রপ্তানির আড়ালে দেশ থেকে যাতে কোনো অবস্থাতেই অর্থ পাচার না হতে পারে সেজন্য ব্যাংকগুলোকে নজরদারি জোরদার করতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, এখন থেকে রপ্তানি পণ্যের বিপরীতে পেমেন্ট এলে তার শিপমেন্ট হয়েছে কি না, ব্যাংকগুলোকে কন্টেইনার ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করতে হবে।
এতোদিন শুধু ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারদের ইস্যু করা পরিবহন দলিলের মাধ্যমে পণ্য রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে শিপমেন্ট ট্র্যাকিং করা বাধ্যতামূলক ছিল। গত বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ পলিসি ডিপার্টমেন্ট’ রপ্তানি পণ্যের শিপমেন্ট নিশ্চিত সংক্রান্ত এক সার্কুলার জারি করে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠিয়েছে।
তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) জারি করা বাণিজ্যভিত্তিক মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিষয়ক গাইডলাইন অনুযায়ী শিপমেন্ট ট্র্যাকিং করা বাধ্যতামূলক। কারণ রপ্তানির ক্ষেত্রে শিপমেন্ট হয়নি তারপরও চলে আসছে অর্থ- এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে তাই এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ‘এখন থেকে কোনো রপ্তানির বিপরীতে অর্থ এলে তার শিপমেন্ট হয়েছে কি না তা কন্টেইনার ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো নিশ্চিত হবে।’ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে দেশ থেকে অর্থ পাচারের তথ্য দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনায় রয়েছে। আমদানি ও রপ্তানি- এই দুই ধরনের বাণিজ্যের মাধ্যমেই অর্থ পাচার হয়। আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং (পণ্যের যে দাম তার থেকে বেশি দেখিয়ে) অর্থ পাচার হয়ে থাকে। আর রপ্তানির ক্ষেত্রে ঠিক উল্টো কাজটি করা হয়ে থাকে, যেটাকে আন্ডার ইনভয়েসিং বলে। এক্ষেত্রে পণ্যের যে দাম তার থেকে কম দেখানো হয়।
আমদানি-রপ্তানির আড়ালে বাংলাদেশ থেকে বছরে কী পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হয় তার কোনো তথ্য নেই সরকারের কাছে। কখনোই কোনো সরকার এ তথ্য প্রকাশ করেনি। তবে আলোচনা হয়েছে সব সময়ই। যখনই যে সরকার ক্ষমতায় থেকেছে সেই সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে অর্থপাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) বিভিন্ন দেশের অর্থ পাচার নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
সবশেষ ২০২০ সালের ৪ মার্চ এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। তাতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ২০ পয়সা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৬৫ হাজার কোটি টাকার মতো।
ওই প্রতিবেদনে ১৩৫টি উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশের গত ১০ বছরের (২০০৮-২০১৭) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মূল্য ঘোষণার গরমিল দেখিয়ে কীভাবে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়, সেই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি ৩৫টি উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনামূলক চিত্রও দেয়া হয়েছে।
একটি দেশ অন্য দেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি করার সময় প্রকৃত মূল্য না দেখিয়ে কম-বেশি দেখানো হয়। মূল্য ঘোষণার বাড়তি অংশের অর্থ বিদেশে পাচার করে দেয়া হয়। এমন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে জিএফআই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০১৪, ২০১৬ ও ২০১৭ সালের তথ্য-উপাত্ত দেয়া হয়নি ওই প্রতিবেদনে। বাংলাদেশের বাকি সাত বছরের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে অর্থ পাচারের হিসাব দেয়া হয়েছে। প্রতিবছরের গড় অর্থ পাচারের হিসাবে ওই ১৩৫টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৩৩তম।
জিএফআইয়ের প্রতিবেদন বলছে, ২০০৮ সালের পর বাংলাদেশে এভাবে মূল্য ঘোষণায় গরমিল দেখিয়ে অর্থ পাচারের পরিমাণ বেড়েছে। ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ ১ হাজার ১৫১ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিদেশে চলে গেছে। ২০০৮ সালে এর পরিমাণ ছিল ৫২৮ কোটি ডলার। এ ছাড়া ২০০৯ সালে ৪৯০ কোটি ডলার, ২০১০ সালে ৭০৯ কোটি ডলার, ২০১১ সালে ৮০০ কোটি ডলার, ২০১২ সালে ৭১২ কোটি ডলার ও ২০১৩ সালে ৮৮২ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘টাকা পাচার নিয়ে শুধু আলোচনাই হয়। এটা রোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। সরকার কোনো তথ্য প্রকাশ না করলেও প্রতি বছর মোটা অঙ্কের টাকা যে পাচার হয় এটা নিশ্চিত। রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ীÍপ্রায় সবার ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকে। সন্তানদের নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তারা টাকা সরানোর চেষ্টা করেন। তাদের মধ্যে এ দেশে বিনিয়োগ বা টাকা রাখায় কোনো আস্থা নেই। তিনি বলেন, ‘সুশাসন না থাকলে টাকা পাচার হবেই। টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িতরা সমাজের উঁচু স্তরের লোক। দেশে টাকা ধরে রাখার জন্য তাদের জন্য কোনো প্রণোদনা নেই। সবার আগে দেশকে ভালো করতে হবে।’ আরেক অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এর মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে কিনা-তা খতিয়ে দেখতে হবে।’