বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৫৯ অপরাহ্ন

সুখী পরিবার মানেই পরিকল্পিত পরিবার

বাসস
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৮ জুন, ২০২২

পরিকল্পিতভাবে প্রতিটি পরিবার গড়ে তোলার মাধ্যমে সমাজ তথা একটি দেশে সুস্থ, বৃদ্ধিদীপ্ত ও অর্থনৈতিক উৎপাদনক্ষম প্রগতিশীল জাতি গড়ে তোলা সম্ভব। কেননা অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ও
সুখী পরিবার গঠনে সঠিক পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিকল্পিত পরিবার গঠন কেবলই আর্থিক সামর্থ্যরে বিষয় নয়। এর সাথে সামাজিক বিষয়, নারীর ক্ষমতায়ন, মায়ের সুস্বাস্থ্য, শিশু পুষ্টি ও উৎপাদনশীলতাসহ অনেক কিছু জড়িত। সরকার বাল্যবিবাহ নিরুৎসাহিত করার জন্য ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭’ প্রণয়ন করেছে। দেশব্যাপী পুষ্টিসেবা কার্যক্রম জোরদার করেছে। পরিকল্পিত পরিবার গঠনে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
সুস্থ, বৃদ্ধিদীপ্ত ও অর্থনৈতিক উৎপাদনক্ষম জাতি গড়ে তুলতে এবং মায়ের সুস্বাস্থ্যের জন্য একটি পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। আজকের কন্যাশিশু আগামী দিনের মা। কন্যাশিশুর স্বাস্থ্যের বিষয়টি তার জন্মকালীন পরিচর্যা থেকেই আরম্ভ হয়। এরপর শৈশব, কৈশরে তার খাদ্যসহ বেড়ে ওঠার আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। পরিকল্পিত পরিবার গঠনের জন্য ১৮ বছরের আগে বিয়ে নয় এবং ২০ বছরের আগে প্রথম গর্ভধারণ নয়, ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭’ এ বিষয়গুলো উল্লেখ আছে। এছাড়াও দুটি সন্তানের মধ্যে কমপক্ষে আড়াই থেকে তিন বছরের ব্যবধান রাখা; শিশুকে প্রথম ছয় মাস শুধু মায়ের বুকের দুধ পান করানো এবং দুই বছর পর্যন্ত বুকের দুধ পান করানোর সাথে ঘরে তৈরি স্বাভাবিক অন্যান্য খাবার খাওয়াতে হবে; শিশুকে সময়মতো সবগুলো টিকা দিতে হবে এবং মায়ের বয়স ৩৫ বছরের অধিক হলে আর সন্তান ধারন না করা।
আমাদের দেশে নারীদের বিয়ের বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর। ১৮ বছরের আগে বিয়ে আইনগত নিষিদ্ধ। কিন্তু এখনো কিছু কিছু এলাকায় নারীর নির্ধারিত বয়সের আগেই বিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ২৫ ভাগ হচ্ছে কিশোর-কিশোরী। ১৮ বছরের আগে বিয়ে হলে তারা ২০ বছরের আগেই মা হয়ে পড়ে। মা হওয়ার জন্য পরিপূর্ণ শারীরিক যোগ্যতা অর্জনের আগেই গর্ভধারণ ও সন্তান জন্ম দেয়া মা এবং শিশু উভয়েরই মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়।
আবার ঘন ঘন গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবের কারণেও মায়ের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। গর্ভকালীন সময়ে সন্তান মায়ের খাদ্য ও পুষ্টির একটি অংশ গ্রহণ করে গর্ভে বেড়ে ওঠে। এরপর ঐ শিশু ভুমিষ্ট হওয়ার পর যখন মায়ের বুকের দুধ পান করে তখনও সে মায়ের খাদ্য ও পুষ্টির একটি অংশ সে গ্রহণ করে। তাই ঘন ঘন গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবের ঘটনা ঘটলে মায়ের শরীরে পুষ্টির ঘাটতি দেখা দেয়। আবার অধিক বয়সে সন্তান ধারণ করতে গিয়েও অনেক মায়ের স্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। তবে সরকারের কঠোর পদক্ষেপের কারণে এখন বাল্যবিবাহের হার অনেক হ্রাস পেয়েছে। কিশোরীরাও সচেতন হয়েছে। অনেক কিশোরী নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধ করছে। বর্তমানে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, স্কুলের শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধি সকলেই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছেন।
