ঈদুল ফিতর হলো মুসলিম উম্মাহর প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এই দিন মোমিন মুসলমানদের মাসব্যাপী রোজা পালনের পুরস্কার প্রাপ্তির দিন। আল্লাহর বান্দারা শাওয়ালের নতুন বাঁকা চাঁদ দেখে আল্লাহকে স্মরণ করতে এবং তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য ঈদগাহে গিয়ে হাজির হন। ঈদুল ফিতরের দিন আনন্দ প্রকাশ করা বা খুশি হওয়া ইসলামের একটি অন্যতম নিদর্শন। হজরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (রহ.) বলেন, ঈদের দিন আনন্দ প্রকাশের পূর্ণতা হলো সুন্দর কাপড় পরিধান করে একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বের হবে এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করবে। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা-২/৩০)। ঈদুল ফিতর ধনী-গরিব সবার জন্য একটি সর্বজনীন উৎসব। প্রিয় নবীজি (সা.) ঈদের সূচনা করতেন দুই রাকাত নামাজ আদায়ের মাধ্যমে। নামাজ শেষে তিনি একটি ভাষণ দিতেন। তিনি এক পথ দিয়ে ঈদগাহে যেতেন এবং অপর পথ দিয়ে ফিরতেন। পথিমধ্যে তাকবির বলতেন। মানুষের সঙ্গে সালাম বিনিময় করতেন, মুসাফাহা করতেন। হজরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রিয় নবীজি (সা.) এর লাল রঙের ডোরাকাটা একটি চাদর ছিল, যা তিনি দুই ঈদ এবং জুমার সালাতে পরিধান করতেন।
ঈদুল ফিতরের পরিচয়: ঈদ আরবি শব্দ। ‘আওদুন’ মূল শব্দ থেকে উৎপত্তি। এর আভিধানিক অর্থ হলো আনন্দ, খুশি, উৎসব, আমোদ ইত্যাদি। ঈদ শব্দটির মূল অর্থ হলো ফিরে আসা। দিবসটি প্রতিবছর মানুষের কাছে আনন্দ-খুশি, উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ফিরে আসে বলে একে ঈদ বলা হয়। ‘ফিতর’ অর্থ হলো সাওম ভঙ্গ করা। সুতরাং ঈদুল ফিতর অর্থ হলো রমজানের মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আনন্দ।
ঈদের দিন প্রিয় নবীজি (সা.) হুজরা মোবারক এবং তার আশপাশে উৎসবের আমেজ বিরাজ করত। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমার ঘরে আবু বকর (রা.) এলেন তখন আমার কাছে আনসারি দুটি মেয়ে বু’আস যুদ্ধের দিন আনসারিরা পরস্পর যা বলেছিলেন, সে সম্পর্কে কবিতা আবৃত্তি করছিল। তিনি বলেন, তারা কোনো পেশাগত গায়িকা ছিল না। আবু বকর (রা.) বললেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ঘরে শয়তানি বাদ্যযন্ত্র। আর এটি ছিল ঈদের দিন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে আবু বকর! প্রত্যেক জাতির জন্যই আনন্দ উৎসব রয়েছে আর এ হলো আমাদের আনন্দ। (?েবাখারি- ৯০৪)।
অপর হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, প্রিয় নবীজির রওজা শরিফের পাশে একটি অনুষ্ঠান চলছিল। যার বর্ণনা দিয়ে হজরত আয়েশা (রা.) নিজেই বলেন, আর ঈদের দিন সুদানিরা বর্শা ও ঢালের খেলা করত। আমি নিজে আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম অথবা তিনি নিজেই বলেছিলেন, তুমি কি তাদের খেলা দেখতে চাও? আমি বললাম, হ্যাঁ, অতঃপর তিনি আমাকে তার পেছনে এমনভাবে দাঁড় করিয়ে দিলেন যে, আমার গাল ছিল তার গালের সঙ্গে লাগানো। তিনি তাদের বললেন, তোমরা যা করছিলে তা করতে থাক, হে বনু আরফিদা। পরিশেষে, আমি যখন ক্লান্ত হয়ে পড়লাম, তখন তিনি আমাকে বললেন, তোমার দেখা কী যথেষ্ট হয়েছে? আমি বললাম, হ্যাঁ, তিনি বললেন, তা হলে চলে যাও। (বোখারি-৯৫০)।
