সাওম পালন করা প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমের ওপর ফরজ। তবে যারা গুরুতর বা ক্রোনিক রোগে ভুগছেন, সফরে আছেন, অতিশয় বয়স্ক, সন্তানসম্ভবা, দুগ্ধদায়িনী ও রজকালীন নারী তাদের জন্য সওম পালনের পরিবর্তে ফিদিয়া দান বা পরে সমসংখ্যক সাওম পালনের অবকাশ রয়েছে। নিশীথ সূর্যের দেশ বা মেরু অঞ্চলের মুসলিমদের সাওম পালনের জন্য দুই রকম ফতোয়া রয়েছে। কারো মতে, তারা সাওম পালনে ভৌগোলিকভাবে নিকটতম অঞ্চলকে অনুসরণ করবেন যেখানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত ঘটে তথা রাত ও দিনের মধ্যে পার্থক্য করা যায়। কারো মতে, তারা সাওম পালনে মক্কাবাসীকে অনুসরণ করবেন।
রমজানে ভালো কাজের সওয়াব বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেয়া হয়। সাওম পালনকালে মুসলিমগণ পানাহার, মাদক গ্রহণ, যৌনাচার এবং সব প্রকার পাপাচার থেকে বিরত থাকেন। এ মাসে রোজাদাররা সালাত, কুরআন তিলাওয়াত ও দান-সদকার মাধ্যমে আত্মিক শুদ্ধতা ও তাকওয়া অর্জনে সচেষ্ট থাকেন।
২০২২ সালের এ সময়ে বিশ^-মুসলিম উম্মাহ ১৪৪২তম রমাদান পালন করছে। অর্থাৎ বিগত ১৪৪২ বছর ধরে মুসলমানরা রমজান মাসে রোজা পালন করে আসছেন। আল্লাহ তায়ালার লাখো শোকর, এ দীর্ঘ সময়ে একবারের জন্যও সাওম পালনে ছেদ পড়েনি। বিশ^ব্যাপী দীর্ঘ এক মাস ধরে একই সময়ে একই নিয়মে মুসলমানরা সিয়াম পালন করে আসছেন। তবে মাসব্যাপী রোজা পালনের এ রেওয়াজের সাথে যুক্ত হয়েছে দেশ ও অঞ্চল ভেদে কিছু সামাজিক রীতি ও আইনি বাধ্যবাধকতা, যা মূল ইবাদতের কাঠামোয় কোনো রদবদল ঘটায়নি। এ নিবন্ধে আমরা তারই কিছু অংশ আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ।
ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা : রমজান মাসের সাধারণ আনুষ্ঠানিকতা হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সুবহে সাদিকের আভা ফুটে ওঠার সময় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সাওমের নিয়তে পানাহার ও কামাচার হতে বিরত থাকা, রোজার উদ্দেশ্যে শেষ রাতে পানাহার তথা সাহরি খাওয়া, সূর্যাস্তের পর ইফতার করা, রাত জেগে নফল সালাত আদায় করা, কুরআন তিলাওয়াত করা ইত্যাদি। এ মাসে মুসলিমরা সালাত ও কল্যাণ কর্মে বেশি মনোনিবেশ করে থাকেন। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, এ মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ রাখা হয় এবং শয়তানকে শৃঙ্খল পরানো হয়।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য : মাহে রমাদানকে স্বাগত জানিয়ে বিশ্বের মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর পাবলিক স্কয়ার ও নগর তোরণগুলোতে আলোকসজ্জা করা হয়, আতশবাজি ফোটানো হয়। দশম শতাব্দীর মিসর ও উত্তর আফ্রিকীয় অঞ্চলের নবী সা:-এর সন্তানদের সমব্যথী ফাতেমি খলিফা আবু তামিম মাআদ আল-মুয়িজ লি দ্বীনিল্লাহ (৯৫৩-৯৭৫ খ্রি:)-এর সময় এ আলোকসজ্জার প্রচলন শুরু হয় বলে মনে করা হয়।
ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে পবিত্র সরোবরে গোসল করার মাধ্যমে রমজানের প্রস্তুতি শুরু হয়। এ রীতি স্থানীয় মুসলমানদের কাছে ‘পাদুসান’ নামে পরিচিত। জাভার প্রাদেশিক রাজধানী সামারাংয়ে রমজান শুরু হয় দুগদারান উৎসবের মাধ্যমে। রমজান মাসে বিশ্বের মুসলমানগণ পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানাতে বলে থাকেন ‘রমজান মুবারক’ বা ‘রমজান কারিম’।
বিভিন্ন দেশে সাওম পালনকারীর হার : ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক থিংকট্যাংক চবি জবংবধৎপয ঈবহঃৎব কর্তৃক ২০১২ সালে ৩৯টি দেশ ও অঞ্চলে পরিচালিত এক জরিপের তথ্যানুযায়ী সারা বিশ্বে গড়ে ৯৩ শতাংশ মুসলিম রমজান মাসে সাওম পালন করে থাকেন। ওই গবেষণার ফলাফল মতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা এবং সাব-সাহারান আফ্রিকা অঞ্চলের মুসলমানরা অপেক্ষাকৃত বেশি সংখ্যায় সাওম পালন করে থাকেন। একই জরিপের তথ্যানুযায়ী মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ অঞ্চলে রোজাদারের হার তুলনামূলক কম। তবে কমিউনিজমের পতনের পর সাবেক সোভিয়েতভুক্ত মধ্য-এশিয়া অঞ্চলে এবং বুশের তথাকথিত ‘ওয়্যার অন টেরর’ ব্যর্থ হওয়ার পর ইসলামের বিধিবিধান পালনকারী মানুষের হার বৃদ্ধি পেয়েছে।
দেশ-বিদেশের আইনি বাধ্যবাধকতা : কিছু কিছু মুসলিম দেশে রমজান মাসে সাওম পালন না করা অপরাধ। যেমন- সৌদি আরবে শরিয়তের ওজর ছাড়া রমজান মাসে সাওম পালন না করার কথা চিন্তাও করা যায় না। মিসরে রমজান মাসে মদ বিক্রয় নিষিদ্ধ। কুয়েতে রমজানের দিনের বেলায় পানাহার বা ধূমপানের শাস্তি হলো সর্বোচ্চ ১০০ কুয়েতি দিনার জরিমানা অথবা এক মাসের হাজতবাস অথবা উভয় দ-ে দ-িত হওয়া। সংযুক্ত আরব আমিরাতে রমজান মাসের দিনের বেলায় প্রকাশ্যে পানাহারের শাস্তি ১৫০ ঘণ্টা বাধ্যতামূলক কমিউনিটি সার্ভিস।
মালয়েশিয়ায় রমজান মাসের দিনের বেলায় প্রকাশ্যে পানাহার করলে ধর্মীয় পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। সে দেশে দিনের বেলায় খাবার জন্য খাদ্য, পানীয় বা তামাক দ্রব্য বিক্রয় করলে সর্বোচ্চ এক হাজার রিঙ্গিত জরিমানা ও ছয় মাসের কারাদ- ভোগ করতে হয়। আলজেরিয়ায় রমজান মাসে সাওম পালন না করলে অর্থ দ- ও জেলদ- দেয়ার বিধান রয়েছে।
রমজানে কর্মঘণ্টা হ্রাস করা : সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, বাহরাইন ও কুয়েতসহ বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম দেশে রমজান মাসে শ্রমিক ও চাকরিজীবীদের জন্য কর্মঘণ্টা দৈনিক ছয় ঘণ্টা এবং সাপ্তাহিক ৩৬ ঘণ্টার বেশি নয়। বাংলাদেশে রমজান মাসে অফিস-আদালতের কর্মঘণ্টা দৈনিক সাড়ে ছয় ঘণ্টা এবং সপ্তাহে সাড়ে ৩২ ঘণ্টা। (ইমাম বায়হাকির ৯৯৪-১০৬৬ খ্রি:) হাদিস সঙ্কলন শোআবুল ঈমানে সালমান ফারসি রা: (৫৬৮-৬৫৭ খ্রি:) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ সা: রমজান মাসে অধীনস্থদের দায়িত্বভার হ্রাস করতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এই মাসে তার অধীনস্থদের দায়িত্বভার হ্রাস করবে আল্লাহ তাকে মাফ করে দেবেন এবং আগুন থেকে মুক্তি দেবেন।’ (শোআবুল ঈমান, বায়হাকি)
সাওম ও স্বাস্থ্য : ইরানের একদল গবেষক বলেছেন, সাধারণভাবে রোজা পালনে শারীরিক কোনো ক্ষতি হয় না। এমনকি রেনাল ট্র্যান্সপ্লান্ট রোগীদের মধ্যে যাদের অবস্থা ভালো এবং পিত্তে পাথর জমা রোগীদের জন্যও মাসব্যাপী রোজা পালন ক্ষতিকর নয়। তবে মাসব্যাপী রোজা পালন Moderate GFR <60 ml/min রোগী অথবা মারাত্মক কিডনি রোগীদের রেনাল ইনজুরির কারণ হতে পারে (যাদের কিডনি ৮৫ শতাংশ বিকল)।
মোদ্দাকথা হলো, যাদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা নেই তাদের জন্য সাওম পালনে কোনো সমস্যা নেই। রোজার কারণে ওজন কিছুটা কমলেও রোজার শেষে তা দ্রুত পুনরুদ্ধার হয়ে যায়। তবে যাদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা রয়েছে তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে রোজা পালন করা উচিত। কারণ রোগী, দুগ্ধদানকারিণী মা ও মুসাফিরদের জন্য বিকল্প সময়ে সাওম পালনের অবকাশ রয়েছে। কুরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ পীড়িত হলে বা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূরণ করে নিতে হবে। সিয়াম পালন যাদের সাতিশয় কষ্ট দেয় তাদের কর্তব্য হলো এর পরিবর্তে ফিদইয়া তথা একজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান করা (এক দিনের সাওমের পরিবর্তে একজন গরিবকে দুই বেলা পেট ভরে খেতে দেয়া)। (সূরাহ বাকারাহ-১৮৪)
অপরাধের অধঃগতি : রমজান মাসে অপরাধ সঙ্ঘটনের হার কমে যায়। তুরস্ক ও সৌদি আরব পুলিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী তুর্কি শহর ইস্তাম্বুল ও কোনিয়া এবং সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশে রমজান মাসে অপরাধের হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায়। ২০০৫ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী রমজান মাসে সৌদি আরবে ছিনতাই, ডাকাতি ও মাদক সংশ্লিষ্ট অপরাধ হ্রাস পেয়েছে। এর কারণ আমরা রাসূলুল্লাহ সা:-এর বাণীর মধ্যেই খুঁজে পাই। তিনি বলেছেন : রমজান এলে আকাশের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। অন্য বর্ণনা মতে, জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়; জাহান্নামের ফটকগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানকে শিকলবন্দী করা হয়। অন্য বর্ণনা মতে, রহমতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। (বুখারি ও মুসলিম) । ( পূবালী ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার আবু নুসাইবা মুহাম্মাদ নূরুন্নবীর লেখাটি দৈনিক নয়াদিগন্ত অন লাইন থেকে সংকলিত)