সন্তানের সু-স্বাস্থ্যের প্রাথমিক ভিত্তি হচ্ছে তার জন্মকালীন পুষ্টি। অপুষ্ট শিশুরা পরবর্তীতে নানান ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। অধিক সন্তানের পরিবারগুলোতে আর্থিক অনটনের কারণে জন্মপরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। দুটি সন্তানের মধ্যে যথেষ্ট সময়ের ব্যবধান না থাকলে জন্ম নেয়া শিশুটি অনেক ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত পরিমান মায়ের বুকের দুধ পান থেকে বঞ্চিত হয়। মায়ের অপুষ্টির কারণে শিশুরা বুকের দুধ পান করতে পারে না। এসব কারণে অপরিকল্পিত পরিবারে সন্তানের সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে পরিকল্পিত পরিবার গঠনের মাধ্যমে প্রতিটি শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত হয় এবং শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস ও শিশুর বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়।
প্রতিটি সন্তানের শিক্ষা, বিনোদন, শারীরিক এবং মানসিক বৃদ্ধির সুযোগগুলো নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি পরিবারে সন্তান সংখ্যা সীমিত রাখা প্রয়োজন। অন্যথায় আর্থিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সঠিকভাবে নজর দেয়া সম্ভব হয় না। আর অসচ্ছল পরিবারের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরো ভয়াবহ রূপ নেয়।
পরিবারের যথাযথ সেবাযতœ ও পুষ্টিকর খাবারের অভাবে শিশুর সুষম বিকাশ বাধাগ্রস্ত বা বিলম্বিত হয়। তাদের অনেকেই ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে বেড়ে ওঠে, তারা নিজ পরিবারে বিড়ম্বনার কারণ হয়ে পড়ে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। নানারকম সামাজিক সমস্যা হ্রাস করার জন্য চাই প্রতিটি সন্তানের যথাযথ যতœ তথা শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের পর্যাপ্ত সুযোগ। পরিকল্পিত তথা দুটি সন্তানের পরিবার না হলে কাজটি অত্যন্ত দূরূহ হয়ে পড়ে।
নিজ পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রকাঠামোর সর্বত্র স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখার জন্যও প্রতিটি পরিবার হওয়া দরকার পরিকল্পিত পরিবার। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি হলে, বিশেষ করে সেই পরিবারে আর্থিক অনটন থাকলে, পারিবারিক পরিমন্ডলে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ রক্ষা কিছুতেই সম্ভব হয় না। অল্প জায়গায় বেশি মানুষ একত্রে অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় থাকতে হয়। যার প্রভাব পরবর্তীতে পরিবার ও রাষ্ট্রের উপর বর্তায়। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে, যানবাহন, হাটবাজার, রাস্তা-ঘাটসহ নানারকম নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তি কঠিন হয়ে পড়ে। বায়ু দূষণ, শব্দদূষণ বেড়ে যায়।
২০১১ সালে ‘জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি’ প্রণয়নের পর বর্তমান সরকারের করা ‘জাতীয় ওষুধ নীতি-২০১৬’, ‘জাতীয় পুষ্টি পরিষদ’ গঠনের মাধ্যমে দেশে স্বাস্থ্য সেবা ও পুষ্টিসেবা জোরদার করা হয়েছে। নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করার লক্ষে মা ও শিশুস্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ নজর দেয়া হয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা’র আলোকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ব্যাপক কর্মসুচি বাস্তবায়ন করছে। বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের ফলে জন্মনিয়ন্ত্রণ সমগ্রী ব্যবহার প্রায় ৭০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। শিশুর টিকাদানের হার প্রায় শতভাগে উন্নীত হয়েছে। দেশের সার্বিক স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটেছে। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’র স্বাস্থ্যবিষয়ক সূচকগুলো অর্জনে এ সকল উন্নয়নমূলক কর্মসূচি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু হার হ্রাস এবং শিশুর যথাযথ শারীরিক ও মানসিক বিকাশের পথ সুগম করতে পরিকল্পিত পরিবার গঠনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর সামগ্রিক যতœ ও সেবা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি পরিবারই হওয়া চাই পরিকল্পিত পরিবার। আর সুখী পরিবার মানেই পরিকল্পিত পরিবার।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com