ঈদ উৎসব এটি একটি প্রাচীন প্রথা: মানব সভ্যতার শুরু থেকেই এটি প্রচলিত হয়ে আসছে। প্রত্যেক জাতির জন্য ভিন্ন ভিন্ন দিবসে উৎসব পালনের প্রচলন ছিল। যেমন, আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে হজরত মুসা (আ.) সম্পর্কে বলেন, মুসা বলল, তোমাদের ওয়াদার দিন উৎসবের দিন এবং যেই দিন পূর্বাহ্নে লোকজনকে সমবেত করা হবে। (সুরা তাহা : ৫৯)। অনুরূপভাবে হজরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে বলেন, মরিয়ম তনয় ঈসা বললেন, হে আল্লাহ! আমাদের প্রতিপালক! আমাদের প্রতি আকাশ থেকে খাদ্যভর্তি খাঞ্চা অবতরণ করুন। তা আমাদের জন্য অর্থাৎ, আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সবার জন্য আনন্দোৎসব হবে এবং আপনার পক্ষ থেকে একটি নিদর্শন হবে। আপনি আমাদের জীবিকা দান করেন। আপনিই শ্রেষ্ঠ জীবিকাদাতা। (সুরা মায়েদা-১১৪)।
ঈদুল ফিতরের প্রবর্তন: পূর্ববর্তী বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা ও উল্লেখযোগ্য কীর্তি কর্মের দিন উৎসব পালনের রেওয়াজ ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত রয়েছে। প্রিয় নবীজি (সা.) এর মদিনায় হিজরতের আগেও মদীনাবাসী বিভিন্ন উৎসব পালন করতেন। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রিয় নবীজি (সা.) যখন হিজরত করে মদিনায় আসলেন তখন মদিনাবাসীর দুটি উৎসবের দিবস ছিল। নবীজি (সা.) তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এ দুটি দিবস কী? (কী হিসেবে তোমরা এ দু’দিন উৎসব পালন কর?) তারা বলল, জাহেলিয়াত তথা ইসলামপূর্ব যুগে আমরা এ দিন দুটিতে উৎসব পালন করতাম। তখন নবীজি (সা.) বললেন, আল্লাহ তোমাদের এ দুটি দিনের পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দুটি দিন দান করেছেন- ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর। (সুনানে আবু দাউদ-১১৩৪)।
ঈদুল ফিতরের উদ্দেশ্য: ঈদুল ফিতরের দিন মুসলিম সমাজে অনাবিল-আনন্দ ও খুশির জোয়ার তৈরি হয়। বিশেষ করে ঈদের চাঁদ দেখা যাওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন গণমাধ্যমে, মসজিদের মাইকে ঈদের শুভেচ্ছা ঘোষণা করা হয়। ঈদ মোবারক জানানো হয়। ঈদের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় নামাজ আদায়ের মাধ্যমে। ধনী-গরিব, শাসক-শাসিত, আশরাফ-আতরাফ, উঁচু-নিচু সবাই ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে দাঁড়িয়ে ঈদের আনন্দে একাকার হয়ে যায়। ঈদগাহে যাওয়ার সময় আল্লাহর মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা করতে থাকে?। মহান আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, আর যেন তোমরা নির্ধারিত সংখ্যা পূরণ করতে পার এবং তোমাদের যে সুপথ দেখিয়েছেন, তার জন্য তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব-বড়ত্ব প্রকাশ কর এবং তার কৃতজ্ঞ হও। (সুরা বাকারা-১৮৫)।
আমরা জানি দ্বিতীয় হিজরিতে রমজানের রোজা ফরজ হয়। রোজা শেষ হওয়ার কিছুদিন আগে ঈদুল ফিতরের নামাজ এর বিধান নাজিল হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, নিশ্চয়ই সাফল্য লাভ করেছে যে পবিত্রতা অর্জন করেছে এবং তার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করে ও নামাজ আদায় করে (সুরা আলা : ১৪-১৫)।
হজরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) ও আবুল আলিয়া (রহ.) ওই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, সাফল্য অর্জন করেছে, সেই ব্যক্তি যে সাদকাতুল ফিতর প্রদান করেছে এবং ঈদের নামাজ আদায় করেছেন। (ইমাম আবু বকর জাসাস, আহকামুল কোরআন ৩/৬৩৬)। এই জন্য ঈদুল ফিতরের দিন নিঃস্ব অভাবী ব্যক্তিদের যাতে অনাহারে থাকতে না হয় এবং তারাও যাতে ঈদের আনন্দে শরিক হতে পারে, সে জন্য ইসলামি শরিয়তে সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব করে দিয়েছে। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) সদকাতুল ফিতরকে ফরজ করেছেন রোজাকে অহেতুক ও খারাপ কথা থেকে পবিত্রকরণ এবং অসহায়দের খাবার প্রদানের জন্য। (আবু দাউদ-১৬১১)। ঈদ উৎসবকে সদকাতুল ফিতর আদায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার মধ্যমে সবার জন্য উপভোগ্য, হাসিখুশি ও আনন্দঘন করে তোলায় দিনটির স্বকীয়তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
