( গতকালের পর)
আদব, শিষ্টাচার ও আদর্শ চরিত্র : রোজাদার রোজা রেখে নিজেকে পবিত্র রাখার চেষ্টা করে। সে মিথ্যা ও পাপকাজ পরিহার করে। কোনো মানুষের মধ্যে মিথ্যা ও পাপাচারের অভ্যাস থাকলেও রোজা রেখে সে তা করতে পারে না। কেননা সে জানে রোজা রেখে মন্দ কাজ করলে রোজার কোনো মূল্যই নেই। রাসূল সা: এ কথাই বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা ও কাজ পরিত্যাগ করতে পারেনি, তার খাদ্য ও পানীয় পরিহার করার কোনো প্রয়োজন নেই।’ (সহিহ বুখারি)
ফলে রোজাদার ভালো আচরণ করে, সুন্দরভাবে কথা বলে, কোনো মিথ্যা কথা ও কাজে সে অংশ নেয় না। ধোঁকা ও প্রতারণা রোজাদারের পক্ষে সম্ভব হয় না। রোজা নষ্ট হয়ে যাবে এ ভয়ে রোজাদার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অথবা বাধ্য হলেও ঝগড়া-ফ্যাসাদ, গালাগালি বা অশ্লীল কাজ ও কথায় জড়িত হয় না। এ প্রসঙ্গে রাসূল সা: বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রোজা রাখে সে যেন কোনো রকম অশ্লীলতা ও হইহুল্লোড় না করে। কেউ যদি তাকে গালাগাল দেয় বা তার সাথে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করে সে যেন উত্তরে বলে, আমি রোজাদার।’
অন্যায়, অশ্লীলতা, মিথ্যা, প্রতারণা ইত্যাদি খারাপ কাজগুলো থেকে একজন রোজাদার যখন পরহেজ করে, তখন তার মধ্যে শিষ্টাচার, নম্রতা, আদব ও উন্নত চরিত্রের এক মহীয়ান সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়।
নিয়মানুবর্তিতা শেখায় : রমজানের রোজা নিয়মানুবর্তিতার এক অনুপম শিক্ষার বার্তা নিয়ে আসে। ইসলামে প্রতিটি ইবাদত যেমনÑ নামাজ, রোজা, হজ ইত্যাদি একটি নির্দিষ্ট নিয়মে নির্দিষ্ট সময়ে পালন করতে হয়। রোজার সময় নিয়মানুবর্তিতার বিষয়টি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রোজাদারকে একটি নির্দিষ্ট দিনে চাঁদ দেখার দিন থেকে রোজা রাখতে হয়। নির্দিষ্ট সময়ে রাতে উঠে সাহরি খেতে হয়, সময়মতো ইফতারি করে রোজা ভাঙতে হয়, নিয়ম ও সময়ের মধ্যে সালাতুত তারাবিহ পড়তে হয়। এভাবে দীর্ঘ এক মাস রোজার বিধানগুলো পালনের মধ্য দিয়ে রোজাদারের জীবনে নিয়মানুবর্তিতার গুণ তৈরি হয়। একজন আদর্শ ও সফলকাম মানুষের জন্য এ গুণ অপরিহার্য।
নাজাত ও মাগফিরাত লাভের সুযোগ আনে : রমজানের রোজা গুনাহ থেকে মাফ পাওয়ার এক সুবর্ণ সুযোগ। মহান আল্লাহর মাগফিরাত লাভ তথা শান্তি ও মুক্তির সুনিশ্চিত ব্যবস্থা রমজানের রোজা। সূরা বাকারার ১৮৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আর সিয়াম পালন করাই তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণপ্রসূত যদি তোমরা জানতে।’ রোজা পালন ও রোজাদারকে ইফতার করালে গুনাহ মাফ হয় বলে উল্লেখ করেছেন মহানবী সা:। রাসূল সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে তার গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে এবং দোজখ থেকে তাকে নাজাত দেয়া হবে।’ রোজাদারের জন্য জান্নাতে প্রবেশ ও সেখানে তাকে বিশেষ মর্যাদা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। মহানবী সা: বলেন, ‘জান্নাতের একটি দরজা আছে, এর নাম রাইয়ান। কিয়ামতের দিন এই দরজা দিয়ে কেবল রোজাদার প্রবেশ করবে।’ (রিয়াদুস সালেহিন, হাদিস নম্বর-১২১৭)
রাসূল সা: আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের তাগিদে এবং সওয়াব লাভের আশায় রমজানের রোজা রাখে, তার আগের গুনাহ মাফ হয়ে যায়।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম) রমজানুল মোবারকের সময় রোজাদারের গুনাহ মাফের ব্যাপারে মহানবী সা: আরো বলেন, ‘রমজানুল মোবারকে আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণকারী ব্যক্তিকে মাফ করা হয়, আর আল্লাহ তায়ালার মহান দরবারে প্রার্থনাকারী ব্যক্তি বঞ্চিত হয় না।’
