অভিবাসী শ্রমিক ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা মালয়েশিয়ার অর্থনীতি একসময় উন্নয়ন গবেষকদের আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছিল। এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর মধ্যে আলাদা করে আলোচনার দাবিদার হয়ে উঠেছিল দেশটি। তবে মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেশটির অর্থনীতির গোটা মডেলকেই পতনের মুখে ফেলে দিয়েছে। আর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় সে পতন হয়ে উঠছে ত্বরান্বিত। যদিও দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে বলা হচ্ছে, সংকোচনের ফাড়া কাটিয়ে গত প্রান্তিকেই প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরেছে মালয়েশিয়া। এ পরিসংখ্যান সামনে এনে নীতিনির্ধারকরা নানাভাবে আশ্বস্ত করার চেষ্টা চালালেও উল্টো কথা বলছেন দেশটির অর্থনীতির পর্যবেক্ষকরা।
প্রবৃদ্ধির সংখ্যাতাত্ত্বিক উপস্থাপনাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে তারা বলছেন, বিদেশী বিনিয়োগ ও উৎপাদন খাতনির্ভর অর্থনৈতিক মডেল কভিডকালে মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। যেকোনো দেশে অর্থনীতির স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির অন্যতম বড় শর্ত ধরা হয় শক্তিশালী ভোক্তা খাতকে। আর এ ভোক্তা খাতের প্রধানতম অংশ হলো মধ্যবিত্ত। মালয়েশিয়ার এ মধ্যবিত্ত শ্রেণীই এখন অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক দুর্বল হয়ে পড়েছে। মহামারীকালীন অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনায় আর্থিক সক্ষমতা হারিয়ে শ্রেণীটি এখন ধুঁকছে। পরিস্থিতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর মতো সঞ্চয়ও নেই তাদের হাতে। আবার এ অব্যবস্থাপনার কারণেই মালয়েশিয়া ছাড়ার হুমকি দিচ্ছেন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। অভিবাসী শ্রমিকদের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে দেশটির শিল্পোৎপাদন, আবাসনসহ নানা খাত। কিন্তু এ প্রবাসীদের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান অমানবিক আচরণ কভিডকালে মালয়েশিয়ার নিজের জন্যই বুমেরাং হয়ে দেখা দিয়েছে। পুরোদস্তুর অর্থনৈতিক এসব বিপত্তিকে এখন আরো মারাত্মক করে তুলছে চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। পার্লামেন্টে এমপিরা যখন-তখন দলবদলের মাধ্যমে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকেই অকার্যকর করে তুলেছেন। দেশটিতে ১৮ মাসের মধ্যে সরকার বদলেছে দুবার। বর্তমানে ক্ষমতাসীন ইসমাইল সাবরি ইয়াকুবের নেতৃত্বাধীন সরকারও এখন নড়বড়ে অবস্থানে। ভেঙে পড়েছে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাও। দেশটির অর্থনীতিতে জ্বালানি খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান পেট্রোনাস নাসিওনাল বারহাদও মহামারীকালে স্থিতিশীল পারফরম্যান্স দেখাতে পারেনি। সব মিলিয়ে দেশটির অর্থনীতি এখন দীর্ঘমেয়াদি এক বিপত্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
কভিডের প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই চরম দুর্দিনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে মালয়েশিয়ার অর্থনীতি। ২০২০ সালে দেশটির অর্থনীতিতে সংকোচন হয়েছিল ৬ শতাংশের কাছাকাছি। গত বছর সংকোচনের ধারা থেকে বেরিয়ে এলেও অর্থনৈতিক শ্লথতা কাটানো সম্ভব হয়নি বলে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ব্যাংক নেগারা মালয়েশিয়ার (বিএনএম) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশটির অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ শতাংশের সামান্য বেশি। আবার তাতে ধারাবাহিকতাও তেমন একটা ছিল না। বছরের শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) মালয়েশিয়ার অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির দেখা পেলেও সংকুচিত হয়েছিল আগের প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর)। বিএনএমের প্রতিবেদনে চলতি বছরেই মালয়েশিয়ার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হলেও স্থানীয় একটি সংবাদমাধ্যমে একে উল্লেখ করা হয়েছে চিনির প্রলেপ মাখানো উন্নয়নের গল্প হিসেবে।
