বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৫ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
ব্যবসায়ীদের সরকারের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান অধ্যাপক ইউনূসের রাষ্ট্রপতির কাছে সুপ্রিম কোর্টের বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ প্রধান বিচারপতির দেশমাতৃকার বিরুদ্ধে দেশী-বিদেশী চক্রান্ত থেমে নেই: তারেক রহমান তুর্কি রাষ্ট্রদূতের সাথে জামায়াতের সৌজন্য সাক্ষাৎ চিন্ময় সমর্থক জঙ্গীদের হামলায় আইনজীবী সাইফুল ইসলাম নিহত অভ্যন্তরীণ বিষয় হস্তক্ষেপ: চিন্ময় ইস্যুতে ভারতের উদ্যোগ শাপলা চত্বরে গণহত্যায় হাসিনাসহ ৫০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমরা চাই না ছাত্র ভাইদের কঠোর হয়ে দমন করতে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা রাষ্ট্রদ্রোহের ঘটনায় যুক্ত থাকলে ছাড় দেয়া হবে না : আসিফ মাহমুদ মানুষ কেন তাদের ওপর বিক্ষুব্ধ, গণমাধ্যমের তা স্পষ্ট করা উচিত : নাহিদ ইসলাম

সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণ

খায়রুল ইসলাম, সীতাকুণ্ড
  • আপডেট সময় রবিবার, ৫ জুন, ২০২২

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সময় বাড়ার সাথে সাথেই দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত প্রায় ২০ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট কাজ করলেও এখনো আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ধীরে ধীরে ফায়ার সার্ভিসের আরো ইউনিট আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেয়। তবে ডিপোতে হাইড্রোজেন পারক্সাইড থাকার কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: মাইন উদ্দিন। সবশেষ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এ ঘটনায় ৫০ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আগুন নেভাতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন আটজন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী। চমেক হাসপাতালে ভিড় করেছেন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিখোঁজদের স্বজনরা। কেই আসছেন লাশের খোঁজে আবার কেইবা তার প্রিয় মানুষটি এখনো জীবিত আছেন এই আশা নিয়ে। তাদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠেছে চারপাশ। গত শনিবার রাত ৮টার দিকে বিএম কন্টেইনার ডিপোর লোডিং পয়েন্টের ভেতরে এ আগুনের সূত্রপাত হয়। কুমিরা ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রথমে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। রাত পৌনে ১১টার দিকে এক কন্টেইনার থেকে অন্য কন্টেইনারে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নেভানোর বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দলের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিস্ফোরণ যেভাবে হচ্ছিল তাতে ভেতরে থাকা সম্ভব ছিল না। আগুন কতক্ষণে নেভাতে পারব, এ বিষয়ে কিছুই বলা সম্ভব নয়। এদিকে কন্টেইনার ডিপোতে আগুন লাগার পর ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। কেমিক্যাল কন্টেইনার থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে ফায়ার সার্ভিস।
এক নজরে সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ: চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে গত শনিবার রাত ১১টায়। বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলের আশপাশের অন্তত চার বর্গকিলোমিটার এলাকা কেঁপে ওঠে। আশপাশের বাড়িঘরের জানালার কাচ ভেঙে পড়ে। বিস্ফোরণের পর এখনো আগুন জ্বলছে। ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৩৭ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম হাসান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়ে অনেকে চলে গেছেন। ৭০ জন চিকিৎসাধীন। আর ৪ জন হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন।
নিহতদের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ছয়জন কর্মী রয়েছেন জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। ঘটনার পরপরই হতাহত ব্যক্তিদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা শুরু হয়। গত রাতে অ্যাম্বুলেন্স, গাড়ি ও সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে আহত ব্যক্তিদের সেখানে আনা হচ্ছিল। এদিকে হাসপাতালে মানুষ আহতদের রক্ত দিতে ভিড় করছেন। সেখানে চিকিৎসক ও নার্সদের জড়ো করা হয়েছে। হাসপাতালে আহত ও নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা ভিড় করছেন। স্বজনদের খোঁজ করছেন। তাঁদের কান্না ও আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।
থেমে থেমে বিস্ফোরণ: বিএম কনটেইনার ডিপোতে গতরাতে আগুন লাগার পর সারা রাত থেমে থেমে বিস্ফোরণ হয়। আজ সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। দুপুর ১টার দিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত প্রথম আলোর প্রতিবেদক জানান, আর শব্দ শোনা যাচ্ছে না। আগুন নেভানোর কাজ চলছিল। বিষাক্ত ধোয়ার কারণে আগুন লাগার মূল জায়গায় এখনো ফায়ার সার্ভিস ঢুকতে পারেনি।
ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী: আইএসপিআর জানায়, উদ্ধার অভিযানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৫০ জন সদস্য কাজ করছে। উদ্ধার অভিযান ও আগুন নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সহায়তার জন্য সেনাবাহিনীর একটি বিশেষজ্ঞ দল কাজ করছে। এ ছাড়া, সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার এবং নিরাপত্তা দলও নিয়োজিত রয়েছে। রাসায়নিক দ্রব্যাদির বিস্ফোরণের কারণে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত রাসায়নিক সামগ্রী সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়া রোধে এ দলটি কাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর মিলিটারি পুলিশও সহায়তা করছে। তা ছাড়া, বিস্ফোরণে আহতদের সেনাবাহিনীর মেডিকেল টিম গতকাল রাত হতে কাজ করছে। আহতদের চট্টগ্রাম মেডিকেল ও সিএমএইচ-এ স্থানান্তরে সেনাবাহিনী অ্যাম্বুলেন্স সহায়তা করছে । এ পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ১৪ জন সদস্যসহ চট্টগ্রাম সিএমএইচে ১৫ জন চিকিৎসাধীন রয়েছে।
বিপুল রাসায়নিক: চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ‘হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড’ নামের বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও ডিপোর কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড একটি রাসায়নিক যৌগ। এটি যদি উত্তপ্ত করা হয়, তাহলে তাপীয় বিয়োজনে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড বিস্ফোরক হিসেবে আচরণ করে।
কালো ধোঁয়া: বিস্ফোরণে পুরো এলাকায় কেমিক্যালের বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যসহ ঘটনাস্থলে আসা লোকজন চোখ খুলতে পারছেন না। বেশির ভাগ সদস্যের চোখ লাল হয়ে গেছে। কারও কারও চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তাঁদের। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের ৪টি উপজেলা, ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা থেকে ফায়ার সার্ভিসের ২৩টি ইউনিটের ১৮৩ জন সদস্য কাজ করছেন।
বাসাবাড়ির টেলিভিশন-ফ্রিজ নষ্ট: বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগে। সেটা সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়িতে। এটি মূল শহরের বাইরে। তবে আশপাশে জনবসতি হয়েছে। বড় ভবন কম। নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস বেশি। অনেকের ঘরের জানালার কাচ, দরজা ভেঙে গেছে। বেশির ভাগ বাসার টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর ও বৈদ্যুতিক পাখা নষ্ট হয়ে গেছে। ডিপোর আশপাশে টিনের ছাউনির ঘর বেশি। দুপুর ১টা নাগাদ সেখানকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, তাঁরা কালো ও বিষাক্ত ধোয়ার কারণে ঘরে টিকতে পারছেন না। অনেককেই মুখে কাপড় বেঁধে বসে থাকতে দেখা যায়।
মালিকপক্ষ ঘটনাস্থলে যায়নি: গতকাল রোববার দুপুর পৌনে ১২টা পর্যন্ত ডিপোর মালিক বা কোনো কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে আসেননি। মালিকপক্ষের কেউ না থাকায় কনটেইনার ডিপোতে কী ধরনের কেমিক্যাল রয়েছে, তা জানতে পারছে না ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল। ফায়ার সার্ভিস বলছে, এ কারণে তারা উদ্ধার তৎপরতায় বেকায়দায় পড়েছে। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, কনটেইনার ডিপোটির মালিকপক্ষের কাউকে এখনো পাওয়া যায়নি। এখানে কী ধরনের কেমিক্যাল আছে, তা বলা যাচ্ছে না। পানি দিয়ে সব কেমিক্যালের আগুন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এ কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লাগছে।
ঢাকার বার্ন ইনস্টিটিউটে রোগী: চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ৩ জন ভর্তি আছেন। আরও দুজন আসছে। আজ ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় তারা সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। আগামীকাল সোমবার সকালে তাঁর নেতৃত্বে একটি দল চট্টগ্রাম যাবে। তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রামে আপাতত কোনো লজিস্টিক সাপোর্ট প্রয়োজন হচ্ছে না। তবে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছে।
প্রধানমন্ত্রীর শোক: বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী গতকাল রোববার এক শোক বার্তায় নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তিনি আহতদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রী দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে উদ্ধার তৎপরতা পরিচালনা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানে সরকারের পাশাপাশি দলীয় নেতা কর্মীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তদন্ত চান সংসদ সদস্য: সীতাকুণ্ডের সংসদ সদস্য দিদারুল আলম বলেছেন, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কীভাবে রাসায়নিক ডিপো করা হয়েছে, তা তদন্ত করা উচিত। গতকাল রোববার দুপুরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণস্থল পরিদর্শন করতে গিয়ে দিদারুল আলম এসব কথা বলেন।
এত বড় দুর্ঘটনা আর ঘটেনি: আমদানি-রপ্তানি পণ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ২৪ বছর আগে চট্টগ্রামে কনটেইনার ডিপো শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। চট্টগ্রামে এ শিল্পের যাত্রা শুরুর পর এই প্রথম কোনো কনটেইনার ডিপোতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটল। বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান নুরুল কাইয়ূম খান আজ প্রথম আলোকে বলেন, এই শিল্পের যাত্রা শুরুর ২৪ বছরে এত বড় দুর্ঘটনা আগে ঘটেনি। এর আগে ডিপোতে ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু সেসব ক্ষেত্রে খুব দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছিল।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com