রমজানের রোজা ঈমানদারদের জন্য মহাকল্যাণ ও নিয়ামত লাভের অপূর্ব সুযোগ। কেননা রোজাদারের পুরস্কার আল্লøাহ তায়ালা নিজ হাতে দেবেন এবং তা অফুরন্ত দেবেন। রাসূল সা: বলেন, ‘আল্লাহ বলেন, সাওম আমারই জন্য, আমি এর যত খুশি বিনিময় দেবো।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
ঐক্য ও সংহতির মাস : রমজানের রোজা মুসলিম উম্মাহর জাতীয় উৎসবের মাস। সারা দুনিয়ার মুসলমান রোজার মাসে ঐক্য ও সংহতির এক অনন্য ঐতিহ্য প্রকাশ করে। দুনিয়ার সব মুসলমান রমজানের চাঁদ দেখার সাথে সাথে রোজা শুরু করে এবং শাওয়ালের চাঁদ দেখে রোজার সমাপ্তি টানে। এ প্রসঙ্গে রাসূল সা: বলেন, ‘চাঁদ দেখে রোজা শুরু করবে এবং চাঁদ দেখে তা শেষ করবে।’ (শামী, দ্বিতীয় খ-)
সূর্যোদয়ের আগেই রোজাদার সাহরি খাওয়া শেষ করে এবং সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে ইফতার করে। কোথাও এ নিয়মের কোনো হেরফের হয় না। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা পানাহার (সাহরি) করো যতক্ষণ রাতের কৃষ্ণরেখা হতে ঊষার শুভ্ররেখা তোমাদের নিকট প্রতিভাত না হয়।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-১৮)। হাদিসে কুদসিতে আছে, আল্লাহ বলেন, ‘আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় ওই বান্দাগণ যারা বিলম্ব না করে ইফতার করে।’
আল্লাহর নির্দেশ পালনে সব মুসলমান একই নিয়মে এবং সময়ে তারাবিহ নামাজ আদায় করে এবং ঈদুল ফিতরের ফিতরা প্রদান করে। তারপর সবাই ঈদগাহে গিয়ে নামাজ আদায় করে, কোলাকুলি করে, ঈদের আনন্দ উৎসবে মেতে উঠে। ঈদের দিন (ঈদুল ফিতর) সম্পর্কে হাদিসে কুদসিতে বর্ণনা রয়েছে, ‘আমার বান্দা যারা তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করেছে, তারপর আমার কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে করতে ঈদগাহে গমন করেছে, আমার শপথ ও মর্যাদার শপথ, জেনে রেখো, আমি তাদের প্রার্থনা অবশ্য শ্রবণ করব। তার পর বলেন, ‘হে আমার বান্দাগণ! গমন করো, আমি নিশ্চয়ই তোমাদের পাপগুলোকে পুণ্যে পরিণত করলাম।’
রাসূল সা: বলেন, ‘এভাবে তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে বাড়ি ফেরে।’ (বায়হাকি) এভাবে রোজা পালন, তারাবিহ নামাজ আদায় ও ঈদ উদযাপনের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির এক ঐতিহাসিক সম্পর্ক তৈরি হয়।
শেষ কথা : রমজানের অফুরন্ত মহিমা ও সীমাহীন সওগাত লাভের জন্য প্রতিটি মুসলিমের সঠিকভাবে রোজা পালন করা উচিত। আল্লাহ তায়ালা রহমত, নাজাত ও মাগফিরাতের যে অপরিসীম সুযোগ রোজার দিনগুলোতে দান করেছেন তা যদি আমরা কাজে লাগাতে না পারি তা হলে আমরা হবো দুর্ভাগা। আমাদের অবস্থা যেন এমন না হয়ে যায়, আমরা উপবাস করলাম, ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করলাম এবং সাহরি-ইফতার সবই গ্রহণ করলাম অথচ আমাদের রোজাই কবুল হলো না এবং আমরা আল্লাহর নিয়ামতের যোগ্য হতে পারলাম না। মহানবী সা: এ ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘অনেক রোজাদার এমন আছে যাদের রোজায় অনাহারে থাকা ছাড়া কোনো উপকার নেই, আর অনেক লোক রয়েছে যারা রাতে জাগ্রত থেকে নামাজে দ-ায়মান হয় আর জাগরণ ছাড়া তাদের কোনো উপকার নেই।’ তাই রোজার পরিপূর্ণ হক আদায় করে আমাদের রমজানের সিয়াম সাধনায় মনোনিবেশ করতে হবে, যাতে আমরা রোজার পূর্ণ কল্যাণ ও বরকত লাভ করতে পারি এবং আখিরাতের মুক্তি নিশ্চিত করতে পারি। লেখক: শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাবেক ডিএমডি, ইসলামী ব্যাংক, বর্তমানে, হেড অব বিজনেস, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক