শ্রীলংকার মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলার। এ ঋণ পরিশোধ করা দেশটির পক্ষে সম্ভব নয় বলে ঘোষণা দিয়েছে ক্ষমতাসীন রাজাপাকসে সরকার। তাদের বক্তব্য হলো মহামারী ও ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য হারিয়েছে শ্রীলংকা। ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে গেলে দেশটির পক্ষে আর খাবার বা জ্বালানি আমদানি করা সম্ভব হবে না। স্বাধীনতার পর সাত দশকের ইতিহাসে এবারই সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশটি। আমদানির সামর্থ্য হারানোয় শ্রীলংকার বাজারে খাবার ও জ্বালানির সরবরাহ প্রায় বন্ধ। বিদ্যুৎ উৎপাদন নেমে এসেছে সর্বনি¤œ পর্যায়ে। জরুরি ওষুধের ঘাটতি দেশটির জনসাধারণের জন্য প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্থানীয় চিকিৎসকরা। অর্থনীতির প্রতিটি খাতেই মারাত্মক ভগ্নদশা। বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে দেশটির মানুষ। শ্রীলংকার এ অবস্থার জন্য ক্ষমতাসীন রাজাপাকসে পরিবারকে দায়ী করছে তারা। তাতে দ্বিমত নেই অর্থনীতির স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদেরও। তাদের ভাষ্যমতে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা এক পরিবারের হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়ার কারণেই আজকের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে শ্রীলংকা। এতদিন শ্রীলংকার জাতীয় বাজেটের প্রায় ৭৫ শতাংশই নিয়ন্ত্রণে ছিল রাজাপাকসেদের। এ পরিবারের সদস্যরা এতদিন গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে দেশটির সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের দায়িত্ব পালন করেছেন। অর্থনীতির সংকট ঘনীভূত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পুরো মন্ত্রিসভাই পদত্যাগ করে। পদত্যাগকারীদের মধ্যে রাজাপাকসে পরিবারের সদস্যরাও রয়েছেন। পদ আঁকড়ে রাখেন শুধু প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া ও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। নতুন করে মন্ত্রিসভার ঘোষণা দিলেও টালমাটাল হয়ে পড়েছে রাজাপাকসে সরকারের শাসন। এরই মধ্যে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে ফেলেছে তারা। পরিবারটির কোনো কোনো সদস্য এরই মধ্যে গোপনে দেশত্যাগও করেছেন বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে।
শ্রীলংকার অর্থনৈতিক বিকাশের পথে বাধা হিসেবে দেশটিতে দীর্ঘদিন চলা গৃহযুদ্ধকে দায়ী করেছে শ্রীলংকা সরকার। গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দেড় দশকেও প্রগতির ধারায় ফিরতে পারেনি দেশটির অর্থনীতি। এজন্য অর্থনীতির দুর্বল ব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, বিদেশী ঋণে একের পর এক অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প গ্রহণকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা। অন্যদিকে ২০১৯ সালে রাজাপাকসে পরিবার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এক প্রকার অর্থনৈতিক দুর্বিপাকের মধ্যে রয়েছে দেশটি। পরিস্থিতি শোচনীয় করে তোলে কভিডের প্রাদুর্ভাব। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এ সংকট রূপ নেয় জাতীয় দুর্যোগে। এ সময়ের মধ্যে শ্রীলংকা ক্রমেই দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে পড়লেও সম্পদশালী হয়েছে রাজাপাকসে পরিবার। সম্প্রতি প্রকাশিত প্যান্ডোরা পেপারসে মাহিন্দা ও গোতাবায়া রাজাপাকসের ভাতিজি নিরুপমা রাজাপাকসে এবং তার স্বামী থিরুক্কুমারান নাদেসানের বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার ও অননুমোদিত বিনিয়োগের তথ্য উঠে এসেছে। শ্রীলংকার সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক এমপি নিরুপমা রাজাপাকসে গত সপ্তাহে ব্যাপক বিক্ষোভের মধ্যেই দুবাইয়ের উদ্দেশে শ্রীলংকা ত্যাগ করেছেন বলে দেশটির স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে।
রাজাপাকসে পরিবারের রাজনীতি আবর্তিত হয় প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসেকে ঘিরে। ২০০৫ সালে প্রথম শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি। সে সময় তিনি বড় ভাই চমল রাজাপাকসেকে পার্লামেন্টের স্পিকার হিসেবে নিয়োগ দেন। আরেক ভাই বাসিল রাজাপাকসেকে নিয়োগ দেয়া হয় অর্থনৈতিক উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে। প্রতিরক্ষা ও নগর উন্নয়ন সচিবের দায়িত্ব পান গোতাবায়া রাজাপাকসে। প্রতিরক্ষা, অর্থ, বন্দর, বেসামরিক বিমান চলাচল এবং মহাসড়ক যোগাযোগ উন্নয়ন মন্ত্রণালয় নিজের হাতেই রেখে দেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। এছাড়া পরিবারের অন্য সদস্যদের রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। গৃহযুদ্ধে এলটিটিইকে দমনের দায়িত্ব দেয়া হয় সাবেক সামরিক কর্মকর্তা গোতাবায়া রাজাপাকসের কাঁধে। তার নিয়ন্ত্রণাধীন শ্রীলংকার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ওই সময় ব্যাপক যুদ্ধাপরাধ ও নির্মমতার অভিযোগ ওঠে। ২০১০ সালে আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মাহিন্দা রাজাপাকসে। সে সময়ও দেশটির রাজনীতি ও অর্থনীতিতে রাজাপাকসে পরিবারের আধিপত্য বজায় থাকে। রাজাপাকসে ভাইদের পিতা শ্রীলংকার সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও পার্লামেন্টের ডেপুটি স্পিকার ডন আলভিন রাজাপাকসের মৃত্যু হয়েছিল অনেকটা কপর্দকহীন অবস্থায়। তার নয় সন্তানের সবাই তখন অধ্যয়নরত। তাদের পড়াশোনার খরচ জোটানোই সে সময় মুশকিল হয়ে পড়েছিল। কালের পরিক্রমায় ডন আলভিনের পরিবার হয়ে ওঠে শ্রীলংকার সবচেয়ে প্রভাবশালী ও অন্যতম ধনী পরিবার। দেশটির জাতীয় বাজেটের ৭০ শতাংশেরও বেশির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তার পরিবারের সদস্যদের হাতে।
ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয় হলেও ৭৪ বছর বয়সী মাহিন্দা রাজাপাকসেকেই বলা হয় পরিবারের প্রধান। ২০০৪ সালে প্রথমবারের মতো শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। প্রেসিডেন্ট ছিলেন ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত। এরপর ২০১৮ সালে আড়াই মাসের জন্য প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন তিনি। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ভাই গোতাবায়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এরপর মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রিত্বের পদে ফিরে আসেন।
বিরোধী দমনে নির্মমতার জন্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ‘দ্য টারমিনেটর’ হিসেবে পরিচিত প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। ভাই মাহিন্দা প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তার বাহুবল হয়ে উঠেছিলেন গোতাবায়া। সে সময় প্রতিরক্ষা সচিব হিসেবে শ্রীলংকার সশস্ত্র ও নিরাপত্তা বাহিনীর দৈনন্দিন কার্যক্রমে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। তামিল বিদ্রোহীদের দমন কার্যক্রমও সরাসরি তার তত্ত্বাবধানেই পরিচালিত হয়েছে। গৃহযুদ্ধ চলাকালে তামিল জনগোষ্ঠীর ওপর নির্মম নিপীড়ন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, সাংবাদিক নির্যাতন ও হত্যাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
বলা হয়, রাজাপাকসে পরিবারের রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণের কাজটি করে থাকেন বাসিল রাজাপাকসে। চলতি মাসের শুরুতে পদত্যাগ করার আগ পর্যন্ত শ্রীলংকার অর্থমন্ত্রী পদে নিয়োজিত ছিলেন। মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রেসিডেন্ট থাকাকালেও একই দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন তিনি। দ্বৈত নাগরিকত্বের কারণে একসময়ে শ্রীলংকার পার্লামেন্টে প্রবেশের পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। যদিও ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে সে বাধাও দূর করা হয়। তার বিরুদ্ধে অনেক আগে থেকেই দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। দুর্নীতির জন্য মি. টেন পার্সেন্ট নামেও পরিচিতি পেয়েছিলেন তিনি। সর্বশেষ অর্থমন্ত্রী থাকাকালে শ্রীলংকা সরকারের অসময়োচিত কর হ্রাসের সিদ্ধান্তে তিনি মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন বলে কথিত রয়েছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে শ্রীলংকা সরকারের রাজস্ব আয় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চলতি মাসের শুরুতে রাজাপাকসে মন্ত্রিসভার অন্য সব সদস্যের সঙ্গে পদত্যাগ করেছেন সেচমন্ত্রী চমল রাজাপাকসে। পদত্যাগের আগে একই সঙ্গে দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করছিলেন তিনি। অতীতে মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে শ্রীলংকার পার্লামেন্টের স্পিকারের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। রাজনীতিতে নামার আগে তিনি ছিলেন পুলিশের কর্মকর্তা। বিশ্বের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী সিরিমাভো বন্দরনায়েকের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ছিলেন তিনি। বিনা প্রস্তুতিতে শ্রীলংকার কৃষিকে শতভাগ অর্গানিক করতে গিয়ে দেশটিতে খাদ্য সংকট তীব্র করে তোলার ক্ষেত্রে তাকে অনেকাংশেই দায়ী করা হয়।রাজাপাকসে ভাইদের পরের প্রজন্মের মধ্যে রাজনীতিতে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ধরা হয় নমল রাজাপাকসেকে। মাহিন্দা রাজাপাকসের জ্যেষ্ঠ পুত্র নমল শ্রীলংকার পার্লামেন্টে প্রথম পা রাখেন ২০১০ সালে। সে সময় তার বয়স ছিল মাত্র ২৪। ওই সময় পিতার মন্ত্রিসভায় ঠাঁই না পেলেও বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, শ্রীলংকার ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট তথা রাজাপাকসেদের রাজনৈতিক সাম্রাজ্যের ভাবী উত্তরসূরি হিসেবে তাকে গড়ে তুলছেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। অতীতে তার বিরুদ্ধেও দুর্নীতি ও মুদ্রা পাচারের অভিযোগ এসেছে।