সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০১:১৬ পূর্বাহ্ন

ঈদ সামনে রেখে কর্মচঞ্চল পাবনার তাঁতপল্লী

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শনিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২২

দু’বছরের করোনা বিপর্যয়ের ধাক্কা সামলিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে পাবনার ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প। ঈদের বাজার ধরতে জেলার তাঁতপল্লীগুলোতে নতুন উদ্যমে এখন দিনরাত কাপড় তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটছে কারিগরদের।
গত দু’বছরের চারটি ঈদে করোনার বিধিনিষেধের কারণে তাঁতমালিকদের ব্যবসা না থাকলেও, এবার কাপড়ের ঈদ বাজার বেশ চাঙ্গা বলে জানিয়েছেন তাঁতশ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা। ভারতের ব্যবসায়ীরা ঈদ, পূজাসহ নানা উৎসব সামনে রেখে পাবনা জেলার বিভিন্ন পাইকারি হাটে এসে শাড়ি-লুঙ্গি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তাই অনেকেই বন্ধ তাঁত কারখানা চালু করেছেন। পাবনা জেলা তাঁত বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জেলায় হ্যান্ডলুম, পাওয়ারলুম ও আধুনিক প্রযুক্তির ৬৪ হাজার তাঁত রয়েছে। এই শিল্পের সঙ্গে প্রায় দুই লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। তাঁত প্রধান উপজেলা পাবনার ঈশ্বরদী, সুজানগর, আটঘরিয়া, বেড়া, সাঁথিয়া উপজেলার বিভিন্ন তাঁতপল্লী সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কারখানার মালিক ও শ্রমিকদের কোলাহলে সরব রয়েছে তাঁত পল্লী।
পুরুষের সাথে হাত মিলিয়ে নারীরাও নলী ভরা, সুতা পারি করা, মাড় দেওয়া ও রঙ-তুলিতে নকশা আঁকাসহ কাপড় বুননে সহযোগিতা করছেন। এ অঞ্চলের তাঁত পল্লীতে উন্নতমানের জামদানি, সুতী কাতান, চোষা, সুতী জামদানি, বেনারশি ও শেট শাড়ির পাশাপাশি মোটা শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি-পিচ ও থান কাপড় তৈরি হচ্ছে। মান ভেদে প্রতি পিস লুঙ্গি ২৮০ টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে।
আটঘরিয়া উপজেলার একদন্ত ইউনিয়নের চাঁচকিয়া গ্রামের তাঁত কারখানার মালিক রইচ উদ্দিন বলেন, করোনার দুই বছর আমাদের কারখানার উৎপাদিত লুঙ্গির চাহিদা কমে গিয়েছিল। কারখানার ২৪টি তাঁতের মধ্যে ১৫টিই বন্ধ করে রেখেছিলাম। কিন্তু করোনার সঙ্কট কেটে গেলে তাঁতগুলোতে মান্ধাতার আমলের কৌশল পরিবর্তন করে সেগুলো আধুনিকায়নের মাধ্যমে উৎপাদন শুরু করেছি। গ্রাফিকস ডিজাইনের মাধ্যমে প্রতিদিন নতুন নতুন নকশার শাড়ি-লুঙ্গি নিয়ে বাজারে হাজির হচ্ছি। এতে করে ভালো দামে শাড়ি-লুঙ্গি বিক্রি করতে পেরে আশার আলো দেখছি।’ সদর উপজেলার নতুনপাড়া গ্রামের তাঁতী মতিন মিয়া বলেন, এখানে বছর দুই আগেও হাজার তিনেক তাঁত চালু ছিল। এখনও অর্ধেকের বেশি তাঁত বন্ধ। আমিও দীর্ঘদিন তাঁত বন্ধ রাখছিলাম। ঈদ উপলক্ষে ঋণ নিয়ে দশটা তাঁত চালু করেছি। এখন যে লুঙ্গিগুলো তৈরি হচ্ছে, সেগুলোর চাহিদা থাকায় আমরা খুশি। আতাইকুলায় সপ্তাহে রোববার-বুধবার দুইদিন কাপড়ের বড় হাট বসে। হাটে পশ্চিমবাংলা থেকে আসা কয়েকজন কাপড় ব্যবসায়ীর সাথে কথা হয়। তারা জানান, এখানকার জামদানি