কথায় কথায় চটে যাচ্ছেন। ধমকাচ্ছেন। গালিও দিচ্ছেন যা-তা। শান্ত না হতে পেরে অধঃস্তনের গায়ে হাত পর্যন্ত তুলছেন। দিন শেষে হিসাব কষে কেউ হয়তো অনুশোচনায় ভোগছেন, ছোটকে ডেকে দরদ ঢালছেন অথবা কেউ বড়ত্ব ধরে রাখতে উল্টো মাজলুমের ঘাড়েই পা রাখছেন। এই দৃশ্য বছরে কদাচিৎ হলেও রমজানে ঘটছে প্রায়ই। ক্ষেত্র বিশেষে নিত্যকার ছবি এটি। অফিসের বস থেকে শুরু করে গৃহকর্তাও একই রূপ দেখাচ্ছেন গৃহ সদস্যদের সামনে। কাজের মেয়ে-ছেলে হলে তো কথাই নেই। সীমাহীন নির্যাতন এদের ওপর অনেক গৃহকর্ত্রী বা কর্তা করে থাকেন। খাবার-দাবারের বৈষম্য সে তো আছেই। মাঝে-মধ্যে দু-চারটা ঘটনা মিডিয়ার বদৌলতে ভাইরাল হলেও; হাজারটা থেকে যায় আড়ালে। গাড়িওয়ালা, বাড়িওয়ালা কিংবা ফেরিওয়ালা, সব ওয়ালাই রমজানে মেজাজ হারাচ্ছেন কমবেশি। বাজারে যাবেন, দু’-চার ১০টা ঝগড়া চোখে পড়বেই। গাড়িতে চড়বেন, সেখানেও চিৎকার-চেঁচামেচি, গালাগালি, হাতাহাতি এসব কমন দৃশ্য। কর্মক্ষেত্রে তো আছেই। রসিকরা এসব দেখে বলেন, ‘রোজায় ধরছে’! কথা ঠিক ‘রোজায় ধরছে’। মেডিক্যাল সায়েন্স তা-ই বলে। আমরা যত খাবার গ্রহণ করি হোক সেটি কার্বোহাইড্রেড, প্রোটিন কিংবা ফ্যাট সেগুলো হজম হয়ে রূপান্তরিত হয় গ্লুকোজ, অ্যামিনো এসিড ও ফ্যাটি এসিডে। এরপর রক্তে মিশ্রিত হয়ে সেগুলো পৌঁছায় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আর টিস্যু-কোষে। যার ফলে দেহে শক্তি সঞ্চার হয় এবং আমরা কাজের সক্ষমতা লাভ করি। রোজার দিনে যেহেতু খাবারে লম্বা বিরতি পড়ে তাই রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে যায় ফলে শরীর নিস্তেজ হতে শুরু করে। এদিকে আবার শরীরের যাবতীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিচালক মস্তিষ্ক গ্লুকোজের বেশির ভাগ নিজের দখলে রাখে। কারণ সে কাজ করে সবার চেয়ে বেশি। কিন্তু পেটের খাবারের অভাবে সবার মধ্যে দীনতা শুরু হয়। সেও পর্যাপ্ত খাদ্য পায় না। তাই গ-গোল বাধে সব কিছুতে। মাথা ঠিকমতো কাজ করে না। ভুল বেশি বেশি হয়। হাত-পা অচলের মতো হতে শুরু করে। কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। মেজাজ খিটমিটে হতে থাকে। ক্রমশ মানুষ নিজের নিয়ন্ত্রণ হারায়। কাউকে গালি দেয়। কাউকে ঝাড়ি দেয়। অল্প কথায় চটে যায়। ইত্যাদি ইত্যাদি খারাপ আচরণ তখন প্রকাশ পেতে থাকে।
তাই ইসলামের নির্দেশনা হলো- রোজার দিনে কাজ কম করা। কষ্টকর কাজ দিনের বেলা না করা। কর্মচারীদেরও কাজ কম দেয়া। বিশেষ করে বিকেল বেলায় ফ্রি থাকা এবং জিকির-আজকারে লেগে থাকা।
এ তো গেল ক্ষুধার কথা। চৈত্রের কাঠফাটা দুপুর আর গ্রীষ্মের প্রচ- তাপদাহও কিন্তু এসবের জন্য দায়ী। তাপমাত্রা এরই মধ্য ৩০-৩৭-এ ওঠানামা করছে। এই গরমে মেজাজ হারানো স্বাভাবিক বিষয়। এরপরও আছে লম্বা উপবাস। গরমের তীব্রতাকে হাদিসে জাহান্নামের নিঃশ্বাসের সাথে তুলনা করা হয়েছে এবং গরমে সর্বাপেক্ষা বড় ইবাদত নামাজকেও বিলম্বে পড়তে তাকিদ দেয়া হয়েছে। কারণ অতিরিক্ত গরম মননে বিরূপ প্রভাব ফেলে। তা ছাড়া অবসাদ, বিষণœœতা, চাপা ক্ষোভ, অঘুম ইত্যাদি কারণেও মেজাজ হারানোর মতো ঘটনা ঘটতে পারে। এ জন্য পারিপার্শ্বিক সব কারণ দূর করার চেষ্টা করতে হবে। উপবাসের নামই যেহেতু রোজা সেটা তো দূর করা সম্ভব না। তাই রাগ উঠলে শরিয়তের পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করা যেতে পারে। ইস্তেগফার করা। অবস্থান পরিবর্তন করা। দাঁড়ানো থাকলে বসে পড়া আর বসে থাকলে শুয়ে পড়া। অজু করা। তারপরও রাগ না থামলে ঠা-া পানি দিয়ে গোসল করা।
