দেশে নতুন প্রজাতির তিমির সন্ধান মিলেছে। এটির বৈজ্ঞানিক নাম ‘কোগিয়া সিমা’। বামন কোগিয়া প্রজাতির এই তিমি দেখতে অনেকটা হাঙরের মতো, ডলফিনের চেয়ে আকারে কিছুটা ছোট। সম্প্রতি কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে তিমিটি পাওয়া গেছে।
সামুদ্রিক প্রাণী গবেষকরা বলছেন, কয়েক মাস আগে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে আটকে পড়ে কোগিয়া সিমা প্রজাতির তিমিটি। পরে তিমির ছবি তুলে ফেসবুকে শেয়ার করেন কুয়াকাটা ডলফিন সংরক্ষণ কমিটির সদস্যরা। ওই ছবি গবেষণা করে নতুন প্রজাতির তিমির সন্ধান পান গবেষকরা।
বিজ্ঞানীদের কাছে এই তিমি ‘কোগিয়া সিমা’ নামে পরিচিত। এটিকে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে জীবিত অবস্থায় পাওয়া গেছে। স্থানীয়রা তিমিটিকে সমুদ্রে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও স্রোতের কারণে বারবার তীরে ফিরে আসে। প্রায় দুই ঘণ্টা পর তিমিটি মারা যায়। এরপর তিমির ছবিগুলো বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশে প্রথম এই প্রজাতির তিমি শনাক্ত করেন গবেষকরা।
সামুদ্রিক প্রাণী গবেষক বাংলাদেশ ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (ডব্লিউসিএস) সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর নাদিম পারভেজ বলেন, ‘২০২১ সালের নভেম্বর মাসে কুয়াকাটা ডলফিন সংরক্ষণ কমিটির স্বেচ্ছাসেবকরা ওই তিমির বিভিন্ন ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেন। ছবিগুলো দেখে আমরা বিস্মিত হয়েছিলাম। তিমিটি দেখতে প্রায় হাঙরের মতো। এটির মাথা বর্গাকার ও নাকের বর্ধিতাংশ সামনের দিকে অভিক্ষিপ্ত। মাথার পাশে নকল ফুলকাছিদ্রের মতো দেখতে একটি সাদা দাগ ছিল।’
তিনি বলেন, ‘এই বৈশিষ্ট্যগুলো রয়েছে বামন কোগিয়া প্রজাতির তিমিগুলোর। বৈশিষ্ট্যগুলো দিয়ে শিকারিদের বোকা বানায় তারা। নকল ফুলকাছিদ্রের মতো দাগ ছাড়াও বামন কোগিয়া তিমির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এদের পেটের ভেতরে অন্ত্রের সঙ্গে লালচে-বাদামি তরল দিয়ে ভরা একটি ছোট থলি সংযুক্ত থাকে। শিকারিদের উপস্থিতিতে থলি থেকে তরল পদার্থ পানিতে ছুড়ে নিজেদের আড়াল করে। বিষয়টি কিছুটা অক্টোপাসের মতো। যারা ভয় পেলে কালির মতো কালো তরল নির্গত করে। যেহেতু এরা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির তিমি, তাই অন্যান্য বিশালাকার তিমির মতো আকার দিয়ে এরা শিকারিদের ভয় দেখাতে পারে না।’
নাদিম পারভেজ বলেন, ‘বিশ্বে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ৯০টিরও বেশি প্রজাতির সেটেশানদের (ডলফিন, তিমি আর পরপয়েজ এই তিনটিকে সেটেশান বলে) মধ্যে বামন কোগিয়া তিমি একটি। সেটেশানরা আমাদের মতো স্তন্যপায়ী প্রাণী। এরা সারা জীবন পানিতে কাটায় এবং বাতাস থেকে শ্বাস নেয়। তবে অন্যান্য সেটেশানদের মতো এরা শিকারকে চিবিয়ে না খেয়ে সম্পূর্ণ গিলে ফেলে। মা সেটেশানরা সাধারণত একটি বাচ্চা জন্ম দেয়। যারা স্বাধীনভাবে জীবনযাপনে সক্ষম হওয়ার আগ পর্যন্ত মায়ের দুধ পান করে। ডলফিন, পরপয়েস ও বামন কোগিয়াসহ আরও কয়েকটি দাঁতাল তিমির ধারালো দাঁত থাকে; যা দিয়ে তারা পিচ্ছিল শিকার ধরে। আশ্চর্যজনকভাবে সৈকতে পাওয়া অন্তঃসত্ত্বা এই বামন কোগিয়া তিমির পেটে দুটি বাচ্চা ছিল। সেটেশানদের মধ্যে এই ঘটনা অত্যন্ত বিরল। কারণ, সেটেশানরা সাধারণত প্রতিবারে একটি বাচ্চা জন্ম দেয়।’
