শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:২৬ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
ধনবাড়ীতে আধুনিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে শুরু প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী রৌমারীতে বড়াইবাড়ী সীমান্ত যুদ্ধ দিবস পালিত মাধবদীতে জ্যান্ত কই মাছ গলায় ঢুকে কৃষকের মৃত্যু বদলগাছীতে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী কালীগঞ্জে কৃষক মাঠ দিবস ও কারিগরি আলোচনা লতিফ মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবিতে মানববন্ধন নড়াইলের কালিয়া উপজেলার শ্রীনগর গ্রামে ভ্যানচালককে পুলিশি হয়রানির প্রতিবাদে মানববন্ধন বরিশালে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী মেলার উদ্বোধন হাতিয়ায় দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থার ক্যাম্পাসে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদুর রহমান বেলায়েত স্মৃতি কর্ণার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র উদ্বোধন গজারিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী আমিরুল ইসলামের পক্ষে ছাত্রলীগের গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ

এক লিচুর দাম ২৬ টাকা

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২

দিনাজপুরে স্মরণকালের সেরা দামে বিক্রি হচ্ছে লিচু। এর মধ্যে চায়না থ্রি জাতের একেকটি লিচু বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ২৬ টাকা। পাশাপাশি প্রতিটি বেদেনা জাতের লিচু বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৩ টাকা।
বাগানি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই দুই জাতের লিচু দেখতে অনেকটা আপেল আকৃতির। গায়ে কাঁঠালের মতো আবরণ, তবে মসৃণ। বিচি একেবারেই ছোট। অন্যান্য লিচুর চেয়ে স্বাদ ভিন্ন। বিশেষ করে চায়না থ্রি জাতের লিচু গাছের সংখ্যা কম। প্রতিটি বাগানে একটি গাছের দেখা মেলে। মাটি ও আবহাওয়া উপযোগী না হলে এই গাছ বাঁচে না। খুব কম পাওয়া যায় বলে চায়না থ্রি জাতের লিচুর দাম সবসময় বেশি থাকে।
চায়না থ্রি জাতের লিচুর দাম কেন বেশি জানতে চাইলে কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতর দিনাজপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ প্রদীপ কুমার গুহ বলেন, ‘চায়না থ্রি জাতের লিচু সব লিচু থেকে আলাদা। দেখতে আপেল আকৃতির। অন্যান্য লিচুর ফলন বেশি হলেও এই লিচুর ফলন কম। গায়ে কাঁঠালের মতো আবরণ, তবে মসৃণ। বিচি একেবারেই ছোট এবং স্বাদ ভিন্ন। এই লিচুর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো শুধুমাত্র দিনাজপুরেই ভালো হয়। আবহাওয়া ও মাটির গুণাগুণের ওপর নির্ভর করে বেড়ে ওঠে গাছ। অন্যান্য জেলায় এই লিচুর আবাদ আছে। কিন্তু সেখানকার ফলন, স্বাদ ও মিষ্টতা দিনাজপুরের মতো নয়। ফলে চাহিদা আছে দেশজুড়ে। যার কারণে দাম বেশি। অন্যান্য বছর ১৬ থেকে ১৮ টাকা বিক্রি হলেও এবার সর্বোচ্চ ২৬ টাকা বিক্রি হচ্ছে।’
এদিকে, জেলায় চায়না থ্রি জাতের পাশাপাশি অন্যান্য জাতের লিচুর ভালো ফলন হয়েছে। দামও বেশি। বিরল উপজেলার মাধববাটী এলাকার মতিবুর রহমান জোড়কালী এলাকায় একটি লিচু বাগান কিনেছেন দেড় লাখ টাকায়। দাম ভালো পাওয়ায় এক বাগান থেকে লাভের আশা করছেন ৪০ হাজার টাকা।