মহামারীকালীন ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকে মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক বিপত্তির বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, কভিডের সংক্রমণ প্রবাহ একটু বাড়লেই সংকোচনের ধারায় নেমে আসছে অর্থনীতি। এখন পর্যন্ত দেশটির স্থানীয় নাগরিকদের প্রায় ৮০ শতাংশের দুই ডোজ টিকা সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু টিকা কার্যক্রমের আওতার বাইরে রয়ে গিয়েছে বিপুলসংখ্যক অভিবাসী শ্রমিক। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে সোয়া ৩ কোটিরও কম জনসংখ্যার দেশটিতে বৈধ অভিবাসী শ্রমিক রয়েছে প্রায় ২০ লাখ। বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে মোট অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা ৩০ থেকে ৬০ লাখ। সব মিলিয়ে দেশটির মোট শ্রমবাজারের বড় ভিত্তি হলো অভিবাসী শ্রমিকরা। তাদের অধিকাংশই এখনো টিকা কার্যক্রমের বাইরে থেকে গিয়েছে। বিশেষ করে অবৈধভাবে অবস্থানরত বিপুলসংখ্যক প্রবাসী শ্রমিককে টিকা কার্যক্রমের আওতায় আনার মতো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি দেশটির সরকার। এতে সংক্রমণ একটু বাড়লেই সবার আগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশটির অভিবাসী শ্রমিকনির্ভর খাতগুলো।
ভালো নেই স্থানীয়রাও। দেশটির স্থানীয় নাগরিকদের অনেকেই এখন দরিদ্র হয়ে পড়েছে। যারা এখনো দরিদ্র হিসেবে চিহ্নিত, তাদের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। দেশটির অর্থনীতিবিদদের ভাষ্য অনুযায়ী, মধ্যবিত্তের হাতে এখন কোনো সঞ্চয় নেই। ফলে তাদের আয় বৃদ্ধি বা শিক্ষায় বিনিয়োগের পথও এক প্রকার বন্ধ। কর্মসংস্থান হারিয়ে মেয়াদি সঞ্চয় ভেঙে নিঃশেষ করেছেন অনেকেই। বেঁচে থাকার তাগিদে পেনশন তহবিলের অর্থ নিঃশেষ করে ফেলারও নজির রয়েছে অনেক।
মালয়েশিয়ার রাজস্ব আয়ে বরাবরই বড় অবদান রেখে এসেছে পেট্রোনাস নাসিওনাল বারহাদ। মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর গোটা বিশ্বেই জ্বালানি চাহিদায় ধস নামে। এর ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো লোকসানে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে অস্থিতিশীলতার সুবাদে গত বছর মুনাফায় ফিরলেও এ সময় প্রত্যাশিত পারফরম্যান্স দেখাতে পারেনি পেট্রোনাস। সময়মতো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো প্রস্তুত করতে না পারায় চলতি বছর বেশ কয়েকটি এলএনজি রফতানির চালান আটকে রাখতে হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একসময়ের অনুন্নত দেশ মালয়েশিয়াকে ধরা হয় অর্থনৈতিক উত্থানের অন্যতম কেস স্টাডি হিসেবে। এ উত্থানের বড় কারিগর ধরা হয় দেশটির সাবেক অর্থ ও বাণিজ্যমন্ত্রী টেংকু রাজাইলেহ হামজাকে। মালয়েশিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি শঙ্কিত করে তুলেছে তাকেও। স¤প্রতি স্থানীয় এক ফোরামে দেয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, মালয়েশিয়া এখন মারাত্মক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপত্তির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। অদূরভবিষ্যতে এখানে বেশকিছু সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যা সাধারণ মালয়েশীয়দের কঠিন পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিতে পারে। অসাধারণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া এ বিপত্তি এড়ানো প্রায় অসম্ভব।
স্বাস্থ্য খাত ভেঙে পড়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে মালয়েশীয়দের দৈনন্দিন জীবনের প্রত্যেক পর্যায়ে বিপত্তি আরো চরমে ওঠার আশঙ্কা করছেন টেংকু রাজাইলেহ হামজা। তার ভাষ্যমতে, খাদ্যের সরবরাহ চেইন ব্যাহত হওয়ায় বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে মালয়েশিয়ার খাদ্যনিরাপত্তাও। এর ধারাবাহিকতায় সার্বিক অর্থনীতিতেই কাঠামোগত সংকট দেখা দিতে যাচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়তে যাচ্ছে বেকারত্বও। এছাড়া রিঙ্গিতের অবমূল্যায়ন, রিজার্ভ সংকট, মূল্যস্ফীতি এবং খাদ্যের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় অন্যান্য দ্রব্যের সংকটও চরম আকার নিতে যাচ্ছে।
এ অবস্থার জন্য দেশটির বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করছেন তিনি। তার বক্তব্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার মাত্রা এখন অনেক বেশি। রাজনৈতিক দুর্নীতিপরায়ণতা এবং বিভক্তির রাজনীতির কারণে পার্লামেন্ট দেওয়ান রাকিয়াত অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এমনকি পার্লামেন্টে এখন জনগণের সাধারণ মতেরও কোনো ধরনের প্রতিনিধিত্ব নেই।
মালয়েশিয়ার বাণিজ্যিক পরিম-লে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বড় ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে জাপানি, ডাচ ও জার্মানির বিনিয়োগ এখানে তুলনামূলক বেশি। মালয়েশিয়ার মহামারীকালীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার অকার্যকরতা এখন তাদের সবাইকে শঙ্কিত করে তুলেছে। গত বছর এ নিয়ে মালয়েশিয়া সরকারের কাছে চিঠিও দিয়েছিলেন তারা।
জাপানিজ চেম্বার অব ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি মালয়েশিয়া, জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশন, মালয়েশিয়ান-জার্মান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ও মালয়েশিয়ান ডাচ বিজনেস কাউন্সিল গত বছর দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের কাছে আলাদা আলাদা চিঠি দেয়। এতে মালয়েশিয়া সরকারের বিরুদ্ধে কভিড ব্যবস্থাপনার কৌশলের অকার্যকরতা, শিল্প খাতের প্রয়োজন বোঝায় ব্যর্থতাসহ বেশকিছু অভিযোগ তুলে বলা হয়, পরিস্থিতি বেশি খারাপের দিকে গেলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা মালয়েশিয়া থেকে তাদের বিনিয়োগ স্থানান্তরের কথা ভাবতে বাধ্য হবেন। ওই চিঠি দেয়ার কিছুদিন পরেই মুহিউদ্দিন ইয়াসিন ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। তার স্থলাভিষিক্ত হন তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রী ইব্রাহিম সাবরি ইয়াকুব। তবে তাতেও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের এ হুমকি বাস্তবায়নের শঙ্কা এখনো দূর হয়নি। পরিস্থিতি যদি তাদের হুমকি বাস্তবায়নের পর্যায়ে চলে যায়, সেক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নামবে। দেশটির বর্তমান অর্থনৈতিক মডেলের বড় অংশই গড়ে উঠেছে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের (এফডিআই) ওপর নির্ভর করে। এছাড়া গত কয়েক দশকে মালয়েশীয় অর্থনীতির আরেক বড় ভিত হয়ে উঠেছে রফতানিমুখী উৎপাদন শিল্প। দেশটির শিল্প খাত এখন আমদানীকৃত সস্তা শ্রমের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। বৈধ-অবৈধ অভিবাসী শ্রমিকরাই এখন দেশটির শিল্প খাতের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। যদিও দেশটিতে অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য বসবাসযোগ্য পরিবেশ নিশ্চিতের বিষয়টি বরাবরই অবহেলিত থেকেছে। একই সঙ্গে অবহেলিত রয়ে গিয়েছে তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিও।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়ায় অভিবাসী শ্রমিকরা বসবাস করছেন গাদাগাদি করে ঘিঞ্জি পরিবেশে। বিপুলসংখ্যক মানুষের অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের কারণে সংক্রমণের নতুন প্রবাহ শুরু হতে না হতে পরিস্থিতি খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে। বর্তমানে এ চিত্রেরই পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে মালয়েশিয়ায়। দেশটিতে দৈনিক করোনা সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা এখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সর্বশেষ গতকাল একদিনে নতুন করে প্রায় ২১ হাজার সংক্রমণ শনাক্তের কথা জানিয়েছে দেশটির সরকার। এ পরিস্থিতি শিগগিরই আরো খারাপের দিকে যাওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ প্রবাহ দেশটির অর্থনীতির ক্ষতকে আরো দগদগে করে তুলতে যাচ্ছে।