নকশা, সেড ও থান কাপড় পশ্চিমবঙ্গে তরুণ তরুণীদের মধ্যে ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। এ থানকাপড় দিয়ে তারা পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ তৈরি করছে। পাইকারি কাপড় ব্যবসায়ী হাবিবুল্লাহ জানান, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা আতাইকুলা হাট থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৭ কোটি টাকার কাপড় কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এতে এ অঞ্চলের তাঁত শিল্প প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। দামও গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
কলকাতার কাপড় ব্যবসায়ী গোপাল চন্দ্র সেন জানান, পাবনা অঞ্চলের তৈরি কাপড় ভারতের কলকাতা শুভরাজ, গঙ্গা রামপুর ও পাটনাসহ বড় বড় শহরে বিক্রয় হচ্ছে । তিনি জানান, ভারতের রফতানিকারকদের কাছে বাংলাদেশের লুঙ্গির চাহিদা রয়েছে সব চেয়ে বেশি। তারা বাংলাদেশি লুঙ্গি কিনে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রপ্তানি করছেন। অন্য এক ব্যবসায়ী জানান, বিবিআনা, রঙ, কে-ক্রাফট ও নগরদোলাসহ দেশের শীর্ষ স্থানীয় বুটিক প্রতিষ্ঠানের কাপড় এখন পাবনা অঞ্চলে তৈরি হচ্ছে। বুটিক হাউজগুলোর নিজস্ব ডিজাইনে রেশম সুতা, খাদি, নয়েল, ডুপিয়ান ও এন্ডি সুতা ব্যবহার করে তাতে প্যালেস ও জরি মিশ্রত করে কাপড় তৈরি করা হচ্ছে। বুটিক হাউজের ওড়না থান কাপড় ও এন্ডি থান কাপড়ের ফ্রেবিক্স তৈরি করা হচ্ছে তাঁত পল্লীগুলোতে। পাইকারি বিক্রেতা আব্দুস সামাদ জানান- রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আতাইকুলা হাটে পাইকাররা আসছেন। প্রতিদিনই অর্ডার আসছে। করোনার দুই বছর মন্দার পর ঈদকে সামনে রেখে কাপড়ের বাজার চাঙা হয়ে উঠেছে। তাঁতীদের পিছে পিছে ঘুরে চাহিদা অনুযায়ী কাপড় মিলছে না। ব্যবসায়ীরা অগ্রিম টাকা দিয়ে তাঁতীদের বাড়ি থেকে কাপড় কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। অনেক তাঁতীই তার কারখানার কাপড় আগাম বিক্রি করে দিয়েছেন।
তাঁত শ্রমিক লোকমান, সালেক, রতন সাহা, আব্দুস ছালাম, আফজাল হোসেন, গাজীউর রহমান, আব্দুস সালাম, তোরাব আলী জানান, করোনার দুই বছর কারখানা বন্ধ ছিল। খেয়ে না খেয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে দিন কাটিয়েছি। আবার কারখানা চালু হয়েছে, দিন-রাত পরিশ্রম করছি। কাজ করে সপ্তাহে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত মজুরী মিলছে। এবার অন্তত পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালভাবে ঈদ করা যাবে। পাবনা জেলা তাঁতি সমবায় সমিতির সভাপতি কামরুল আনান রিপন জানান, ঐতিহ্যবাহী পাবনার তাঁতশিল্পের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকার বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের মাধ্যমে তাঁতীদের স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করলে বন্ধ হওয়া তাঁতগুলো আবার সচল হবে। পাবনা জেলা প্রশাসক বিশ্বাস রাসেল হোসেন বলেন, তাঁতীদের সহায়তার ব্যাপারে অর্থ বরাদ্দ পেলে সহায়তা করা হবে।- রাইজিংবিডি.কম




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com