তিনি বলেন, ‘দেড় লাখ টাকায় বাগানটি কিনেছি। এবার লিচুর দাম বেশি। আড়াই থেকে তিন লাখ টাকার লিচু বিক্রি করতে পারবো। এর মধ্যে খরচ আছে। বাগানের পাহারাদারদের মাসে দিতে হয় মাসে ১২ হাজার টাকা। দুজন কর্মীকে দিতে হয় ২৪ হাজার টাকা। এভাবে তিন মাসের খরচ বাদ দিয়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা লাভ হবে। তবে বেশিও হতে পারে। লিচু বিক্রি করে যা লাভ হয় তা দিয়ে পুরো বছর সংসার চলে আমার।’
একই এলাকায় ৫৪টি গাছ দেড় লাখ টাকায় কিনেছেন সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘কীটনাশক, পাহারাদার, সেচ-স্প্রেসহ খরচ হয়েছে আরও ৩০ হাজার টাকা। এবার লিচুর দাম ভালো। এজন্য ভালো লাভ হবে। লিচুতে পোকাও কম। তবে ফলন একটু কম। তা না হলে লাভের পরিমাণ আরও বাড়তো। লিচু বিক্রি শুরু করেছি, ভালোই বিক্রি হচ্ছে।’
বিরলের মহেশপুর এলাকার রাজিউল ইসলাম রাজু বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এবার লিচুর দাম বেশি পাচ্ছি। তবে খরচও বেড়েছে। সার, কীটনাশক ও সেচের খরচ বেড়েছে। সবমিলে লিচুর দাম বেশি। ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা আসছেন। ভালো কেনাবেচা হচ্ছে।’
শুধু মতিবুর, সাইদুর কিংবা রাজু নন; লিচুর জেলা হিসেবে পরিচিত দিনাজপুরের বাগানি ও কৃষকরা এবার দাম নিয়ে দারুণ খুশি। গত কয়েক বছরের তুলনায় দাম ভালো পাচ্ছেন। চাহিদাও রয়েছে বেশ। ২০১৯ সাল থেকে করোনার কারণে লোকসান গুনে আসছিলেন বাগানি ও কৃষকরা। এবার ভালো দাম পেয়ে তাদের মুখে হাসি ফুটেছে। বাগানি ও কৃষকরা বলছেন, স্মরণকালের সেরা দামে বিক্রি হচ্ছে লিচু। লিচুর মধ্যে সবচেয়ে ভালো দুটি জাত চায়না থ্রি ও বেদেনা। প্রতিটি বেদেনা লিচুর দাম আট থেকে ১৩ টাকা পর্যন্ত পাচ্ছেন কৃষকরা। চায়না থ্রি প্রতিটি লিচুর দাম পাচ্ছেন ১৫ থেকে ২৬ টাকা পর্যন্ত। এর আগে এই দুই জাতের লিচুর সর্বোচ্চ দাম ছিল ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত।
দিনাজপুরের ১৩ উপজেলায় কমবেশি লিচু উৎপাদন হয়েছে। তবে সদর উপজেলার মাসিমপুর ও বিরল উপজেলার মাধববাটী এলাকার লিচুর চাহিদা ও দাম বেশি। মাটির গুণাগুণ লিচু চাষের উপযোগী হওয়ায় এই দুই এলাকার লিচু বড় হয়। স্বাদও বেশি। বর্তমানে দিনাজপুরে লিচুর বাজার জমজমাট। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে ব্যস্ত জেলার সবচেয়ে বড় লিচুর বাজার দিনাজপুরের গোড়-এ শহীদ বড় ময়দান। সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এই বাজারে বেচাকেনা চলে।
এখানকার লিচু জেলার চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সাতক্ষীরা, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বগুড়া ও সিলেটসহ বিভিন্ন জেলায় যায়। এসব লিচু কেনার জন্য ওসব জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন এই বাজারে আসেন।
দিনাজপুরের গোড়-এ শহীদ বড় ময়দান লিচু বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘বর্তমানে বাজারে বোম্বাই লিচু প্রতি হাজার বিক্রি হচ্ছে ২৫০০ থেকে ৩৫০০ টাকা। গোলাপি লিচু বিক্রি হচ্ছে পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা, লংগদানা লিচু বিক্রি হচ্ছে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা, বেদেনা লিচু বিক্রি হচ্ছে আট থেকে ১৩ হাজার টাকা, হাড়িয়া লিচু আট থেকে ১২ হাজার এবং চায়না থ্রি ১৫ থেকে ২৬ হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত কয়েকদিন ধরে লিচুর বাজার চড়া। প্রথম দিকে বাজারে এত দাম ছিল না। চাহিদা বেশি এবং জোগান কম হওয়ায় দাম বেড়ে গেছে।
গোড়-এ শহীদ বড় ময়দান বাজারে লিচু বিক্রি করতে আসা বিরল উপজেলার পূর্ব মহেশপুর এলাকার ইলিয়াস আলী বলেন, ‘কীটনাশক ও সারের দাম বেশি। ফলে বেশি দামে লিচু বিক্রি করতে হচ্ছে।’ চিরিরবন্দর উপজেলা থেকে লিচু বিক্রি করতে আসা রহমত আলী বলেন, ‘গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার লিচুর দাম ভালো পাচ্ছি। গত তিন বছর শুধুই লোকসান হয়েছে। দাম ভালো হলেও ফলন তেমন ভালো হয়নি। ভালো ফলন হলে অনেক লাভ হতো।’ বিরলের ধুকুরঝাড়ী থেকে লিচু বিক্রি করতে আসা কৃষক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এবার ফলন কম, এজন্য দাম বেশি। আমার ৪০টা গাছ আছে। এসব গাছে যে লিচু ধরেছে তাতে তিন লাখ টাকার বিক্রি হবে। খরচ হয়েছে ৫০ হাজারের মতো। বলা যায় ভালোই লাভ হচ্ছে এবার।’
বিরলের লিচু বাগানি মোসাদ্দেক হোসেন, ‘কৃষকরা কাঙ্ক্ষিত দাম পাচ্ছেন। করোনার প্রভাব না থাকায় সারাদেশে যাচ্ছে লিচু। যদিও গরমের কারণে লিচুর মুকুল ঝলসে গেছে। তবে দাম বেশি পাওয়ায় কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি, লিচু সংরক্ষণের জন্য হিমাগার নির্মাণের। প্রযুক্তি ও প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে যাতে সারা বছর লিচু পাওয়া যায়। সেই পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। পাশাপাশি লিচু পরিবহনের জন্য ট্রেন চালু করা গেলে সুবিধা হতো। কৃষকরা আরও লাভবান হতেন।’
ভৈরব থেকে গোড়-এ শহীদ বড় ময়দান বাজারে লিচু কিনতে আসা ব্যবসায়ী সোহরাব হোসেন বলেন, ‘বাজার লিচুর যে দাম তাতে ভালো ব্যবসা হচ্ছে না আমাদের। ভৈরবেও দাম বেশি। দাম বেশি হওয়ায় চাহিদা কম। মানুষ ভাত-মাছ, তরকারি কেনার পর ফল কেনে। এবার এমনিতেই সবকিছুর দাম বেশি। তবে লিচু বাগানিরা যে পরিমাণ লাভবান হচ্ছেন সে তুলনায় আমাদের লাভ সীমিত।’
দিনাজপুরের ভাই ভাই ফল ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী এনামুল হক বলেন, ‘গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার লিচুর দাম অনেক বেশি। আমরা বেশি দামে কিনে বেশি দামেই বিক্রি করছি। লিচুর মধ্যে সবচেয়ে ভালো হচ্ছে চায়না থ্রি ও বেদেনা। এই জাতের লিচুর চাহিদা কম থাকলেও দাম সবসময় বেশি।’
দিনাজপুরের লিচুর আড়তদার এলভি গার্ডেনের স্বত্বাধিকারী বুলবুল বলেন, ‘বেশি দামে কিনে বেশি দামেই বিক্রি করছি। আমাদের তো তেমন লাভ নেই। এবার স্মরণকালের সেরা দামে লিচু বিক্রি হচ্ছে। চায়না থ্রি লিচুর শ ১৮০০-২৬০০ টাকা বিক্রি করছি। বেদেনা ৮০০ থেকে ১৩০০ টাকা বিক্রি করছি। কেনা দামের চেয়ে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করছি।’ জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দিনাজপুরে পাঁচ হাজার ৪৮১ হেক্টর জমিতে লিচু বাগান আছে পাঁচ হাজার ৪১৮টি। এর মধ্যে বোম্বাই লিচু তিন হাজার ১৭০, মাদ্রাজি এক হাজার ১৬৬, চায়না থ্রি ৭০২ দশমিক ৫ হেক্টর। কৃষিবিদ প্রদীপ কুমার গুহ বলেন, ‘গত বছর দিনাজপুরে লিচু বিক্রি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪০০ কোটি টাকার। এবার দাম বেশি চাহিদাও বেশি। তাই সাড়ে ৬০০ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হবে বলে আশা করছি।’




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com