অনলাইনে ফলটি দেখে আমার পছন্দ হয়। পরে ইউটিউবে ভিডিও দেখি। তরমুজ ফলটির ওপরে এক রং, ভেতরে আরেক রং। তাই চাষ করার সিদ্ধান্ত নিই। গত বছর ভাড়ায় ২০ শতাংশ জমিতে শুরু করি এর চারা লাগানো। পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই শুধু ভিডিও দেখে হলুদ তরমুজ চাষে প্রথমবারের মতো সফলতা পেয়েছেন কৃষক আনোয়ার হোসেন বেপারী। গত বছর পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করার পর এ বছর ভালো সাফল্য পেয়েছেন আনোয়ার। শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার পূর্ব ডামুড্যা ইউনিয়নের মতি বেপারীর ছেলে আনোয়ার হোসেন বেপারী। পরিবারে তার স্ত্রী ও ২ মেয়ে রয়েছে।
জানা গেছে, ছোটবেলা থেকেই কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত আনোয়ার। গত বছর তরমুজের ভিডিও দেখে খোঁজ শুরু করেন কালো তরমুজ-বীজের। এরপর বীজ সংগ্রহ করে ২০ শতাংশ জমিতে এক বছরে দুবার পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করেন। এতে প্রথমবার তার খরচ হয় ৫০ হাজার টাকা। এ বছর এখন পর্যন্ত দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তার খেতে হলুদ তরমুজ ছাড়াও দেশি তরমুজ ও সৌদি আরবের ফল সাম্মামও চাষ হচ্ছে।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গ্রীষ্মকালীন সবজির পাশাপাশি স্বল্প পরিমাণ জমিতে ‘গোল্ডেন ক্রাউন’ তরমুজ ভালো ও লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। গোল্ডেন ক্রাউন তরমুজ অত্যন্ত পুষ্টিগুণসম্পন্ন সুস্বাদু ফল। এই ফল সাধারণত উঁচু জমি এবং দোআঁশ মাটিতে চাষের জন্য উপযুক্ত। সাধারণত তরমুজ মাটিতে হলেও এটি মাচায় বড় হয়। বীজ বপনের ২৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে। বিক্রি শুরু করা যায় ৫৫ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে।
সরেজমিনে দেখা যায়, দুটি ভাগে ভাগ করে তরমুজের চারা লাগনো আছে। পুরো জমিতে বাশের খুঁটির ওপরে জাল বিছিয়ে মাচা তেরি করা হয়েছে। এতে তরমুজগাছের লতা বেড়ে উঠেছে। পুরো মাচা গাছে ছেয়ে আছে। মাচার মধ্যে সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঝুলে আছে বিভিন্ন সাইজের বাহারি তরমুজ। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ক্রেতাদের পদচারণ হয় এখানে। তবে বিকেলে অনেক লোক আসে তরমুজ কেনার জন্য। তরমুজ কেনার পর সবাই ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
আনোয়ার হোসেন বেপারী বলেন, আমি ইউটিউবে ফলটি দেখে চাষ করার সিদ্ধান্ত নিই। পরে বীজ সংগ্রহ করি। ২০ শতাংশ জমি ইজারা নিয়ে শুরু করি চাষ। কিন্তু সেই চারাগুলোয় কোনো ফল হয়নি। বিভিন্ন জায়গা দিয়ে ফুল হয়েছে। তিন মাস রাখার পর সব উঠিয়ে ফেলি। তখন ইউটিউবে গোল্ডেন ক্রাউন তরমুজটি দেখি। ভিডিওতে দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী দিনাজপুর থেকে বীজ সংগ্রহ করি। আবার আমি গোল্ডেন ক্রাউন, পাকিজা ও ড্রাগন জাতের তরমুজ করার জন্য জমি প্রস্তুত করি। সেখানে এই তরমুজ লাগিয়ে ভালো ফলন পাই।
খরচ ও লাভের বিষয়ে আনোয়ার বলেন, আমি লসের মুখে ছিলাম। তারপরও এই তরমুজ চাষ থেকে কোনোভাবে পিছপা হইনি। গতবার ২০ শতাংশ জমিতে তরমুজ লাগিয়েছি। এ বছর বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ জমিতে চাষ করেছি। এবারও জমি প্রস্তুতের পর থেকেই বিভিন্ন রোগ-বালাই হচ্ছে কিন্তু তার কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না। তবে ভালো লাগছে যে বাহারি তরমুজ এখন আমার জমিতে। এই তরমুজের চাহিদা অনেক। মাঠ থেকে ক্রেতারা কিনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতি কেজি তরমুজের দাম রাখা হচ্ছে ৮০ টাকা করে। একেকটি তরমুজ তিন থেকে পাঁচ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এ মৌসুমে পাঁচ লাখ টাকার তরমুজ বিক্রি করার আশা করছি।
কৃষি অফিস থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পাননি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে আনোয়ার বলেন, সরকার উদ্যোক্তা তৈরি করছে। কিন্তু আমরা তা হতে পারছি না। আমাদের মাঠে কৃষি অফিস থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা করেনি। আমি নিজের মতো করে গাছের যতœ করি। উপজেলা থেকে কোনো ধরনের সার বা কীটনাশক আমাকে দেয়নি।
তরমুজ ক্রেতা পাখাল রাব্বি বলেন, গত বছর আমি আনোয়ার ভাইর ক্ষেতে তরমুজ নেওয়ার জন্য আসছিলাম। কিন্তু তরমুজের ফলন তেমন না হওয়ায় নিতে পারিনি। এ বছর প্রথম প্রথম চলে আসছি নেওয়ার জন্য। আসার পর দেখি অনেকেই আসছে তরমুজ নিতে। তার তরমুজ খেতেও অনেক সুস্বাদু। আমি এর আগে এই তরমুজ দেখিনি কোথাও। তাই তরমুজ ক্ষেতে আসলাম দেখার জন্য ও নেওয়ার জন্য।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হাসান আলী বলেন, আমি ইউটিউবে এই তরমুজের ভিডিও দেখেছিলাম। কিন্তু কখনো খাইনি। গতকাল আমার এক সহকারী শিক্ষকের কাছ থেকে জানতে পেরে এখানে চলে আসলাম তরমুজ কেনার জন্য। আসার পর দেখলাম এখানে দুই ধরনের তরমুজ রয়েছে। হলুদ ও ব্লু। আমি দুটি তরমুজ কিনেছি। প্রথম এ ধরনের তরমুজ নিচ্ছি, তাই দাম নিয়ে কোনো কথা বলিনি। আমরা কয়েকজন মিলে তরমুজ খেতে তরমুজ কিনতে এসেছি। আমি তরুণ কৃষকদের বলব, আপনারা আনোয়ার বেপারির মতো করে তরমুজ চাষে উদ্যোগী হয়ে সফল হতে পারবেন। আরেক ক্রেতা ফাহিম হোসেন বলেন, লোকমুখে শুনে এসেছি এই তরমুজের নাম। আজ নিজেই হাজির হলাম আনোয়ার ভাইয়ের তরমুজের ক্ষেতে। তরমুজের ক্ষেতে এসে মনটা ভরে গেল। পুরো ঘুরে ক্ষেত দেখলাম এবং নিজ পছন্দ করে কেমিক্যালমুক্ত তরমুজ কিনলাম। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শেখ আজিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এই এলাকা শীতকালীন সবজির জন্য বিখ্যাত। তরমুজের জন্য নয়। আমি আনোয়ার বেপারীর জন্য কারিগরি বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি।