মানুষের জীবনের দু’টি দিক। একটি হলো- মানুষের শরীর বা অবয়ব। অন্যটি হলো- আত্মা বা রূহ। বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগে একে কম্পিউটার যন্ত্রের সাথে তুলনা করা যায়। কম্পিউটারের যেমন দু’টি দিক রয়েছে- এক. হার্ডওয়্যার তথা বডি; দুই. সফটওয়্যার তথা বডিতে ধারণকৃত প্রোগ্রাম। তেমনি মানুষের শরীর হলো একটা হার্ডওয়্যার এবং এই হার্ডওয়্যারে ধারণকৃত সফটওয়্যারটি নাম হলো, রূহ বা আত্মা। একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের জন্য মানুষকে এই দু’টিরই সমান ও যথাযথ গুরুত্ব দিতে হয় এবং দু’টির জন্যই তার সুষম ও পৃষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হয়। অন্যথায় এর একটি অসুস্থ হলে অন্যটি স্ব^য়ংক্রিয়ভাবে নষ্ট হয়ে যায়। আমরা সবাই আমাদের হার্ডওয়্যার তথা শরীরের খাদ্য সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান রাখি এবং এই খাদ্য সংগ্রহের জন্য রাত-দিন মাড়িয়ে যাই সর্বদা। কিন্তু সেই তুলনায় আমাদের সফটওয়্যার তথা রূহ বা আত্মার খাদ্যের চেষ্টা অনেকটা কদাচিৎ ও নগণ্য। ফলে বাইরে থেকে একজনকে সুঠাম ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মনে হলেও তার মধ্যে বাস করে একটি মৃত বা অসুস্থ আত্মা। ফলে তার দেহখানি একখান অসাড় কলাগাছ। যার মধ্যে কোনো পরিপুষ্টতা নেই, নেই কোনো উপকারী পদার্থ।
মানুষের শরীরকে মাটি থেকে তৈরি করা হয়েছে। তাই আমাদের খাদ্য সব মাটি। অর্থাৎ মাটি থেকে উৎপন্ন খাদ্য আমাদের শরীরকে পরিপুষ্ট করে রাখে। আবার আমার মাটিতেই চলে যাব। মাটি থেকে আবার বের করে আনা হবে। আল্লাহর এই সাইকেল অনন্তকাল ধরে চলছে, চলবে। এই প্রবন্ধে আপাতত বডি তথা শরীরকে বাদ দিয়ে আত্মার সুষম খাদ্যের একটি তালিকা দেয়ার চেষ্টা করা হবে ইনশা আল্লাহ।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তিনিই তো সেই সত্তা যিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। তারপর শুক্র থেকে। তারপর রক্তের পি- থেকে। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে শিশুর আকৃতিতে বের করে আনেন। এরপর তিনি তোমাদের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত করেন যাতে তোমরা নিজেদের পূর্ণ শক্তিতে উপনীত হতে পারো। তারপর আরো বৃদ্ধিপ্রাপ্ত করেন যাতে তোমরা বৃদ্ধাবস্থায় উপনীত হও। তোমাদের কাউকে আগেই ফিরিয়ে নেয়া হয়। এসব কাজ করা হয় এ জন্য যাতে তোমরা তোমাদের নির্ধারিত সময়ের সীমায় পৌঁছতে পারো এবং যাতে প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে পারো।’ (সূরা আল মুমিন-৬৭)
আয়াতে জীবনের এসব পর্যায়ের মধ্য দিয়ে আমাদেরকে অতিক্রম করানোর কারণ এ নয় যে, আমরা পশুর মতো জীবনযাপন করব এবং পশুর মতো মরব। বরং এসব পর্যায় অতিক্রম করানো হয় এ জন্য যে, আল্লাহ আমাদেরকে যে জ্ঞান দিয়েছেন তা কাজে লাগাব।
আত্মা। আত্মা হলো রবের আমর বা হুকুমমাত্র। কাজেই আত্মার খাদ্য আসে রবের ইবাদতের মাধ্যমে রবের কাছ থেকে। তাই আত্মাকে সজীব ও সতেজ রাখার জন্য আমাদের দৈনন্দিন নি¤েœর কাজগুলো আঞ্জাম দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আত্মার খাদ্য গ্রহণের জন্য বৈরাগ্য বা সন্ন্যাসী হওয়া যাবে না। বরং সমাজ সংসারের বিশাল চারণভূমিতে জীবনের পদচারণায়, শয়নে-স্বপনে, প্রকাশ্যে-নির্জনে, দিনে ও রাতে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি কার্য সম্পাদনে বা কোনো বক্তব্য পেশকালে আল্লাহর হুকুমকে পর্যালোচনা করা হলেই আত্মার খাদ্য গ্রহণ করা হবে। অর্থাৎ দুনিয়া ও আখিরাতের সাফল্য কোন পথে তা তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করা সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে অবলোকন করা। যিনি তার ভেতর ও বাইরে কোন কোন জিনিস সাফল্যের পথে বাধার সৃষ্টি করে তা প্রথমে চিহ্নিত করেন এরপর যথাসাধ্য নিয়ন্ত্রণ বা বাগে আনার চেষ্টা চালান। আর এর জন্য কোনো বিরানভূমি বা গভীর অরণ্যে নয় বরং সমাজ সংসারই হলো এর উপযুক্ত ক্ষেত্র। সমাজ-সংসারের অসংখ্য ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করে আল্লাহর পথে টিকে থাকার পরীক্ষাই যার হলো না, তিনি আবার আত্মশুদ্ধি করেন কিভাবে? তাছাড়া যিনি এ আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে আধ্যাত্মিকতা হাসিল করবেন তিনি অবশ্যই এমন ব্যক্তি হবেন যিনি সর্বাবস্থায় আল্লাহ ও মানুষের অধিকারকে আল্লাহরই ভয়ে সংরক্ষণ করবেন। যার হৃদয় বিশ্ব মানবতার দুরবস্থা দেখে কেঁদে উঠবে। বিশ্বের যেকোনো নিভৃত কোণে কোনো একজন মুসলিমের গায়ে আঘাত লাগার সাথে সাথে তার গায়ে সে আঘাত অনুভূত হবে এবং এ দুরবস্থা থেকে মানবতাকে মুক্তিদানের চিন্তা-চেতনা তার অন্তরকে অস্থির করে তুলবে। এটিই হলো সুস্থ সবল আত্মার পরিচয়। আত্মার খাদ্যের জন্য নি¤েœর কাজগুলো নিয়মিত করা উচিত।
কুরআন ও সুন্নাহর অধ্যয়ন : বেশি বেশি কুরআন ও হাদিস অধ্যয়ন করা এবং এই অধ্যয়ন বুঝে অর্থ অনুধাবন করে পড়তে হবে। জ্ঞান হলো আত্মার খোরাক। কারণ জ্ঞানের পরিধি যত বিস্তৃতি লাভ করবে, আল্লাহর ভয় তত বেশি বৃদ্ধি পাবে। আর সেই জ্ঞান হলো- তাওহিদ, আল্লাহর ক্ষমতা, আল্লাহর গুণাবলি, রিসালাত ও আখিরাতের জ্ঞান। যে ব্যক্তি আল্লাহর গুণাবলির ব্যাপারে যত বেশি অজ্ঞ হবে সে তার ব্যাপারে তত বেশি নির্ভীক হবে। পক্ষান্তরে আল্লাহর শক্তিমত্তা, জ্ঞান প্রজ্ঞা ও বিজ্ঞানময়তা, ক্রোধ, পরাক্রম সার্বভৌম কর্তৃত্ব ক্ষমতা ও অন্যান্য গুণাবলি সম্পর্কে যে ব্যক্তি যত বেশি জানবে সে তত বেশি তার নাফরমানি করতে ভয় পাবে।
মানবতার কল্যাণ করা : আল্লাহর রহমত, বরকত ও আত্মার আনন্দের জন্য মানুষের প্রতি কল্যাণ ও উপকারের হাত বাড়িয়ে দেয়া। মানুষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, অসুস্থকে দেখতে যাওয়া, সেবা করা, বিপদে পড়লে উদ্ধার করা, মাজলুমকে সাহায্য করা, কাফন-দাফনে অংশগ্রহণ করা ইত্যাদি সমাজকল্যাণমূলক কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করলে আত্মার প্রশান্তি বেড়ে যায়।
হিংসামুক্ত কল্যাণ কামনা করা : হৃদয়কে বিদ্বেষ, হিংসা ও অন্যের অকল্যাণ কামনা থেকে মুক্ত রাখা। হিংসামুক্ত আত্মা পরোপকারী ও অন্যের কল্যাণকামী হয়। মুসনাদে আহমাদে রাসূলুল্লাহ সা: এ ধরনের ব্যক্তিকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। অন্য হাদিসে আনাস রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: আমাকে বলেন, ‘বেটা! যদি পারো তবে এমনভাবে সকাল-সন্ধা পার করো যে, তোমার হৃদয়ে কারো প্রতি কোনো বিদ্বেষ বা অকল্যাণের ইচ্ছা নেই। সম্ভব হলে এরূপ চলবে, কারণ এরূপ চলা আমার সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। আর যে আমার সুন্নতকে জীবিত করল, সে আমাকে ভালোবাসল। আর যে আমাকে ভালোবাসবে সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে।’ ইমাম তিরমিজি হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন।
