হযরত আদম (আ) এর সন্তানগণ আল্লাহর পথে চলতেন এবং তারা ভালো ভালো কাজ করতেন। দেখতে দেখতে মানুষের সংখ্যা বাড়তে লাগল। দিন যত যেতে লাগল মানুষ পাপের পথে পা বাড়াল। তাদের কেউ কেউ ধর্মপ্রাণ লোকদের সম্মানে মূর্তি বানানো শুরু করল। একসময় এসব মূর্তিকে স্রষ্টা মনে করে মানুষ মূর্তিপূজা আরম্ভ করে দিল এসব লোকেরা এক আল্লাহকে ভুলে গেল। তারা আল্লাহর দেয়া সঠিক পথও হারিয়ে যেতে বসল। ধীরে ধীরে মানুষ মিথ্যা, প্রতারণা ও ধোঁকার শিকার হল। ফলে সমাজ অন্যায়-অবিচারে ভরে গেল। সমাজের ধনী ও প্রভাবশালীরা গরিব ও অসহায় মানুষের ওপর অত্যাচার চালাতে লাগল। মানবতার এ দুর্দিনে মহান আল্লাহপাক মানুষের হেদায়াতের জন্য হযরত নূহ (আ)-কে দুনিয়ায় পাঠালেন। নূহ (আ) এসে বিভ্রান্ত মানুষকে সত্যপথে চলার কথা বললেন। তিনি মানুষকে আল্লাহর কাছে তাদের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে আহবান জানালেন, অত্যাচারী মানুষকে গরিব ও অসহায় মানুষের ওপর অন্যায়-অত্যাচার করতে নিষেধ করলেন। নূহ (আ) লোকদেরকে আখেরাতে আল্লাহর কাছে তাদের জবাবদিহি সম্পর্কেও সতর্ক করলেন। তিনি বললেন, শেষ বিচারের দিন সবাইকে দুনিয়ার জীবনে তার ভালো মন্দ সকল কাজ করবে তারা সুখের স্থান জান্নাতে যাবে, আর যারা পাপের কাজ করবে তাদের আবাস হবে কঠিন শাস্তির স্থান জাহান্নাম। কতিপয় মানুষ হযরত নূহ (আ) এর কথায় সাড়া দিল। তারা আল্লাহর দীনকে মেনে নিল। অধিকাংশ মানুষই তার কথায় কান দিল না। এবং এসব লোক নবীর কথায় প্রতিবাদ করল। এমন কি তারা নবীর ওপর চড়াও হল। তারা নূহ (আ)-এর ক্ষতির চেষ্টা করল। কিন্তু নূহ (আ) তাদের খারাপ ব্যবহারে রুষ্ট হলেন না। তিনি ধৈর্যধারণ করলেন এবং এসব পাপী লোকের ক্ষমার জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করলেন। তিনি পথহারা লোকদের কাছে বারবার আল্লাহর কথা বলতে থাকলেন। কিন্তু লোকেরা তাঁর কথায় কর্ণপাত তো করলই না, বরং দিনকে দিন তারা আরো খারাপের দিকে ধাবিত হতে লাগল। অবশেষে হযরত নূহ (আ) লোকদেরকে ভালো পথে না আসার পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করলেন। তিনি বললেন, আল্লাহকে না মানলে তাঁদের জন্য কঠিন আযাব অপেক্ষা করছে। তিনি এক ভয়ানক বন্যার পরিণাম সম্পর্কেও লোকদের অবগত করলেন। তিনি বললেন, শীঘ্রই এমন এক বন্যা হবে, যা দুনিয়ার সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে এবং দুনিয়া ধ্বংস্তুপে পরিণত হবে। লোকেরা আল্লাহপাকের এ কথা বিশ্বাস করল না। বরং এটাকে তারা নবীর এক তামাশা মনে করল। এ কথার জন্য তারা আল্লাহর নবীকে উপহাস করল এবং তাঁকে পাগল বলেও গালমন্দ করল। এমতবস্থায় আল্লাহর সিদ্ধান্ত এসে গেল। নূহ (আ) যে বন্যার আভাস দিয়েছিলেন তার আয়োজন শুরু হয়ে গেল। আল্লাহতায়ালা হযরত নূহ (আ) কে একটি নৌকা তৈরি করার নির্দেশ দিলেন। নৌকা বানানোর যাবতীয় কৌশলও নবীকে আল্লাহ শিক্ষা দিলেন। কিস্তি তৈরি করতে বেশ সময় লাগল। তারপর নূহ (আ) ও তাঁর অনুসারীগণ আল্লাহর নির্দেশ মত দুনিয়ার সব প্রাণী সংগ্রহ করলেন। এসব প্রাণীর পুরুষ মহিলারা জোড়া মিলিয়ে নৌকায় নিয়ে তুললেন। দেখতে দেখতে সব আয়োজন সম্পন্ন হয়ে গেল। হঠাৎ একদিন দেখা গেল ধীরে ধীরে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। ঝড়ের আভাসও লক্ষ্য করা গেল। হযরত নূহ (আ) তাঁর লোকদেরকে বললেন, তোমরা আল্লাহর নামে কিস্তিতে আরোহণ কর। বিশ্বাসী লোকেরা হযরত নূহ (আ) কথায় সাড়া দিল। তারা কিস্তিতে গিয়ে উঠল। কিন্তু ছেলে কেনান পিতার কথায় বিশ্বাস করল না। সে নৌকায় উঠতে অস্বীকার করল। তবে তার ভাই শাম, হাম, যাপেথসহ অন্যান্য বিশ্বাসী নৌকায় চড়ে বসল। নূহ (আ) এর স্ত্রী ওয়ালিয়া স্বামীর দীনের প্রতি বিশ্বাসী ছিল না। তাই নূহ (আ) তাকে ফেলে গেলেন। এদিকে সহসাই বাতাস শক্তিশালী হয়ে উঠল, বৃষ্টি প্রচন্ডরূপ ধারণ করতে থাকল। আল্লাহর আদেশে বন্যার দরজাগুলো খুলে গেল এবং বৃষ্টির পানি অঝোর ধারায় দ্রুত নেমে এল। অজস্র পানির ধারা তীব্র বেগে পৃথিবীর মধ্য থেকে উদগীরণ হতে লাগল। শীঘ্রই নদীগুলোর পানি ওপরের দিকে ধাবিত হল এবং তা পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। কিস্তির যাত্রীরা ঝড়ের ভয়ানক ধাপাধাপি এবং পানির বিশাল বিস্তৃতি দেখে ভীত হয়ে পড়লেন। তবে তারা জানতেন আল্লাহপাক অবশ্যই তাদের নিরাপদেই রাখবেন। প্রচন্ড ঝড় এবং অবিরাম বৃষ্টির ভয়ংকর সেই মুহূর্তে কিস্তির যাত্রীরা আল্লাহতায়ালার অশেষ করুণার জন্য তাঁর প্রশংসায় মগ্ন থাকলেন। দেখতে দেখতে সকল উপত্যকা পানিতে ভেসে গেল। উঁচু উঁচু পাহাড়গুলো পানিতে ডুবে অদৃশ্য হয়ে গেল। সরারাত ঝড় বইল এবং অঝোর ধারায় বৃষ্টিপাত হল। বন্যার পানি যখন তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হল, তখন আল্লাহ নির্দেশ দিলেন, হে মাটি! তোমার সমুদয় পানি গিলে ফেল। হে আকাশ তোমার বৃষ্টি ফিরিয়ে নাও। (সূরা: হুদ, আয়াত: ১৪)। আল্লাহর নির্দেশ মত হঠাৎ বৃষ্টি থেমে গেল। পানি শুকিয়ে যেতে শুরু করল। আকাশ মেঘমুক্ত হতে হল। সকালে সূর্য উঠে অন্ধকার দূরে সরিয়ে দিল। পানির ধারা যতই কমতে লাগল ধীরে ধীরে পাহাড়গুলোর চূড়া জেগে উঠল। নূহ (আ) এর কিস্তি জুদি পাহাড়ের ওপর আটকে গেল এবং সেখানেই অবস্থান নিল। জুদি পাহাড় বর্তমান তুরস্ক, সিরিয়া এবং ইরাকের সীমান্তে অবস্থিত। নূহ (আ)-এর অবিশ্বাসী পুত্র ও স্ত্রী তাদের কর্মের জন্য শাস্তি পেল এবং বন্যার তোড়ে ভেসে গেল। হযরত নূহ (আ) এবং অন্য সাথিরা নিরাপদে থাকার জন্য আল্লাহর অশেষ শোকরিয়া আদায় করলেন। হযরত নূহ (আ) আল্লাহর শুকরিয়া জানাতে সেজদায় পড়ে গেলেন। মহান আল্লাহতায়ালা বিশ্বাসীদের এভাবেই পুরস্কৃত করলেন এবং দুনিয়াকে দুষ্ট লোকের হাত থেকে মুক্ত করলেন। নূহ (আ)-এর এ ভয়ানক বন্যা ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য এক সতর্কবাণী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।