ঈদের দিনের ফজিলত: ঈদের দিন হলো রোজাদার ব্যক্তিদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদান লাভের দিন। প্রতিদান প্রাপ্তির মধ্যে আনন্দ ও খুশির মুহূর্ত থাকে। আর সিয়াম সাধনা নামক কঠিন ইবাদতের প্রতিদান লাভের আনন্দ হলো আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা ও শুকরিয়া জ্ঞাপন করা। হজরত আনাস ইবন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবি (সা.) এরশাদ করেন, যখন ঈদুল ফিতরের দিন আসে, তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যারা রোজা পালন করেছে, তাদের সম্পর্কে ফেরেশতাদের কাছে গৌরব করে বলেন- ‘হে আমার ফেরেশতারা, তোমরা বল তো! যে শ্রমিক তার কাজ পুরোপুরি সম্পাদন করে তার প্রাপ্য কী হওয়া উচিত? উত্তরে ফেরেশতারা বললেন, হে মাবুদ! পুরোপুরি পারিশ্রমিকই তার প্রাপ্য। ফেরেশতারা, আমার বান্দা-বান্দিরা তাদের প্রতি নির্দেশিত ফরজ আদায় করেছে, এমনকি দোয়া করতে করতে ঈদের (ওয়াজিব) নামাজের জন্য বের হয়ে গেছে। এ অবস্থায়, আমার মহিমা, গরিমা, উচ্চ মর্যাদা ও উচ্চাসনের শপথ, আমি অবশ্যই তাদের প্রার্থনায় সাড়া দেব। এরপর নিজ বান্দারাদের লক্ষ্য করে আল্লাহপাক ঘোষণা দেন; তোমরা ফিরে যাও, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম এবং তোমাদের সাধারণ পাপরাশিকে পুণ্যে পরিণত করে দিলাম। প্রিয়নবী (সা.) বলেন, তখন তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত অবস্থায় (বাড়িতে) প্রত্যাবর্তন করে।’ (আততারগিব ওয়াত তারহিব) (বায়হাকি, শুয়াবুল ঈমান- ৩৭১৭)।
ঈদুল ফিতরের দিন পরস্পরে শুভেচ্ছা বিনিময় করা: প্রিয় নবীজি (সা.) এর সাহাবারা ঈদ উপলক্ষ্যে পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন। হজরত জুবায়ের ইবনে নুফায়ের (রা.) বলেছেন, প্রিয় নবীর সাহাবারা ঈদের দিন একে অপরের সঙ্গে দেখা হলে পরস্পরকে বলতেন, ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম’ অর্থাৎ, আল্লাহ আমাদের ও আপনাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন। (ইমাম ইবনে হাজার, ফতহুল বারি: ২/৪৪৬)।
ঈদুল ফিতরের শিক্ষা: প্রিয় রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখো এবং চাঁদ দেখে রোজা শেষ করো। (বোখারি-১৮১০)। রমজান মাসে মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার মাধ্যমে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা একটি সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল। পুরো মাসের ইবাদতের মধ্যে সাহরি, ইফতারি, তারাবিহ, কোরআন তেলাওয়াত, কিয়ামুল লাইল, দান-সাদকা ইত্যাদি আদায় করে একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপনের প্রশিক্ষণ মোমিন মুসলমান গ্রহণ করেছে। চাঁদ দেখে রোজা শেষ করার মধ্য দিয়ে সেই সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের প্রশিক্ষণ ঈদুল ফিতরের মাধ্যমে মুসলিম মানসে আনন্দ-ফুর্তিতে, সৌন্দর্য-মাধুর্যে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ মুছে দিয়ে শান্তি ও সাম্য-মৈত্রীর প্রেরণা জোগায়। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করে, কোলাকুলি করে, খবরাখবর নেয়। যার মধ্য দিয়ে ইসলামি ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই শিক্ষা যদি আমরা সারা জীবন অনুসরণ করতে পারি, তাহলে আমাদের মধ্যে কলহ-বিবাদ থাকবে না। সমাজে শান্তির সুবাতাস প্রবাহিত হবে। মানুষ ফিরে পাবে সুখী ও সমৃদ্ধ জীবনের সন্ধান। লেখক : সিনিয়র শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা), চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