ঢাকা আমার প্রিয় ঢাকা কেন তোমার তোমার এই অবস্থা। এই প্রশ্ন আছে প্রতিটি ঢাকাবাসীর। ঢাকা শুধু দেশের প্রশাসনিক রাজধানীই নয়, অর্থনৈতিক দিকে দিয়েও এর গুরুত্ব অন্য যে কোন নগর মহানগরীর চেয়ে বেশি। দেশের মোট জিডিপিতে ঢাকার অবদান প্রায় ৩৬ শতাংশ। দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৩২ শতাংশই হয়েছে এখানে। অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু হলেও স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত নগরীর পরিকল্পিত স¤প্রসারণ ঘটানোর কোনো উদ্যোগই যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৯ সালে নগরীর নিয়ন্ত্রিত স¤প্রসারণে একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল তৎকালীন ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি)। এ পরিকল্পনার মেয়াদ শেষ হয় ১৯৭৯ সালে। এরপর নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত নগরীর স¤প্রসারণ নিয়ে কোনো পরিকল্পনাই ছিল না। আবার নব্বইয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত নগরীর স¤প্রসারণ নিয়ে যত পরিকল্পনা করা হয়েছে, তার কোনোটিই যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। যদিও এ সময়েই নগরীর কলেবর ও জনসংখ্যাÍদুটোই বেড়েছে সবচেয়ে বেশি।
শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, সমাজ-সংস্কৃতির কেন্দ্র হওয়ার দরুন ঢাকায় জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধিও হচ্ছে উচ্চহারে। বর্তমানে ঢাকায় জনসংখ্যার পরিমাণ দুই কোটি ছাড়িয়ে গেছে। সীমিত জায়গায় বিপুল জনগোষ্ঠীর বসবাস হলেও নগরীর আবাসন, যোগাযোগ, স্যানিটেশন, পানি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ আনুষঙ্গিক সব অবকাঠামোই গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। ফলে বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ফ্ল্যাট বাড়িতে বসবাস করছে ঢাকাবাসী, যেগুলোয় নাগরিক পরিষেবা পেতে পদে পদে পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে। তীব্র যানজটে কমেছে শহরের মানুষের গতি। স্বাস্থ্য অবকাঠামো অপ্রতুল। নেই মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নেই খেলার মাঠ, হাঁটার পার্ক।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ সালের পর থেকে ঢাকায় বছরে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ২ দশমিক ৭৪ শতাংশ হারে। বর্তমানে ঢাকার ৪০ শতাংশ আবাসিক এলাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব দাঁড়িয়েছে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৯৯ হাজার জন। ১৯৯১ সালের পর থেকেই ঢাকার উপকণ্ঠগুলোয়ও বাড়তে শুরু করেছে জনসংখ্যার ঘনত্ব। এ সময়ের মধ্যেই ঢাকার স¤প্রসারণ হয়েছে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে। একই সঙ্গে বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে ঢাকার উপকণ্ঠের পরিমাণ। এশিয়া ও আফ্রিকার দ্রুতবর্ধিষ্ণু দেশগুলোর বড় শহরগুলোয় নগরায়ণ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে গবেষণা করছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সেন্টার ফর সাসটেইনেবল, হেলদি অ্যান্ড লার্নিং সিটিস অ্যান্ড নেইবারহুডস (এসএইচএলসি)। সংস্থাটির গবেষণা বলছে, ১৯৯১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ঢাকার মূল শহরের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ শতাংশ হারে। শহর উপকণ্ঠে প্রবৃদ্ধির হার আরো বেশি, ৪৩ শতাংশ। ১৯৯১ সালে ঢাকার উপকণ্ঠের আয়তন ছিল ১১৬ বর্গকিলোমিটার, ২০১৯ সালে হয়েছে ২৩৪ বর্গকিলোমিটার। শিগগিরই ঢাকার উপকণ্ঠের পরিমাণ মূল শহরের আয়তনকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে গবেষণায় ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।