তিনি বলেন, ‘সব সেটেশানের একটি শক্তিশালী লেজ-পাখনা থাকে; যা ফ্লুক নামে পরিচিত। সেটেশানরা লেজ-পাখনা ওপরে-নিচে নাড়ানোর মাধ্যমে সামনের দিকে চলে। দুটি পার্শ্ব পাখনা ব্যবহার করে সাঁতার কাটে এবং পিঠের পাখনা ব্যবহার করে দেহের ভারসাম্য ও শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। সেটেশানদের প্রজাতিগুলোকে আলাদা করতে সাধারণত পাখনাসমূহ, মাথা, ঠোঁট এবং দেহের আকৃতির পাশাপাশি দেহের রঙ ব্যবহৃত হয়। অনেক ক্ষেত্রে বামন কোগিয়া তিমিকে এদের কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যের খাটো কোগিয়া তিমির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়। তবে অপেক্ষাকৃত বড় ত্রিভুজ আকার পিঠ-পাখনা, যা নাকের বর্ধিতাংশ থেকে লেজ-পাখনা পর্যন্ত দৈর্ঘ্যের প্রায় মাঝামাঝিতে অবস্থিত। আকারে ছোট হওয়ায় কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে পাওয়া তিমিকে বামন কোগিয়া হিসেবে নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করা হয়েছে।’
বাংলাদেশ ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘কুয়াকাটায় পাওয়া তিমিটি বামন কোগিয়া প্রজাতির। দেখতে হাঙরের মতো। গবেষণা করে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, এটির বৈজ্ঞানিক নাম কোগিয়া সিমা। দেশে নতুন প্রজাতির তিমি এটি। দেশের সমুদ্রে এর আগে এমন তিমি দেখা যায়নি।’
বাংলাদেশ ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির সদস্য মো. রাসেল মিয়া বলেন, ‘দেশে শনাক্ত করা কোগিয়া সিমা তিমিটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, গভীর সমুদ্রে থাকা এই প্রাণী সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ডব্লিউসিএস পরিচালিত গবেষণার সময় এই প্রজাতির তিমি দেখা যায়নি। তবে কোগিয়া সিমা তিমি আমাদের ধারণার চেয়েও বেশি পরিমাণে থাকতে পারে। কারণ, সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠ সম্পূর্ণ শান্ত থাকলে এরা গতিহীনভাবে অবস্থান করলে দেখতে পাওয়া যায়, অন্যথায় দেখা পাওয়া দুরূহ।’
তিনি বলেন, ‘কুয়াকাটায় আটকে পড়া কোগিয়া সিমা তিমির মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে আমাদের কাছে কোনও তথ্য নেই। তবে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশ কয়েকটি প্রমাণ পাওয়া গেছে। যেমন, প্লাস্টিকের ধ্বংসাবশেষ ভুলবশত স্কুইড, অক্টোপাস বা কাটলফিশ ভেবে গিলে ফেলে এরা মারা যায়। ফলে এই প্রজাতির তিমি আজ বিলুপ্তির পথে। প্লাস্টিকের ধ্বংসাবশেষ এদের পরিপাকতন্ত্রকে অবরুদ্ধ করতে পারে। ফলে অনাহারে মৃত্যু ঘটে।’
রাসেল মিয়া বলেন, ‘কুয়াকাটা ডলফিন সংরক্ষণ কমিটির সদস্য, বন অধিদফতর, বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের কর্মকর্তাসহ যারা এই কাজে সহযোগিতা করেছে তারা সবাই সাগরের অভিভাবক হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কমিটির সদস্য ও স্থানীয়রা তিমিটিকে সমুদ্রে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন এবং বাঁচাতে কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত সে সম্পর্কে পরামর্শ নিতে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। দেশে নতুন প্রজাতির তিমি আবিষ্কারের কৃতিত্বের দাবিদার তারাই।’-বাংলাট্রিবিউন