আত্মনিয়ন্ত্রণ ও ধৈর্যধারণ করা : ধৈর্য মুমিন জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও ঈমানের অন্যতম অংশ। ধৈর্য বলতে নিষ্ক্রিয় নির্জীবতা বুঝানো হয় না। বরং সক্রিয় আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বোঝায়। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বা অন্যের আচরণ দ্বারা নিজের আচরণ প্রভাবিত না করে নিজের স্থির সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নিজেকে পরিচালিত করার ক্ষমতা। ইসলামী দৃষ্টিতে ধৈর্য তিন প্রকার- এক. বিপদ-আপদ ও কষ্টে ধৈর্য; দুই, পাপ ও লোভ থেকে ধৈর্য এবং তিন. ক্রোধের মধ্যে ধৈর্য। ধৈর্যশীলদের সাথে আল্লাহ থাকেন।
হতাশা বর্জন ও আল্লাহর ওপর ভরসা করা : আল্লাহর রহমত থেকে নৈরাশ্যই হতাশা ও উৎকণ্ঠার মূল কারণ। এটি পাপ। এ জন্য হাদিসে বারবার এগুলো থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। আল-কুরআনে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হতে নিষেধ করা হয়েছে। মানুষের মনে আল্লাহর ওপর আস্থা যত গভীর হয় আত্মা বা মানসিক শক্তি ও স্থিরতা ততই বৃদ্ধি পায়। নিয়মিত আল্লাহর ইবাদত, কুরআন-সুন্নাহ অধ্যয়ন ও আল্লাহর স্মরণ হতাশা ও নৈরাশ্য দূরীভূত করে।
কৃতজ্ঞতা ও সন্তুষ্টি : আমাদের জীবনে অগণিত নিয়ামত রয়েছে। আবার কষ্টও রয়েছে। আমাদের একটি বড় দুর্বলতা হলো- আনন্দের কথা তাড়াতাড়ি ভুলে যাই আর কষ্ট বেদনাকে জিইয়ে রাখি। আত্মার পরিপুষ্টতার জন্য এই দুর্বলতা কাটাতে হবে। সর্বদা ইতিবাচক হতে হবে। আত্মতুষ্টির জন্য রাসূলুল্লাহ সা:-এর নিচের হাদিসটি মনে রাখতে হবে। ‘সম্পদে, শক্তিতে তোমাদের চেয়ে উত্তম কারো দিকে যখন তোমাদের দৃষ্টি পড়বে, তখন সে যেন তার চেয়ে খারাপ অবস্থায় নিমজ্জিত ব্যক্তির দিকে দৃষ্টি দেয়।’ (বুখারি, কিতাবুর রিকাক)
নির্লোভ : সচ্ছলতা, অসচ্ছলতা, সম্মান ও অসম্মান সর্বাবস্থায় স্থিতিশীল রাখা। আল্লাহ যখন যে অবস্থায় রাখবেন তখন সে অবস্থায় বান্দা তার দায়িত্ব পালন করবে। সম্পদ বা প্রতিপত্তি থাকলে তা দিয়ে আখিরাতের ঘর তৈরি করবে। সম্পদ বা প্রতিপত্তি না থাকলে তাতেই বান্দা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে। সম্পদ বা প্রতিপত্তির লোভ যেন কাউকে অন্ধ না করে।
সুন্দর আচরণ : উত্তম আচরণ প্রকৃত মুসলিমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সবার সাথে উত্তম ও শোভনীয় আচরণ করা আল্লাহর প্রিয় ইবাদাতগুলোর অন্যতম। কিয়ামতের দিন কর্মবিচারের পাল্লায় সবচেয়ে ভারী ও মূল্যবান কর্ম হবে সুন্দর আচরণ।
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সা: ভালোবাসা : আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-কে অন্য সব কিছু এবং নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ক্রমাগত জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত ভালোবাসা ঈমানের অঙ্গ। এই ভালোবাসা দ্বারা আত্মার খোরাক সৃষ্টি হয়, আত্মা সর্বদা পুষ্ট ও সতেজ থাকে।
আল্লাহর জিকির : জেনে বুঝে মনের আবেগ মিশিয়ে সকাল-সন্ধ্যা ছাড়াও সার্বক্ষণিক আল্লাহর জিকির তথা আল্লাহকে স্মরণ করা। এটি আত্মার বিশাল খাদ্যভা-ার। আত্মা সুস্থ ও সবল রাখার জন্য রাসূলুল্লাহ সা:-এর সুন্নাহ মোতাবেক নিজেকে আল্লাহর জিকিরে রত রাখতে হবে।