সদস্য ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন