রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০২:২১ পূর্বাহ্ন

বিশ্বে চরম খাদ্যাভাব কি অত্যাসন্ন?

ড. মো. ফখরুল ইসলাম :
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৪ জুন, ২০২২

অনবরত বিপর্যয়ের মুখে বিশ্ব পরিবেশ-পরিস্থিতি। মানবসভ্যতা বিধ্বংসী অনাহূত নানা সমস্যা বিশ্বের প্রতিটি আনাচেকানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে পৃথিবীর মানুষের জরুরি পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহ কাজে বিপত্তি ঘটতে থাকায় টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে প্রায় প্রতিটি দেশে। অন্যান্য সংকটের কথা কিছুটা উল্লেখ করলেও জাতিসংঘ বারবার বিশ্ব খাদ্যসংকট নিয়ে সতর্কবার্তা প্রচার করে চলেছে। মানুষের মানবিক সহায়তার দেওয়ার কাজে জাতিসংঘ সব সময় উদগ্রীব। কিন্তু চহিদার তুলনায় মানবিক সাহায্য ও সহায়তার ঘাটতির মুখোমুখি হলেই সংস্থাটি বেশি অসহায়ত্ব প্রকাশ করে। আর এটি করবে না-ই বা কেন? সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ভয়াবহতায় পেশিশক্তিগুলোর মধ্যে ক্রমাগত পাস্পরিক হুমকি ও দোষারোপ করার ঘটনা বিশ্বকে একটি চরম নাজুক অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। মে ২৪, ২০২২ তারিখে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ কার্যালয়ের রুশ কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন। ইউরোপের বহু দেশে রাশিয়ার গ্যাস-তেল, বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। ইউরোপের খাদ্যভান্ডার ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইউরোপে খাদ্য সরবরাহ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন সবাই। ব্রিটেনে জার্মানি, ফ্রান্স, হল্যান্ড, ইতালির খাদ্যসরবরাহ কমে গেছে। ফলে ব্রিটেনের বাজারে পর্যাপ্ত খাদ্যসামগ্রীর সরবরাহ না থাকায় দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেছে। ঐতিহাসিক প্রতিটি যুদ্ধের পর পৃথিবীতে ব্রিটেন থেকেই অর্থনৈতিক মন্দা ও মহামারির উৎপত্তি হয়েছিল। সেগুলো মূলত ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও বিশ্ববাণিজ্য ঘাটতি থেকে সৃষ্ট খাদ্যাভাব থেকে উৎপত্তি লাভ করেছিল। আইরিশ পটেটো ফ্যামিইন, ব্লাকডেথ (প্লেগ), লুডিট শ্রেণির জাগরণ, সামাজিক অনাচার ইত্যাদির কথা মানুষ কখনো ভুলতে পারবে না। সেগুলো কার্যত ছিল রোমানদের সঙ্গে ব্রিটিশদের দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের ফসল। এখন আধুনিক সভ্যতার ধ্বজাধারীদের একগুঁয়েমি মনোভাব সেই ধরনের সংকটের পুনরাবৃত্তি করার মখোমুখি করে ফেলেছে। তার প্রভাব মানুষ পেতে শুরু করেছে। পাশাপাশি ভারত, আফগানিস্তান, ব্রাজিল প্রভৃতি দেশও গম রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। এই সংবাদ চাউর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে দেশে মজুতদাররা তৎপর হয়ে খাদ্যগুদামে তালা লাগিয়ে দিয়ে কৃত্রিম খাদ্যসংকট তৈরি করে ফেলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুনঃপুন টর্নেডো, ধূলিঝড়, বন্যা এমনকি ইরাকের মতো দেশে বারবার ভয়াবহ ধূলিঝড়ে ব্যাপক ফসলহানি ও জনস্বাস্থ্যের বিপর্যয় বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলেছে। ইরাকের বহু মানুষ ধূলিঝড়ের কারণে মারাত্মক শ্বাসকষ্ট নিয়ে মানুষ ভিড় করছেন হাসপাতালে।
আমাদের দেশেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রচ- ঢেউ লক্ষ করা যাচ্ছে। কার্তিক ও চৈত্র বৈশাখ মাসের অকালবন্যায় আমাদের হাওর ও সমতল সব এলাকায় ব্যাপক ফসলহানি এক অশনি সংকেতের জানান দিচ্ছে। আসামে অধিক বৃষ্টিপাত এবং মণিপুর, মিজোরাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা প্রভৃতি এলাকায় একটানা ভারী বর্ষণের ফলে আমাদের দেশের সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, ধলাই প্রভৃতি নদীগুলো প্রতি বছরের মতো পানি ধারণ ও সাগরের দিকে প্রবাহিত করতে অপারগ হওয়ায় সিলেট বিভাগে দেখা দিয়েছে প্রবল বন্যা ও উঠতি ফসল বিনষ্টকারী জলাবদ্ধতা। হাওর সন্নিকটস্থ সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা, শাল্লা, দিরাই; নেত্রকোরার খালিয়াজুরী, কলমাকান্দা প্রভৃতি জায়গায় পানিতে তলিয়ে গেছে পাকা ধান। এক রাতেই হঠাৎ পানিতে ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ায় তারা ধানকাটার জন্য যথেষ্ট সময় পাননি। মে ২৫ তারিখেও কৃষকরা পানির নিচ থেকে পচা ধান কাটার জন্য মজুর খুঁজে পাচ্ছেন না। এমনকি পানিতে তলানো ধান কেটে দিলে অর্ধেক ধান মজুরকে দেওয়া হবে ঘোষণা দেবার পরও কৃষিশ্রমিকের দেখা নেই। কেউ নিজেরা ধান কাটতে পারলেও অনবরত বৃষ্টির ফলে ধান এবং খড় শুকানোর শুষ্ক জায়গা নেই। অনেক টাকা খরচ করে অধিক উৎপাদনের হাতছানি দেখলেও এখন লাভের হার শূন্য। এছাড়া এসব এলাকায় মাছের ঘেরে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষকদের লাখ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। শুধু সিলেট বিভাগে ৮ কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে বলে সংবাদ হয়েছে। এভাবে বারবার বন্যায় প্রধান খাদ্য ধান ও আমিষের প্রধান উৎস মাছ উধাও হলে এসব খাদ্যের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। দেশের এক এলাকার খাদ্য নষ্ট হয়ে গেলে অন্য এলাকার চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। এভাবে সব জায়গায় খাদ্যদ্রব্যের ঘাটতি হলে বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি হওয়ায় দ্রুত মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হচ্ছে। এক মাস পূর্বে রেস্টুরেন্টে একটি রুটি বা পরোটার দাম ছিল পাঁচ টাকা। সেটা এক লাফে ১০ টাকা হয়েছে। একটি পরোটা কোথাও ১৫ টাকা আবার কোথাও ২০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। খোলা দোকানে একটি কালাই রুটির দাম ছিল ১৫ টাকা। সেটি এক লাফে ৩০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। অজুহাত একটিইÍসেটা হলো বাজারে গম নেই, তাই আটা ময়দার দাম বেশি। খুচরা বিক্রেতারা সেই কথা বলছেন ভোক্তা সাধারণকে। ভোক্তারা চরম অসহায়। তারা ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ করছেন অতিকষ্টে। কেউ কম খাচ্ছেন আবার কেউ না খেয়ে দিনাতিপাত করলেও লজ্জায় কারো কাছে সেটা প্রকাশ করতে চাইছেন না। দিনমজুর ও নি¤œআয়ের মানুষেরা এ নিয়ে চরম ভোগান্তির সম্মুখীন হয়ে নির্ভরশীল পরিবার-পরিজনসহ নিদারুণ সংকটে রয়েছেন।
করোনার কারণে গত তিন বছরে সারা বিশ্বে অর্থনীতিতে ধস নেমেছে। বেকারত্ব বেড়েছে। এছাড়া জলবায়ুর চরম বিপর্যয় শুরু করেছে খাদ্যোৎপাদনে সংকট। জলবায়ুর বিপর্যয় ঠেকাতে কোনো উদ্যোগ ঠিকভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। তার আগেই অকালে খরা, বন্যা, ফ্লাসফ্লাড, ভূমিধ্বস ইত্যাদিতে কৃষকরা নাকাল হয়ে পড়েছে দেশে দেশে। এগুলোর মধ্যে যুদ্ধের গরম শাসানি বিশ্ববাণিজ্যে আতঙ্ক তৈরি করায় খাদ্য সরবরাহে মারাত্মক সংকট তৈরি হয়েছে। এত কিছুর মধ্যে আরেক আতঙ্ক হিসেবে আবিভূর্ত হচ্ছে মাঙ্কি পক্স। এটা বিশ্ব জনস্বাস্থ্যের জন্য নতুন ত্রাস, আতঙ্ক। যদিও মাঙ্কি পক্স করোনার মতো ততটা ভয়াবহ নয় বলে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু গরিব দেশগুলোর অর্থনীতিকে আরো পিছুটান দেওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট। মানুষ কোনোটাই আমলে নেয় না। ফলে সব রোগের জীবাণু থেকেই যায় সব জায়গায়। আর সেগুলো কিছুদির পর পর আবার মাথাচাড়া দিয়ে মানবহত্যা বা শিকারে মেতে ওঠে নতুন রূপে। গুটি বসন্তের দিনগুলোর কথা মানুষ এখনো ভোলেনি। এই টিকার বড় চক্রকার দাগ এখনো ৪০ বছর বয়সি সব মানুষের দুই ডানায় দৃশ্যমান। গুটি বসন্ত ও যক্ষ্মার টিকার দাগের ওপর দেওয়া হয়েছে করোনার টিকা-বন্দুকের গুলি। করোনার বুস্টার ডোজের মেয়াদ আসলে কয় মাস কার্যকরী থাকবে সেটা কেউই মুখ ফুটে বলছেন না। তাই বুস্টার নেওয়ার পরও করোনা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সেটা শেষ না হতেই আসল গুলি ছুড়তে শুরু করেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। আর তাতে জোগান দিচ্ছে ন্যাটো। তাই শিগ্গির যুদ্ধ থামার কোনো আশা নেই বলে মনে হচ্ছে।
