মঙ্গলবার, ০১ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৩১ অপরাহ্ন

ইসলামে অংশীদারি কারবার

আবু নুসাইবা মুহাম্মাদ নূরুন্নবী:
  • আপডেট সময় শনিবার, ৫ মার্চ, ২০২২

আরবি শব্দ শিরকাহ অর্থ অংশীদারিত্ব। আমাদের ইসলামী ব্যাংকগুলো এদেশে মুশারাকাহ শব্দকে জনপ্রিয় করে তুললেও প্রাচীন ফিকহের কিতাবগুলোতে রয়েছে ‘শিরকাহ’। দুই বা ততধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কোনো কারবার হলো এই শিরকাহ বা অংশীদারি কারবার। এ ধরনের কারবার মানবসভ্যতার ইতিহাসের মতোই প্রাচীন। বিশ্বনবী মুহাম্মদ সা:-এর আবির্ভাবকালে আরব সমাজেও শিরকাহ বা অংশীদারি কারবারের প্রচলন ছিল। তিনি নিজেও নবী হওয়ার আগে এ রকম ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। তাঁর একজন ব্যবসায়িক অংশীদারের নাম সাইব ইবনে আবি সাইব আল-মাখযুমি। রাসূলুল্লাহ সা:-এর মক্কার দিনগুলোতে তিনি তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার ও বন্ধু ছিলেন। ৬২৯ সালের ডিসেম্বর অথবা ৬৩০ সালের জানুয়ারি মাসে মক্কা বিজয়ের দিন সাইব ইবনে আবি সাইব আল-মাখযুমি রাসূলুল্লøাহ সা:-এর সাথে দেখা করতে এলে তিনি তার উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমার ভাই ও আমার ব্যবসার অংশীদারকে স্বাগত যিনি তার অংশীদারের সাথে মতবিরোধ করেন না এবং বিবাদেও লিপ্ত হন না।’ (মুসনাদ-ই-আহমদ : ৩/৪২৫)
নবুয়ত প্রাপ্তির পর রাসূলুল্লাহ সা: শিরকাহ তথা অংশীদারি কারবার অনুমোদন করেন এবং অংশীদারির ভিত্তিতে ব্যবসা করায় উৎসাহ প্রদান করেন। আবু দাউদ বর্ণিত এক হাদিসে (৩৩৮৩) রাসূল সা. বলেছেন, দুইজন অংশীদারের ওপর ততক্ষণ আল্লাহর রহমত অব্যাহত থাকে যতক্ষণ তারা একে অন্যের খিয়ানত না করে।
হাদিস থেকে বোঝা যাচ্ছে, শিরকাহ তথা অংশীদারি কারবার ইসলামে বৈধ; কিন্তু তাতে অংশীদারদের পরস্পরের প্রতি খিয়ানত করার সুযোগও রয়েছে। বরং অংশীদারি কারবারে আমানতদারের চাইতে খিয়ানতকারীর সংখ্যই বেশি, যেমনটা বলছেন স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা- ‘দাউদ বলল, তোমার দুম্বাটিকে তার দুম্বাগুলোর সাথে যুক্ত করার দাবি করে সে তোমার ওপর জুলুম করেছে। শরিকদের অনেকে একে অন্যের ওপর তো অবিচারই করে থাকে- করে না কেবল মুমিন ও সৎ ব্যক্তিরা। কিন্তু এদের সংখ্যা কম।’ (সোয়াদ-৩৮ : ২৪)
তবুও তো ব্যবসার পদ্ধতি হিসেবে শিরকাহ তথা অংশীদারি কারবার সমাজের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা একটি হাদিসে কুদসির মাধ্যমে এই অতি প্রয়োজনীয় ব্যবসায় পদ্ধতিকে সুরক্ষা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘দুইজন ব্যবসায়িক অংশীদারেরর সাথে আমি তৃতীয়জন হিসেবে অবস্থান করি; যতক্ষণ পর্যন্ত এক অংশীদার অপর অংশীদারের প্রতি খিয়ানত না করে। খিয়ানতের কোনো ঘটনা ঘটলে আমি ওদের কারবার থেকে বেরিয়ে আসি।’ (আবু দাউদ-৩৩৮৩)
আল্লাহ তায়ালার সুরক্ষা আছে বলেই হয়তো আজো সব সমাজে শিরকাহ তথা অংশীদারি কারবার বিপুলভাবে বিদ্যমান আছে। হোক কোথাও কোথাও ঝগড়া-ফ্যাসাদ, মামলা-মোকদ্দমা; তবুও। আর এ জন্যই আমরা এখন লিখতে বসেছি ইসলামে অংশীদারি কারবারের বিধান নিয়ে।
আগেই বলা হয়েছে, শিরকাহ মানে শেয়ারিং। ফিকহের প্রাচীন গ্রন্থগুলোতে শিরকাহকে প্রথমত দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। একটি হলো শিরকাতুল মিল্ক; অপরটি শিরকাতুল আকদ।
শিরকাতুল মিল্ক/মালিকানায় অংশীদারিত্ব
শিরকাতুল মিল্ক অর্থ একটি নির্দিষ্ট সম্পদে দুই বা ততধিক ব্যক্তি বা পক্ষের যৌথ মালিকানা। এ ধরনের শিরকাহ দু’টি ভিন্ন পদ্ধতিতে সঙ্ঘটিত হতে পারে। যেমন-
ক. শিরকাতুল ইখতিয়ারিয়াহ
কখনো কখনো শিরকাতুল মিল্ক সঙ্ঘটিত হয় পক্ষগুলোর ইচ্ছায়। যেমন- দুই বা ততধিক ব্যক্তি বা পক্ষ মিলে একটি মেশিন বা গাড়ি বা বাড়ি ক্রয় করল। তারা যৌথভাবে এর মালিক হবে এবং তাদের মধ্যকার এই মালিকানার সম্পর্কটা হলো শিরকাতুল মিল্ক। যেহেতু এই মালিকানায় তারা শরিক হয়েছেন স্বেচ্ছায় সে জন্য এ প্রকার যৌথ মালিনাকে বলে শিরকাতুল ইখতিয়ারিয়াহ বা স্বেচ্ছাকৃত অংশীদারিত্ব।
খ. শিরকাতুল জাবরিয়াহ
আবার কখনো কখনো এ ধরনের যৌথ মালিকানা পক্ষগুলোর কোনো প্রকার ইচ্ছা বা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবেও সঙ্ঘটিত হতে পারে। যেমন- কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার সব ওয়ারিশ তার পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মালিক হন। এ মালিকানা তারা অর্জন করেন সম্পত্তির মালিকের মৃত্যুর পরিণতি হিসেবে, নিজেদের কোনো প্রকার ইচ্ছা বা আগ্রহ ছাড়াই। এ প্রকার অংশীদারিত্বকে শিরকাতুল জাবরিয়াহ বা স্বয়ংক্রিয় অংশীদারিত্ব বলে।
শিরকাতুল আকদ
শিরকাতুল আকদ হলো চুক্তিভিত্তিক অংশীদারি ব্যবসায়। সংক্ষেপে এটাকে বলা যায় যৌথ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। শিরকাতুল ‘আকদকে বর্তমান সামাজিক বাস্তবতায় প্রথমত দু’ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। যেমন- প্রাচীন ফিকহের কিতাবে বর্ণিত অংশীদারিত্ব ও আধুনিক অংশীদারি কারবার।
প্রাচীন ফিকহের কিতাবে শিরকাতুল আকদের আওতাভূক্ত যেসব অংশীদারি কারবারের বর্ণনা রয়েছে সেগুলো হলো-
ক. শিরকাতুল আমওয়াল : এখানে অংশগ্রহণকারী সব পক্ষ কোনো বাণিজ্যিক প্রকল্পে কিছু না কিছু মূলধন বিনিয়োগ করেন। এ প্রকারের শিরকাহ আবার দুইভাবে হতে পারে। যেমন-
শিরকাতুল মুফাওয়াদাহ : এ প্রকার অংশীদারি কারবারে ব্যবসায় শুরুর দিন থেকে ব্যবসা অবসায়নের দিন পর্যন্ত সব পক্ষ সব ক্ষেত্রে সমান মর্যাদাসম্পন্ন। যেমন- মূলধন জোগান, কারবার ব্যবস্থাপনা, মুনাফা বণ্টন, দায়-দায়িত্ব বহন ও দক্ষতার সমতা। এ ধরনের অংশীদারি কারবার বর্তমানে খুবই কম।
শিরকাতুল ইনান বা অসম-মূলধনী অংশীদারিত্ব : এটি শিরকাতুল মুফাওয়াদার বিপরীত। এ পদ্ধতিতে মূলধন জোগান, কারবার ব্যবস্থাপনা, মুনাফা বণ্টন, দায়-দায়িত্ব বহন ও দক্ষতার সমতা বাধ্যতামূলক নয়। এখানে মুনাফা বণ্টিত হয় চুক্তিতে উল্লিøখিত অনুপাতে। লোকসান বহন করা হয় মূলধন অনুপাতে। একালের অধিকাংশ অংশীদারি কারবার এ পদ্ধতিতেই পরিচালিত হয়ে থাকে।
খ. শিরকাতুল আমাল : এখানে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন যৌথকারবারিরা একত্রে মিলে তাদের গ্রাহককে সেবা দান করেন। যেমন- দুই বা ততধিক ব্যক্তি মিলে একটি দর্জিখানা খুললেন। নিয়ম করলেন যে, সারা দিনে শরিকদাররা যে যেই পরিমাণ কাজই করুন বা যাই অর্জন করুন সবই একটি অভিন্ন তহবিলে জমা হবে এবং দিন শেষে অর্জিত আয় পূর্বনির্ধারিত অনুপাতে নিজেদের মধ্যে বণ্টিত হবে। এ প্রকার শিরকাতের আরো নাম রয়েছে। যেমন- শিরকাতুত তাকাব্বুল, শিরকাতুস সানাই ও শিরকাতুল আবদান।
গ. শিরকাতুল উজুহ : এখানে শরিকদের কোনো আর্থিক বিনিয়োগ থাকে না। অংশীদাররা তাদের সুনাম ও বিশ^স্ততা ব্যবহার করে সরবরাহকারীর কাছ থেকে বাকিতে পণ্য কিনে নগদে বিক্রয় করেন। কারবার থেকে যে মুনাফা আসে তা পূর্বনির্ধারিত অনুপাতে নিজেদের মধ্যে বণ্টন করেন। অন্যান্য অংশীদারি কারবারে লোকসান হলে তা অংশীদাররা নিজ নিজ মূলধন অনুপাতে বহন করেন। কিন্তু শিরকাতুল উজুহতে যেহেতু আর্থিক মূলধন থাকে না সে জন্য এ কারবারে লোকসান হলে তাও মুনাফার মতো, চুক্তি মোতাবেক, পূর্বনির্ধারিত হারে অংশীদারদের বহন করতে হয়। এ প্রকার অংশীদারিত্বকে ইংরেজিতে Partnership of Creditworthiness বা Liability Partnership ও বলা যেতে পারে।
ওপরে বর্ণিত সব অংশীদারি কারবার পদ্ধতিই প্রাচীন ফিকহের গ্রন্থাবলিতে শিরকাহ নামে রয়েছে। বর্তমানকালে বহু পরিশ্রুত ‘মুশারাকা’ পরিভাষাটি প্রাচীন ফিকহ গ্রন্থাবলিতে পাওয়া যায় না। ‘মুশারাকা’ পরিভাষাটি সৃষ্টি করেছেন এ কালের ইসলামিক ফাইন্যান্স বিষয়ক লেখকরা।
আধুনিককালের বিশ^-অর্থনীতিতে শিরকাতুল আকদের আওতাভূক্ত যেসব অংশীদারি কারবারের প্রয়োগ আমরা সচরাচর দেখতে পাই সেগুলো হলো- Hire Purchase under Shirkatul Meelk ইত্যাদি।
আমাদের দেশের ইসলামী ব্যাংকিং ও ইসলামী অর্থায়ন শিল্পে যে শিরকাহ বা মুশারাকা ব্যবহৃত হয় তা মূলত শিরকাতুল আকদ-গোত্রভূক্ত শিরকাতুল আমওয়াল। এখানে ব্যাংক ও বিনিয়োগ গ্রাহক যৌথ বাণিজ্যিক কারবারে সম বা অসমমূলধন বিনিয়োগ করে এবং লাভ হলে ব্যাংক পূর্বনির্ধারিত হারে মুনাফা বা ভাড়া আদায় করে নেয়। অবশ্য ব্যাংকিং মুশারাকায় কখনো কখনো শিরকাতুল আমাল প্রয়োগ করা হয়, যেখানে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন যৌথকারবারিরা একত্রে মিলে তাদের গ্রাহককে সেবা দান করেন। এটিও শিরকাতুল আকদ-গোত্রভূক্ত।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং শিল্পে বহুল প্রচলিত বিনিয়োগ প্রডাক্ট Hire Purchase under Shirkatul Meelk-এর শিরোনামে Shirkatul Meelk অংশ পরিবর্তন করে Shirkatul Aqd করা যায় কি না ভেবে দেখা যেতে পারে।
উল্লেখ্য, প্রচলিত মুশারাকাহ-এর চাইতে শিরকাহ-এর ক্ষেত্র বৃহত্তর। মুশারাকার ব্যবহার শিরকাতুল আমওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অন্য দিকে, সব প্রকার যৌথ মালিকানা ও অংশীদারি কারবার শিরকাহ-এর অন্তর্ভূক্ত। এ কারণে মুশারাকা বলতে এখন শিরকাতুল আমওয়ালকেই বোঝায়। আজ এ পর্যন্তই। ভবিষ্যতে সুযোগ হলে ইসলামে অংশীদারি কারবারের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে, ইনশা আল্লাহ, বি-ইজনিল্লাহ। লেখক : সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার, পূবালী ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com