রাগ নিয়ন্ত্রণ মুমিনের একটি বড় প্রশংসনীয় গুণ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘রাগ হজমকারী এবং ক্ষমাকারীরা (সৎকর্মশীল) আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন।’ (সূরা আলে ইমরান-১৩৪) হাদিস শরিফে এসেছে, এক ব্যক্তি নবীজী সা:-এর কাছে এসে বলল, ‘আমাকে উপদেশ দিন’। তিনি বললেন, ‘রাগ করো না’। সে ব্যক্তি কয়েকবার এ কথা বলল। রাসূলুল্লাহ সা: প্রত্যেকবার বললেন, ‘রাগ করো না’। (সহিহ বুখারি-৬১১৬) অন্য হাদিসে তিনি বলেন, ‘সে শক্তিশালী নয়, যে কুস্তিতে লড়ে অপরকে ধরাশায়ী করে; বরং প্রকৃতপক্ষে সে-ই শক্তিশালী, যে রাগের সময় নিজেকে সংবরণ করে।’ (সহিহ বুখারি-৬৮০৯)
এ তো গেল কুরআন-হাদিসের কথা। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটু গভীরভাবে ভাবা যাক। আমরা সবাই মানুষ। অফিসের বস আর পিয়ন, কর্মচারী আর কর্মকর্তা গৃহকর্ত্রী আর কাজের বুয়া সবাই মানুষ হিসেবে সমান। আল্লাহ আমায় যোগ্যতা দিয়ে পদের অধিকারী করে কর্মকর্তা বানিয়েছেন। চাইলে অধঃস্তন করে কর্মচারীর কাতারে আনতে পারতেন। অফিসের পিয়ন বা দফতরি আমিও হতে পারতাম। কাজের মেয়ে-ছেলে আল্লাহ আমাকেও বানাতে পারতেন। তখন আমার সাথে কেউ খারাপ ব্যবহার করলে কেমন লাগত। হাত-পা-নাক-কান-চোখ-মুখসহ শারীরিক সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সবারই সমান (প্রতিবন্ধী বাদে) রক্ত-মাংস তো সবারই এক। সাদা-কালো কিংবা ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান থাকলেও দেহাভ্যন্তরে মনোজগতের ব্যবধান সামান্য। একজন মনে করে আমি অযোগ্য গরিব তাই কাজ করে খাই। অন্যজন ভাবে আমি মালিক বা কর্তা যোগ্যতা বা সম্পদের বলে বসে বসে খাই। কিন্তু হৃদয়ের উত্থান-পতন দু’দেহেই সমানভাবে ঘটে। সুখ-দুঃখের অনভূতি দু’জনেরই আছে। আত্মমর্যাদাবোধ সবারই থাকে। সুতরাং কোনো মুমিনকে অন্যায়ভাবে মুখ কিংবা হাত দিয়ে কষ্ট দেয়া কঠিন গোনাহের কাজ।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’ (সূরা আহজাব-৮৫) হাদিসে প্রিয় নবী সা: বলেন, ‘আল মুসলিমু মান সালিমাল মুসলিমুনা মিন লিসানিহি ওয়া ইয়াদিহি’-অর্থাৎ সত্যিকারের মুসলিম হলো সে ব্যক্তি যার মুখ ও হাত থেকে অপরাপর মুসলিম নিরাপদ থাকে।’(সহিহ বোখারি-৬৪৮৪)
তাই রোজাদার ভাই-বোনদের নিবেদন করব রাগ দমনের। রাগ দমনকারীর জন্য পুরস্কারও রয়েছে। ১. আল্লাহ তায়ালা তাদের ভালোবাসেন। (সূরা আলে ইমরান-১৩৪) ২. ঈমান দ্বারা তাদের অন্তর ভরপুর করে দেয়া হবে। (মুসনাদে আহমদ প্রথম-৩২৭) ৩. পরকালে আল্লাহর ক্রোধ থেকে মুক্তি মিলবে (সহিহ ইবনে হিব্বান-২৯৬) ৪. হাশরের মাঠে যেকোনো হুরকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পাবে। (আবু দাউদ-৪৭৭৭) ও ৫. তারা জান্নাতি হবে (তাবারানি-২৩৫৩)
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামী গবেষক