স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে অপুষ্টি দূর করতে সরকারি-বেসরকারি নানা পদক্ষেপ ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যদিও এখনো তীব্রতম অপুষ্টি বা এসএএমে ভুগছে দেশের অনেক শিশু। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কভিডের প্রাদুর্ভাবে সাধারণ মানুষের অনেকেই কর্মসংস্থান হারিয়েছেন। আয় কমেছে অনেকের। প্রয়োজনীয় পুষ্টির বিষয়টিতে আপস করতে বাধ্য হয়েছেন তাদের সবাই। এরই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে তীব্রতম অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধিতে। তীব্রতম অপুষ্টিতে (সিভিয়ার অ্যাকিউট ম্যালনিউট্রিশন বা এসএএম) ভুগছে দেশের অনেক শিশু। বিশেষ করে গত এক বছরে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির এ তীব্রতম মাত্রার প্রকোপ বেড়েছে অনেক বেশি। একই সঙ্গে বেড়েছে এতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুর সংখ্যাও। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশের হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিতে আসা তীব্রতম অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা বেড়েছে আগের বছরের তুলনায় ৭২ শতাংশেরও বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশের হাসপাতালগুলোয় তীব্রতম অপুষ্টিতে ভোগা শিশু ভর্তি হয়েছে আগের বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। ২০২১ সালে এসএএমে ভোগা শিশু ভর্তি হয়েছে ১১ হাজার ৩১৩ জন। যেখানে আগের বছর ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৫৭০। অপুষ্টিকে দেখা হয় শিশুর শারীরিক ও মানসিক উন্নতির সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে শিশুর অপুষ্টি এখনো মারাত্মক একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে রয়েছে। বিশ্বব্যাপী তীব্রতম অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যার দিক থেকে এখনো ওপরের তালিকায় বাংলাদেশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, মারাত্মক তীব্র অপুষ্টি পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের অসুস্থতা ও মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। সারা বিশ্বে প্রায় ২ কোটি শিশু তীব্র অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়। আর ১০ লাখের মতো শিশুর মৃত্যু হয়। এসব শিশুর অধিকাংশই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বাসিন্দা।
বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের (বিএনএনসি) সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. খলিলুর রহমান বলেন, তীব্রতম অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর মৃত্যুঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। তবে মাঝারি অপুষ্টিতে (এমএএম) আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা খুব বেশি। যদিও তা খালি চোখে বোঝা যায় না। এ শিশুদের অপুষ্টির মাত্রা বেড়ে যখন তীব্রতম পর্যায়ে যায় তখন প্রকাশ পায়। মাঝারি তীব্রতার অপুষ্টিতে আক্রান্ত অবস্থায় পরিচর্যা করা গেলে তা আর তীব্রতম পর্যায়ে যেতে পারে না।
তিনি বলেন, ২০২০ সালে করোনা শুরু হওয়ার পর মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছিল বেশি। ওই সময়ে পুষ্টির বিষয়টিও উপেক্ষিত হয়েছে বেশি। অনেক ছোট চাকরিজীবী চাকরিচ্যুত হয়েছেন। অনেকে ব্যবসা হারিয়েছেন। আয় কমায় তারা পুষ্টির বিষয়ে আপস করতে বাধ্য হয়েছেন। তবে হাসপাতালে ভর্তির বিষয়ে সচেতনতা বাড়লেও অপুষ্টিও যে বেড়েছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সঠিক পরিসংখ্যান ও গবেষণা হলে তা বের হয়ে আসবে।
সারা দেশে শিশুদের তীব্রতম অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যার দিক থেকে এখন চট্টগ্রাম বিভাগ শীর্ষে রয়েছে। বিভাগটিতে শিশুর সিভিয়ার অ্যাকিউট ম্যালনিউট্রিশনে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। গত বছর এখানকার ২ হাজার ৬১৩টি শিশু তীব্রতম অপুষ্টির চিকিৎসা নিয়েছে। এছাড়া ঢাকায় প্রায় ২ হাজার ৪৬০, খুলনায় ১ হাজার ৩২৮, বরিশালে ১ হাজার ২৫৬, রাজশাহীতে ১ হাজার ২২২, ময়মনসিংহে ৭৪৩ ও রংপুরে ৭১১ শিশু ভর্তি হয়েছে। সরকারের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে অপুষ্টিজনিত কৃশকায় শিশুর হার ২০১৭ সালে ছিল ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১৯ সালে তা বেড়ে ৯ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একইভাবে খর্বকায় শিশুর হার ওই বছর ছিল ২৮ শতাংশ। উচ্চতা অনুযায়ী তীব্রতম অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর হার ২ শতাংশ।
অপুষ্টি প্রধানত তিন প্রকার। সাধারণ অপুষ্টি, অনুপুষ্টির (ভিটামিন, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, আয়রন, জিঙ্ক, ফলিক এসিড ইত্যাদি) অভাবজনিত অপুষ্টি ও পুষ্টির ভারসাম্যহীনতাজনিত স্থূলতা। সাধারণ অপুষ্টি বুঝতে বেশ কয়েক ধরনের পরীক্ষা করা হয়। তবে সহজ পরীক্ষার বিষয় হলো খর্বতা, কৃশতা ও অতিরিক্ত ওজন। অপুষ্টির দ্বিতীয় ধরনটি হলো মাঝারি তীব্রতার অপুষ্টি। চূড়ান্ত পর্যায়ের অপুষ্টিকে বলা হয় তীব্রতম অপুষ্টি। ৬ থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে তীব্রতম অপুষ্টি ও তীব্রতম অপুষ্টিজনিত জটিলতা দেখা দিতে পারে। কোনো ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা বা শারীরিক জটিলতামুক্ত শিশুর যদি খাবারে রুচি থাকে, তাহলেও সে তীব্রতম অপুষ্টিতে আক্রান্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে খাবারে অরুচিসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা ও শারীরিক জটিলতাও দেখা দিতে পারে। এমন শিশুরা সাধারণত রোগা-পাতলা হয়। এছাড়া একেবারে চুপচাপ হয়ে পড়া, দুর্বল হয়ে কান্নার শক্তিও হারিয়ে ফেলা, চামড়া ঝুলে পড়া এবং ঘাড়, বুকের পাঁজর ও শরীরের অন্যান্য হাড় সহজেই দৃশ্যমান হয়ে পড়ার মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাভাবিক শিশুদের থেকে তীব্রতম অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর মৃত্যুঝুঁকি ১২ গুণ বেশি। নানা কারণে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন প্রসূতি নারী ও সন্তানের জন্মকালীন পরিচর্যার অভাবে শিশুর মধ্যে অপুষ্টি দেখা যেতে পারে। তবে এর প্রধানতম কারণ হিসেবে দেখা হয় নিয়মিত খাদ্য তালিকায় প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের অনুপস্থিতিকে। এ অপুষ্টি চূড়ান্ত বা তীব্রতম মাত্রায় পৌঁছলে শিশুর শরীরে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। বর্তমানে বিশ্বে মারাত্মক তীব্র অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান ওপরের দিকে।
ডব্লিউএইচওর গাইডলাইনের ভিত্তিতে বর্তমানে দেশে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের জন্য বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে এসএএম কর্নার চালু হয়েছে। এসব কর্নারে এখন শিশুর অপুষ্টিজনিত সমস্যার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় উপকরণ ও থেরাপিউটিক খাবার (এফ-৭৫ ও এফ-১০০) সরবরাহ করা হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে ২০১২ সাল থেকে এসএএম কর্নারে শিশুর তীব্রতম অপুষ্টির চিকিৎসা শুরু করা হয়। সারা দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোয় বর্তমানে ৪১০টি স্যাম কর্নার রয়েছে। এসব কর্নারে প্রশিক্ষিত নার্স ও চিকিৎসকের মাধ্যমে দুই-তিন সপ্তাহব্যাপী নিবিড় সেবার মাধ্যমে শিশুদের চিকিৎসা দেয়া হয়। সব কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে সেবা দিয়ে শিশুদের চিকিৎসার জন্য এসব হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে এ কর্মসূচিও উপকরণের অভাবসহ নানা সংকটে ভুগছে। জাতীয় পুষ্টি সেবার (এনএনএস) ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. গাজী আহমদ হাসান বলেন, মাঝে মাঝে থেরাপিউটিস খাবার এফ-৭৫ ও এফ-১০০-এর সংকট থাকে। এ দুধজাত খাবার বাংলাদেশে তৈরি হয় না। এমনকি ভারতেও তৈরি হয় না। জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) এ খাবার সরবরাহ করে। আমাদের আরো কিছু সংকট রয়েছে। সেসব সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে।
এছাড়া তীব্রতম অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর পিতা-মাতার অসচেতনতাও সংকট মোকাবেলায় বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের লাইন ডিরেক্টর ডা. এস এম মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, এসএএম কর্নার মূলত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল। আমরা তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী মারাত্মক তীব্র অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসায় কাজ করছি। সারা দেশে ধীরে ধীরে আমাদের কর্নার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশু ভর্তিও বেড়েছে। তবে ২০২০ সালে করোনা শুরুর বছরে প্রায় পাঁচ মাস ভর্তি তেমন একটা ছিল না। মানুষ ভীত হয়ে আসেনি। এরপর ২০২১ সালে ভর্তি বেড়েছে। সচেতনতা বৃদ্ধি এর জন্য ভূমিকা রেখেছে। তবে করোনার কারণে অপুষ্টির মাত্রা কিছু অবশ্যই বেড়েছে। এ কর্নারে ভর্তি শিশুর বেশির ভাগই দরিদ্র, নি¤œ মধ্যবিত্ত। শিশুর সঙ্গে মা অথবা বাবাকে থাকতে হয়। এতে তাদের আয় ওইসব দিন বন্ধ থাকে। তাই ভর্তি হওয়ার সপ্তাহের মাথায় যখন শিশুটি কিছুটা সুস্থ হয়, তখন তাকে জোর করে নিয়ে যায় অথবা আমাদের না জানিয়ে চলে যায়। পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা এবং হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরও পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হয়। কিন্তু আমরা এখানে তাদের সচেতনতা পাই না।