ইসলামী শরিয়তের উদ্দেশ্য কী? দ্বাদশ শতাব্দীর ইমাম আবু হামিদ আল-গাযালী র:-এর মতে, ইসলামী শরিয়তের উদ্দেশ্য হলো কল্যাণকর সব কিছুর সহায়তা করা এবং যাবতীয় অকল্যাণ দূর করা। (আল-মুশতাশফা মিন ইলমিল উসূল, পৃ. ১৩৯-৪০) বিশ শতকের আলেম মুহাম্মাদ আত-তাহির ইবনে আসুরের মতে, ইসলামী শরিয়াহর উদ্দেশ্য হলো মানবতার কল্যাণ সাধন করা (Treaties on Maqasid-e-Shari’ah, P. 91). আমাদের কালের ইমাম ড. ইউসুফ আল-কারদাভীর মতে, শরিয়তের লক্ষ্য হলো কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং অকল্যাণ দূর করা। (ফিক্বহুয়-জাকাত, পৃষ্ঠা-৩১)
শরিয়তের অনুসরণ করা কি বাধ্যতামূলক ? কুরআন মজিদের সূরা আহজাবের ৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোনো মুমিন পুরুষ কিংবা কোনো মুমিন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার থাকবে না।’ অর্থাৎ শরিয়তের পূর্ণ অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক।
শরিয়তের অনুসরণ না করলে কী হবে? জন্ম যখন হয়েছে মৃত্যু তখন অবধারিত। কুরআনে পৌনঃপুনিকভাবে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেককেই মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে।’ (আলে-ইমরান : ১৮৫, আম্বিয়া : ৩৫, ‘আনকাবুত : ৫৭) ‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন মৃত্যু তোমাদের হানা দেবেই, এমনকি দুর্গম দুর্গে আশ্রয় নিলেও।’ (সূরা নিসা-৭৮) ‘বলো (হে নবী), তোমরা যে মৃত্যুর কবল থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে বেড়াচ্ছ সেই মৃত্যু অবশ্যই একদিন তোমাদের সামনে এসে দাঁড়াবে। তারপর তোমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে ‘আলিমুল গাইব ওয়াশ্ শাহাদাহ-এর আদালতে এবং বুঝিয়ে দেয়া হবে তোমাদের কৃতকর্মের হিসাব। (জুমু’আ-৮) সেই সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার কাছে ফিরে যেতে হলে, তাঁর মুখোমুখি দাঁড়াতে হলে কী করতে হবে সেটা তিনি নিজেই জানিয়ে দিয়েছে। বলেছেন : ‘কেউ তার রবের সাক্ষাতে যেতে চাইলে সে যেন ভালো হয়ে যায় । (‘আমল-ই-সালেহ করে)’ (কাহফ-১১০) এই ভালো হয়ে যাওয়ার মানে হলো, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা যেভাবে করতে বলেছেন তা সেভাবেই করা, আর যা যা করতে নিষেধ করেছেন তা তা থেকে বিরত থাকা। যদি তা না করা হয় তবে কী হবে সে কথাও তিনি বলেছেন, ‘কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করলে সে তো স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে।’ (আহজাব-৩৬)
আল্লাহ কি তাহলে শরিয়াহ পরিপালন তদারক করেন? প্রশ্ন উঠতে পারে, দুনিয়ার জীবনে একজন মানুষ শরিয়ত অনুসরণ করছে কি করছে না; পরকালে তা নির্ধারণ করা হবে কিভাবে? আল্লাহ কি তাহলে সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই বান্দাকে শাস্তি দেবেন? উত্তর হবে, অবশ্যই না। যদিও ‘আলেমুল গাইব ওয়াশ্-শাহাদাহ হিসেবে কাউকে শাস্তি বা পুরস্কার দেবার জন্য তাঁর কোনো তথ্য-প্রমাণের প্রয়োজন নেই, তবুও চূড়ান্ত ফয়সালার দিনে সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে শাস্তি দেবেন অথবা মাফ করে দেবেন এবং পুরস্কৃত করবেন। তিনি বলছেন, প্রত্যেক মানুষের কর্ম আমি তার গ্রীবা লগ্ন করেছি এবং কিয়ামতের দিন আমি তার জন্য বের করব এক উন্মুক্ত বিবরণ। (এবং বলব), তুমি তোমার কর্মের বিবরণ পাঠ করো, আজ তুমি নিজেই তোমার বিচারের জন্য যথেষ্ট। (সূরা বনি ইসরাঈল : ১৩-৪) এই বিবরণ এক দিনে বা এক মুহূর্তে কোনো করনিক তৈরি করবে না। এটা হবে Spot Record- তাৎক্ষণিকভাবে ধারণকৃত বিবরণ। এ জন্য প্রত্যেক মানুষের উভয় পাশে নিয়োজিত রয়েছে সার্বক্ষণিক হিসাব রক্ষক (Book Keeper). আল্লাহ তায়ালা বলছেন, দু’জন হিসাবরক্ষক তার ডানে ও বাঁয়ে বসে তার কর্মের ধারাবিবরণী লিখছে; মানুষ যা-ই উচ্চারণ করে তা রেকর্ড করার জন্য এ দু’জন Recorder (রাক্বীব) সদা তৎপর রয়েছে। (সূরা ক্বাফ : ১৭-৮)
কিয়ামতের দিন যখন এসব অডিও এবং ভিডিও রেকর্ড সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সামনে পেশ করা হবে তা দেখে সে স্তম্ভিত ও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে। কুরআনে ওই মুহূর্তের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে এভাবে : আমলনামা হাজির করা হবে। তুমি দেখবে, আমলনামার বিষয়বস্তু জেনে অপরাধীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। তারা আর্তনাদ করে বলবে, দুর্ভাগ্য! এ কেমন বিবরণ! এতে দেখছি ছোট বড় কোনো কর্মই বাদ যায়নি, সবই রেকর্ড করা হয়েছে! বস্তুত ওরা ওদের সমস্ত কৃতকর্মই তাতে দেখতে পাবে। কারণ তোমার রব কারো প্রতি জুলুম করেন না। (সূরা কাহফ-৪৯)
অপরাধী বান্দার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও : প্রচলিত আদালতে যেমন আসামি শাস্তি এড়াবার জন্য অপরাধ করেও তা অস্বীকার করে থাকে, কিয়ামতের দিনও পাপী বান্দা তার কৃতকর্ম অস্বীকার করবে। তখন আহকামুল হাকেমিন হাজির করবেন এক অ-প্রচলিত (Unconventional) ও অনস্বীকার্য (Undeniable) সাক্ষ্য, যা অস্বীকার করার কোনো উপায়ই থাকবে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলছেন, ‘আমি আজ ওদের মুখে কুলুপ এঁটে দেবো। এখন আমার সাথে কথা বলবে ওদের হাত, ওদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য ওদের পদযুগলই দেবে।’ (সূরা ইয়াসিন-৬৫) ‘পরিশেষে, ওরা যখন জাহান্নামের দোরগোড়ায় পৌঁছবে তখন ওদের কান, ওদের চোখ এবং ওদের গায়ের চামড়া ওদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেবে, ওদেরই বিরুদ্ধে।’ (হা-মিম-আস-সাজদাহ-২০) সাক্ষ্য-প্রমাণ ও যুক্তি-তর্ক শেষে আহকামুল হাকেমিন রায় ঘোষণা করে বলবেন, জাহান্নামই তোদের বাসস্থান, ওটাই তোদের স্থায়ী ঠিকানা। (সূরা আন’আম-১২৮)