অপ্রতুল নাগরিক সুবিধা, অপরিকল্পিত আবাসন, অসহনীয় যানজট, মৌলিক সুবিধাপ্রাপ্তির অনিশ্চয়তাসহ নানা কারণে ঢাকা এখন পরিণত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বসবাস-অযোগ্য শহরে। পরিকল্পিত রাজধানী গড়ে তুলতে একের পর এক পরিকল্পনা আর মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় সেগুলোর বেশির ভাগই ফলপ্রসূ হয়নি। বিপরীতে অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত প্রবৃদ্ধির ভারে ক্রমেই মৃত নগরে পরিণত হতে চলেছে মেগা সিটি ঢাকা।
গবেষকদের অন্যতম এসএইচএলসির কান্ট্রি লিড এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক ড. শিল্পী রায়। তিনি বলেন, নগর উন্নয়নে নেয়া প্রকল্প অনেক সময়ই প্রাথমিক পর্যায়ে থমকে যায়। অর্থের প্রতিশ্রুতি পেয়ে ব্যয়বহুল বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী হয়ে উঠছি আমরা। সেক্ষেত্রে মূল পরিকল্পনা উপেক্ষিতই থেকে যায়। তিনি আরো বলেন, একদিকে ঢাকার আয়তন বাড়ছে, অন্যদিকে আশপাশের এলাকায়ও নগরায়ণ হয়েছে। শিল্প-কারখানা ঢাকার বাইরে সরিয়ে নেয়ার পর ভাবা হয়েছিল চাপ কিছুটা কমবে। কিন্তু দেখা গেল সেগুলো নগরের পার্শ্ববর্তী এলাকায়ই সরানো হয়েছে। অপরিকল্পিত ঢাকায় যেটুকু পরিকল্পিত এলাকা রয়েছে, সেগুলোয় মূলত সম্পদশালী ও উচ্চমধ্যবিত্ত মানুষের বাস। গুলশান, বারিধারার মতো পরিকল্পিত এলাকায় উন্নত আবাসন, ভালো সড়ক অবকাঠামো, স্যানিটেশন, পানি, বিদ্যুৎসহ আনুষঙ্গিক নাগরিক সুবিধা বিদ্যমান। মধ্যবিত্ত ও নি¤œ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের বসবাসের মূল জায়গা অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা আবাসিক এলাকা। মানবেতরভাবে বসবাস করছে নি¤œবিত্ত শ্রেণীর মানুষ।
যদিও ঢাকার নগরায়ণের ইতিহাস অনেক পুরনো। ১৮৬৪ সালে পৌরসভায় পরিণত হওয়ার পর ব্রিটিশ শাসকরা ঢাকার পরিষেবা খাতে বিনিয়োগ এবং প্রশাসনিক অবকাঠামো নির্মাণে মনোযোগ দেয়। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ নগর পরিকল্পনাবিদ স্যার প্যাট্রিক গেডেসের নেতৃত্বে ঢাকার জন্য প্রথম ভৌত পরিকল্পনা প্রস্তুতের কমিশন গঠন করা হয়। ওই সময়ের ঢাকা টাউন প্ল্যানিং প্রতিবেদনটি ছিল ভবিষ্যৎ মহাপরিকল্পনার একটি ধারণাপত্র। যদিও গবেষকরা বলছেন, ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ঢাকার স¤প্রসারণ ঘটেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
দেশভাগের পর ক্রমবর্ধমান শহরগুলোর জন্য বিশদ আইনীকরণ ও সংবিধিবদ্ধ মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়। ১৯৫৬ সালে ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি) প্রতিষ্ঠার পর (বর্তমানে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউক) ব্রিটিশ পরিকল্পনাবিদদের তত্ত্বাবধানে এবং ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের সহায়তায় একটি পরিকল্পনা কমিটি গঠিত হয়। কমিটির মূল উদ্দেশ্য ছিল ১৯৫৯ সালের মধ্যে নগরীটিকে নিয়ে পরবর্তী ২০ বছরের জন্য একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করা। পরিকল্পনাটিকে ধরা হয়েছিল ঢাকার স¤প্রসারণ কাঠামো হিসেবে। এতে শহরের মৌলিক স্থানিক কাঠামো তৈরি করতে প্রধান সড়ক, রেললাইন এবং ভূমি ব্যবহারের অঞ্চলগুলো চিহ্নিত করা হয়েছিল।
১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে স্বাধীন বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশন ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা প্রস্তুত করার জন্য ব্রিটিশ শহর পরিকল্পনা সংস্থা শ্যাঙ্কল্যান্ড কক্সকে চুক্তিবদ্ধ করে। তবে অনুমোদনের আগেই এটি পরিত্যক্ত হয়ে যায় এবং পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য ঢাকার জন্য কোনো পরিকল্পনাই ছিল না। ঢাকার নগর পরিকল্পনায় টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে ধরা হয় ১৯৯০-এর দশককে। ১৯৯৫-২০১৫ সালের জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান (ডিএমডিপি) এবং বিশদ অঞ্চল কর্মপরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রণয়ন করা হয়। পাঁচ বছর পর ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান (২০১৬-২০৩৫) এবং ড্যাপ (২০১৬-২০৩৫) এখনো খসড়া পর্যায়ে রয়ে গেছে। কিন্তু এসব পরিকল্পনা ও উদ্যোগের খুব কমই অর্জন করা হয়েছে। ঢাকা শহর ঘিরে পরিবহন সম্পর্কিত পরিকল্পনার মৌলিক প্রস্তাবগুলোর মানোন্নয়ন হয়নি। গণপরিবহনের উন্নতি হয়নি, বাসরুটগুলোকে শৃঙ্খলায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হলেও তা কাজে লাগেনি। ফুটপাতের মানোন্নয়ন করার উদ্যোগ নেয়া হলেও তা করা হয়নি। ভূমি-ব্যবহারের পরিকল্পনা এবং যানবাহন পরিকল্পনা উভয়ের মধ্যেই সমন্বয় প্রয়োজন। আবার পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর মধ্যেও সমন্বয়হীনতার অভিযোগ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এখানে প্রচুর অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে বা বড় ধরনের বাজেট করা হচ্ছে। কিন্তু শহরের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কোনো ধরনের উদ্যোগ নেই।
ঢাকাকে ঘিরে যেসব পরিকল্পনা করা হচ্ছে সেগুলোর বাস্তবায়নকে দীর্ঘমেয়াদি বলে অভিহিত করেছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী ও ড্যাপ রিভিউ-সংক্রান্ত গঠিত মন্ত্রিসভা কমিটির আহ্বায়ক মো. তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। পৃথিবীর যেসব দেশে উন্নয়ন হয়েছে সেসব দেশের অধিবাসীদেরই কিছু না কিছু দুর্দশা ভোগ করতে হয়েছে। এটাকে বলে ‘ডেভেলপমেন্ট পেইন’। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। দেশের উন্নয়ন হচ্ছে এজন্য কিছু জনদুর্ভোগ-ভোগান্তি তৈরি হচ্ছে। এসব ভোগান্তি লাঘবে আমাদের আরো কিছু মেগা প্রজেক্ট নিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ অতি ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। প্রতি বর্গমাইলে ১৩-১৪শ মানুষ এখানে বসবাস করে। উচ্চ জনবসতির দেশে যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে কিছুটা ভোগান্তির মধ্যে পড়তেই হবেÍএর কোনো তাৎক্ষণিক সমাধান নেই। জনগণ যে ভোগান্তিতে পড়ছে বিষয়টি সরকার যথেষ্ট অবহিত। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার আরো বেশি উন্নতি হবে। এসব বিষয় মাথায় রেখে সরকার বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার করা হচ্ছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়ে গেলে তখন ঢাকার ওপর চাপ অনেকখানি কমে আসবে। তখন আশা করা যায়, ঢাকা বসবাসের জন্য আদর্শ নগরী হয়ে উঠবে।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী সভাপতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকা শহরে খাল বা জলাভূমির মতো সংরক্ষিত যেসব এলাকা ছিল তার অধিকাংশই গত ১০-১৫ বছরে ধ্বংসের সম্মুখীন। এগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। আবাসন কোম্পানিগুলো নির্বিচারে জলাভূমিতে মাটি ভরাট করছে। ফলে যে দূষণ হচ্ছে তা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ঢাকার জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সরকার উদ্যোগ নিয়েছিল কিন্তু সেটি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। অথচ বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার প্রস্তাবে জনঘনত্ব ব্যবস্থাপনার যে ধরনের উদ্যোগগুলো ছিল তার বিরুদ্ধে আবাসন ব্যবসায়ীরা দাঁড়িয়ে গেছেন। কিন্তু বাসযোগ্যতার মানদ-ে শহরটি আর কতটুকু ধারণ করতে পারবে, তা বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। সরকার এ ধরনের বেসরকারি খাতের কাছে অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছে। এ জিম্মিদশার কারণে সরকারের অনেক আদর্শ পরিকল্পনাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।