মহান স্বাধীনতার স্মৃতিবাহী মাস উত্তাল মার্চের তৃতীয় দিন আজ বৃহস্পতিবার। ১৯৭২ সাল থেকে দিনটি ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ইশতিহার পাঠ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ঊনিশশ’ একাত্তর সালের এই দিনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বিক্ষোভ ও প্রতিবাদে উত্তাল ছিলো। এ দিন থেকে হরতাল পালন শুরু হয়। এদিনই ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত বিশাল সমাবেশে গোটা জাতির মুক্তির আকাঙ্খার সনদ তথা স্বাধীনতার ইশতিহার পাঠ করা হয়।
১৯৭১ সালের এই দিনে ঢাকা ছিল প্রতিরোধের নগরী। পাকিস্তানি শাসকদের কারফিউ অগ্রাহ্য করে ঢাকাসহ সর্বত্র অসংখ্য মিছিল হয়েছে। সংবাদপত্রে যাতে দুর্বার আন্দোলনের খবর প্রকাশিত হতে না পারে সে জন্য সামরিক জান্তা সেন্সরশিপ আরোপ করেছিল। এই দিন আন্দোলনরত বাঙালিদের ওপর গুলী চালায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর গুলীতে চট্টগ্রাম ও খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাণ হারান বীর বাঙালিদের কয়েকজন। বর্বর এ ঘটনার প্রতিবাদে রাজধানী ঢাকাসহ জেলা শহরগুলোর রাজপথে নেমে আসেন হাজার হাজার জনতা।
অগ্নিগর্ভ মার্চের বাঙালির প্রবল আন্দোলনে দিশাহারা হয়ে পড়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা। বাঙালির এই আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করার ব্যাপারে নীলনকশা করতে থাকে সামরিক জান্তা ও তাদের দোসররা। বিশ্বের কাছে স্বাধীনতার জন্য বাঙালির এই বাঁধভাঙ্গা আন্দোলন-সংগ্রামের খবর যাতে কোনোভাবেই যেতে না পারে সেজন্য তৎপর হয়ে ওঠে পাক জেনারেলরা। শুধু সেন্সরশিপ আরোপই নয়, কোনোভাবেই যাতে বাঙালির আন্দোলন-সংগ্রামের খবর ছাপা না হয় সে জন্য প্রতিটি সংবাদপত্রের অফিসে ফোন বা সশরীরে গিয়ে হুমকি-ধমকিও দেয়া হয়।
হরতালে উত্তাল সেই আন্দোলনের অংশ হিসেবে একাত্তরে আজকের দিনে পল্টন ময়দানে আয়োজিত জনসভায় স্বাধীনতাকামী মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দিয়েছিলেন। একই দিন ছাত্র ও যুব নেতাদের নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এর থেকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের ঘোষণা ও কর্মসূচি সংবলিত এক নম্বর ইশতিহার প্রকাশ করা হয়। স্বাধীনতার ইশতিহার পাঠ করেন তৎকালীন স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা, অবিভক্ত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এবং পরবর্তীতে বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান সিরাজ।
ইশতিহারে বলা হয়, দেশের প্রতিটি গ্রাম, মহল্লা, থানা, মহকুমা ও জেলায় স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। গ্রামে গ্রামে, এলাকায় এলাকায় গঠন করতে হবে মুক্তিবাহিনী। এই ইশতেহার পাঠের মধ্যদিয়েই স্বাধীনতার ঘোষণা, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীতের অনুমোদনসহ স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি ঘোষণা করে উপস্থিত লাখ লাখ মানুষের অনুমোদন নেয়া হয়।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চে প্রধান কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের এক বৈঠক আহ্বান করেন। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, এমন কতিপয় লোকের সঙ্গে আমাদের বৈঠকে বসার আহ্বান জানানো হয়েছে, যাদের চক্রান্তের কারণে নিরীহ, নিরস্ত্র, কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্রকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এদিন পাঞ্জাব পাকিস্তান ফ্রন্ট (পিপিএফ) ভুট্টোর ভূমিকার চরম নিন্দা করেন। তারা বাংলার জনগণের প্রতি অত্যাচার বন্ধের আহ্বান জানান।
বাংলা একাডেমি প্রকাশিত আসাদ চৌধুরীর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক গ্রন্থেও উল্লেখ করা হয়- ৩ মার্চে ইয়াহিয়ার দশনেতার বৈঠকের প্রস্তাব বঙ্গবন্ধু প্রত্যাখ্যান করেন। ঐদিন বিকেলে ৬ মার্চ পর্যন্ত সকাল ৫টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্র প্রকাশিত হয়। এ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিলো আ স ম আব্দুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী এবং শাজাহান সিরাজকে নিয়ে।
অন্যদিকে, ইয়াহিয়া খান এদিনও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অবাঙালি সেনা পাঠানো অব্যাহত রাখেন। একই সাথে এদিন দুপুরের দিকে চট্টগ্রামে প্রচন্ড গোলযোগ হয়। অবাঙালি ঘাঁটিগুলোতে সেনাবাহিনীর স্পেশাল গ্রুপ (কমান্ডো) এবং গুপ্তচররা আগে থেকেই অবস্থান নিয়েছিল এবং এসব জায়গা থেকে নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলী চালানো হয়। শুধু তাই নয়, অনেক স্থানে মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে সরাসরি আক্রমণও পরিচালনা করা হয়। এমনকি এদের মেয়েরা বাড়ির ছাদ থেকে গরম পানি ঢেলে দেয় জনতার ওপর।