গত মাসে প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও নানা জটিলতা আমাদের নানা অশনিসংকেতের ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। যদিও সেটাকে অনেকে হেসে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছেন কিন্তু তলে তলে তাদের অন্তরের কাঁপুনি বিভিন্ন কর্মকা- ও বচনে ফুটে উঠছে। এ সময় বিশ্বে যতগুলো আতঙ্ক বিরাজ করছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় আতঙ্ক হলো খাদ্যাভাব। কারণ ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবীর সব ছন্দ হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল। ক্ষুধার সময় টাকাওয়ালা মানুষেরা কি টাকা খাবে? নাকি সোনাদানা জমাকারীরা সেগুলো পানি দিয়ে গিলে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করবে, সেটা হয়তো আরো বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিতে পারে। কদিন আগে সিলেটে ১০ দিনের বন্যায় বন্যার্ত এলাকার অনেক ধনী পরিবার বাড়ির দারোয়ানকে ছাদে পাহারায় রেখে নিজেরা শহরের বহুতল হোটেলে ঠাঁই নিয়েছিলেন। গরিব বন্যার্তরা সরকারি উঁচু রাস্তায় ঠাঁই নিতে গিয়ে অনেকে শুকনো জায়গা খুঁজে না পেয়ে হয়রান হয়েছেন। অর্থাৎ, বন্যার সময়ে নিরাপদ বাসস্থানের জন্য শ্রেণিসংগ্রামের লিপ্ত হবার ভিন্ন ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। কিন্তু বেঁচে থাকার লড়াইয়ে জীবনসংগ্রামে লিপ্ত হতে গিয়ে খাওয়ার ও পানি তো সবাইকে সংগ্রহ করে খেতে হয়েছে। এজন্য হোটেলের বা বাজারের খাবার রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকায় ধনী-গরিব সবাইকে শুকনো খাদ্য সংগ্রহ করতে একই কাতারে দাঁড়াতে কুণ্ঠিত হতে দেখা যায়নি। ধনীদের টাকা এখানে ছিল বড় অসহায় এক উপাদান মাত্র। বন্যা আমাদের চিরায়ত নিয়তি। এ বছর চৈত্রে বন্যা হয়েছে, আগামী দিনে হয়তো বারো মাস বন্যা হবে। কারণ, বন্যানিয়ন্ত্রণ কাজে আমাদের চিরায়ত ঢিলেমি এবং যারপরনাই উদাসীনতা প্রতি বছর বন্যার ক্ষয়ক্ষতিকে আরো বেশি উসকে দেওয়ার নামান্তর মাত্র। পুনঃপুন বন্যা ও ভয়াবহ নদীভাঙন থেকে কৃষি অর্থনীতিকে বাঁচাতে না পারলে আমাদের সার্বিক গণক্ষুধা সমস্যা মেটানো সম্ভব নয়। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে খাদ্যবাণিজ্যে ও খাদ্যপরিবহনে ঘাটতি দেখা দেওয়ার সঙ্গে খাদ্য-আমদানিনির্ভর দেশগুলোর মাথায় বাজ ভেঙে পড়ছে। তারা ভাবছে, বিশ্বে চরম খাদ্যাভাব তাহলে কি অত্যাসন্ন? কারণ, নিজেদের পর্যাপ্ত কৃষি উৎপাদন না থাকলে এবং খাদ্য সরবরাহে দীর্ঘকালীন অবরোধ চলতে থাকলে শুধু জমা করা অর্থ, সুদৃশ্য কংক্রিটের অবকাঠামো ও বিলাসবহুল গাড়ি তাদের পেটের ক্ষুধা মেটাতে অপারগ। বিশেষ করে, এরূপ যুদ্ধময় বিশ্বপরিবেশে শরণার্থী সমস্যা, অর্থনৈতিক তথা খাদ্য অবরোধ কিংবা বৈরী প্রাকৃতিক পরিবেশে বিভিন্ন বিপর্যয়ের মুখে পড়লে সেটা শত ভাগ অপারগ বলে ধরে নেওয়া যায়। তাই আমাদেরকেও ভাবতে হবে যে কৃষি অর্থনীতিকে অবহেলা করে শুধু শহুরে বিলাসিতার জন্য ঘরবাড়ি-গাড়ি তৈরি বা ক্রয় করলে সেগুলো ক্ষুধার সময় কোনো কাজে তো লাগবেই না, বরং সেগুলো দ্রুত হারিয়ে দিতে পারে মানব জীবনের গতিময় ছন্দ। লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com