দুনিয়ায় শান্তি ও পরকালীন মুক্তির উপায়: কী করলে দুনিয়ায় শান্তি ও পরকালে মুক্তি মিলবে সে পথও আল্লাহ তায়ালা বাতলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না তথা আমার কাছে এসো না। (আলে-ইমরান : ১০২) শুধু নামকা ওয়াস্তে মুসলমান হলেই হবে না, পরিপূর্ণ মুসলমান হতে হবে। (সূরা বাকারাহ-২০৮) পরিপূর্ণ মুসলমান মানে শরিয়তের পরিপূর্ণ অনুসরণ। শরিয়তের কিছু বিধান মানি, কিন্তু এমন কিছু বিধান শরিয়তে আছে যা মানলে তেরশ’ বছর পিছিয়ে যাবো- এমন যারা মনে করে তাদের একমাত্র প্রতিফল হলো, দুনিয়ার জীবনে তারা লাঞ্ছিত হবে আর পরকালে পাবে কঠিন শাস্তি। (সূরা বাকারাহ-৮৫) যদি আমরা সত্যি সত্যিই ঈমান আনি এবং ভালো হয়ে যাই তবে আল্লাহ ওয়াদা দিয়েছেন যে, তিনি আমাদের মাফ করে দেবেন এবং পুরস্কৃত করবেন। (সূরা ফাতহ-২৯)
শরিয়তের অনুসরণে পার্থিব লাভ: শরিয়তের অনুসরণ তথা ইসলামী জীবনাচরণের পুরস্কার শুধুমাত্র পরকালের জন্য তোলা থাকবে তাও নয়। শরিয়তের অনুসরণ করলে আল্লাহ দুনিয়ার জীবনটাও সুন্দর করে দেবেন। (সূরা নাহল-৯৭) আচরণ সুন্দর হয়ে যাবে। (আহজাব : ৭০-৭১) সমাজের মানুষ সম্মান করবে। (সূরা ফাতির-১০) আপনি যদি চাকরিজীবী হন- আপনার Career Progression হবে। আপনি যদি ব্যবসায়ী হন- আপনার দোকানের কাস্টমার বেড়ে যাবে, আপনার পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। আপনি যদি রাজনীতিবিদ হন- আপনার ভোট বেড়ে যাবে। আপনার চার পাশে চোখ মেলে তাকালে এর প্রমাণও পেয়ে যাবেন।
শরিয়তের অনুসরণ কি খুব কঠিন কাজ? না, এটা কোনো কঠিন কাজ নয়। আর পাঁচটা সদাভ্যাসের মতো এটাও একটা সদাভ্যাস মাত্র। এর জন্য শুধু দরকার তাক্বওয়া-আল্লাহকে যেভাবে ভয় করা উচিত সেভাবে ভয় করা। (সূরা আলে-ইমরান-১০২) তবেই তিনি আপনার কাজ সহজ করে দেবেন। (সূরা ত্বালাক-৪) কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বান্দার ওপর সাধ্যাতীত কিছু চাপিয়ে দেবার পক্ষপাতি নন। (সূরা বাকারা-২৮৬) তিনি বান্দার জন্য শরিয়তের অনুসরণকে সহজ করতে চান- কঠিন করতে নয়। (সূনরা বাকারা-১৮৫, সূরা মায়েদা-৬)
শেষ কথা : শরিয়ত শুধু নিকাহ-তালাকের বিষয় নয়: প্রায় দুইশ’ বছরের ব্রিটিশ-গোলামির ফলে এ অঞ্চলের মুসলমানদের অবস্থা দাঁড়িয়ে ছিল এই যে, তারা শরিয়ত বলতে বুঝেছে নিকাহ ও তালাকের ধর্মীয় বিধান। আল্লাহ তায়ালার অসীম করুণায় বিশ^ব্যাপী দুর্বার গতিতে ছড়িয়ে পড়া ইসলামিক ফাইন্যান্সের বদৌলতে ‘শরিয়ত’ শব্দটি নিকাহ-তালাকের বন্ধনী ভেদ করে আজ করপোরেট দুনিয়ায় জায়গা করে নিয়েছে। এখন ‘ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক পরিচালিত’ এই শব্দমালা শুদ্ধতার একটি প্রতীকে পরিণত হয়েছে। যাদের অপরিসীম ত্যাগ ও কোরবানির বিনিময়ে মুসলিম সমাজের সর্বত্র ‘শরিয়ত’ আবার ফিরে এসেছে আল্লাহ তায়ালা তাদের সবাইকে দুনিয়া ও আখিরাতে পূর্ণ প্রতিদান দিন! আসুন, আমরাও আমাদের জীবনকে ‘ইসলামী শরিয়াহ মোআবু নুসাইবা মুহাম্মাদ নূরুন্নবীতাবেক পরিচালিত’ করি। কারণ, শরিয়া অনন্য সুন্দর জীবনের জন্য। লেখক: সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার, পূবালী ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং