বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৩ পূর্বাহ্ন

ঈদুল আজহা : আত্মত্যাগ ও স¤প্রীতির উৎসব

মো: মুরাদ হোসেন
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৮ জুলাই, ২০২২

বছর ঘুরে আবারো এসেছে মুসলমানদের অন্যতম স¤প্রীতির উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা। যে উৎসব মুসলিম সমাজে সাম্য ও স¤প্রীতিপূর্ণ ভালোবাসার জোয়ার বয়ে আনে। ঈদ ও আজহা দু’টিই আরবি শব্দ। ঈদ-এর অর্থ উৎসব বা আনন্দ। আজহার অর্থ কোরবানি বা উৎসর্গ করা। আর এ জন্যই কোরবানির ঈদকে ‘ঈদুল আজহা’ বলা হয়। অন্যদিকে ‘কোরবানি’ শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো- নৈকট্য অর্জন করা, কারো কাছাকাছি যাওয়া। পারিভাষিক অর্থে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট পশু জবাই করাকে কোরবানি বলে। সব ভেদাভেদ ও মানবীয় হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে দলবেঁধে ঈদের নামাজ আদায় করে পারস্পরিক আলিঙ্গনের পর পশু কোরবানির মাধ্যমে এক মহোৎসব পালিত হয়, যা সমাজে ভাতৃত্বপূর্ণ সহাবস্থান সৃষ্টি করে। যে কোরবানি উৎসব আদি পিতা হজরত আদম আ: থেকে শুরু হয়ে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। মহান আল্লাহ এই সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির বিধান নির্ধারণ করে দিয়েছি যাতে তারা ওই পশুদের জবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। আর তোমাদের প্রতিপালক তো এক আল্লাহই, তোমরা তাঁরই অনুগত হও’ (সূরা হজ-৩৪)। তবে কোরবানি ইবাদতের মর্যাদা লাভ করেছে মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আ: ও তাঁর পুত্র হজরত ইসমাইল আ:-এর ঐতিহাসিক সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। দীর্ঘ প্রার্থনা ও প্রচেষ্টার পর ৯০ বছর বয়সে ইবরাহিম আ: নিজ সন্তানের পিতা হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন। কিন্তু যখন আল্লাহ ইবরাহিম আ:-কে পরীক্ষা করার জন্য স্বীয় পুত্রকে কোরবানি করতে বললেন, তখন কোনো সংশয় ছাড়াই তথা বিনা প্রশ্নে নিজ স্নেহাস্পদ সন্তানকে কোরবানি করতে নিয়ে গেলেন। ইবরাহিম আ:-এর প্রিয় বস্তু কোরবানি এমন ত্যাগ ও একনিষ্ঠতায় খুশি হয়ে আল্লাহ সমগ্র মুসলিম জাতিকে আত্মত্যাগ ও তাঁর হুকুম পালনে একনিষ্ঠতা শিক্ষা দেয়ার জন্য কোরবানির এই বিধান ইবাদতের মর্যাদায় নাজিল করেন। যে বিধান যথাযথভাবে পালন করেছেন আল্লাহর প্রিয় রাসূল সা: ও তাঁর সাহাবিরা। সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমান মুসলিম জাতিও আল্লøাহর সন্তুষ্টি ও সামাজিক স¤প্রীতি অর্জনের লক্ষ্যে কোরবানি করে যাচ্ছে।
কোরবানি মুসলমানদের সাম্য, স¤প্রতি ও ভাতৃত্ববোধ জাগ্রত করে সামাজের আদর্শ মানুষ হতে শেখায়। সমাজের শ্রেণিগত বিভেদ দূর করে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা ও সুবর্ণ সুযোগ দান করে। পশু কোরবানির মাধ্যমে মানবমনে বিরাজমান যাবতীয় পশুত্ব তথা নির্মমতা, ক্রোধ, হিংসা, অত্যাচারী মনোভাবের অশুভ কর্মেচ্ছার মূলোৎপাঠন ঘটানোর দীক্ষাই কোরবানির মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ পেয়ে থাকে। নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের মধ্যে কোরবানির গোশত বণ্টনের মাধ্যমে সামাজিক স¤প্রীতি ও সহাবস্থানের আবহ তৈরি হয়। মানবতাবোধের জয়ধ্বনি দিয়ে মুসলিম সমাজের সব শ্রেণীর মানুষ সব ধরনের মতপার্থক্য ভুলে একে অন্যের সাথে ঈদের আনন্দ বিনিময় করে জবাইকৃত পশুর গোশত নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়। যাতে রয়েছে সামাজিক সমতার মহান আদর্শ। কোরবানির গোশত কাউকে দান করা অন্যান্য দান-সদকার চেয়ে উত্তম। রাসূল সা: বলেছেন, ‘মানুষের কল্যাণ-সংশ্লিষ্ট যত কাজ আছে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম হচ্ছে দরিদ্র ও ক্ষুধার্তকে খাবার দান করা’ (বুখারি-১২)। কোরবানির বিধানের মাধ্যমে সমাজে একের সম্পদে অন্যের অধিকারের বিষয়টি বিশেষভাবে উন্মোচিত হয়। ইসলাম শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক সম্পদ অর্জন ও ভক্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সমাজের সার্বিক কল্যাণময় কার্যক্রমে এগিয়ে আসতে বিশেষভাবে উৎসাহিত করে। কেননা, কোরবানি শুধু ধর্মীয় উৎসবই নয়; বরং ত্যাগের দীক্ষায় পরিশুদ্ধ জীবন গঠন ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠনের নিয়মতান্ত্রিক অনুশীলনও বটে। ঈদুল আজহা সমাজের মানুষের হৃদয়ে আত্মত্যাগের শিক্ষাকে প্রোথিত করে মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে বিশেষ অনুপ্রেরণাই দিয়ে থাকে। যার ফলে প্রতি বছর ঈদ মুসলমানদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করে পারস্পরিক ভালোবাসা ও স¤প্রীতির সংযোগ-মোহনায় দাঁড় করিয়ে সামাজিক মানবতাবোধের শক্তিতে বলীয়ান করে। কোরবানি মুসলমানদের সব কর্মের উদ্দেশ্য ও নিয়ত সম্পর্কে সুস্পষ্টতা দেয়। অর্থাৎ মানবজীবনের সব কাজ হতে হবে শুধু মহান রবের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। তাতে থাকবে না কোনো লৌকিকতা বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থ। কেননা, কর্মের উদ্দেশ্য সঠিক বা পরকল্যাণমুখী না হলে বিশৃঙ্খলার সম্ভাবনা থাকে। তাই আল্লাহ যেকোনো কাজের আগে নিয়ত ও উদ্দেশ্য ঠিক করতে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন। ঈদুল আজহার সাথে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেরও বিশেষ সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে দেশের নি¤œমধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ ও খামার ব্যবসায়ীরা বিশেষ পুঁজি বিনিয়োগ করে থাকেন। শুধু ঈদ পূর্ববর্তী এক সপ্তাহে পশু ও কোরবানির সরঞ্জামাদি ক্রয়-বিক্রয় এবং পশু পরিবহন ইত্যাদি খাতে দেশে কয়েক হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়। বিত্তবান মুসলমানদের থেকে দান-সদকার মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের অর্থ নি¤œ আয়ের মানুষের কাছে হাতবদল হয়। যার ফলে দেশের অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়। প্রকৃত মুসলিমরা কোরবানিকে শুধু গোশতের স্বাদ আস্বাদনের উৎসবে সীমাবদ্ধ না রেখে এর গভীর তাৎপর্যের দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে। পবিত্র ঈদুল আজহা ইবরাহিম আ:-এর ঘটনা স্মরণ করে দিয়ে মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহর হুকুম আহকাম পালনে সর্বপ্রকার ঠুনকো যুক্তি, অলসতা ও কার্পণ্যতা পরিহারের শিক্ষাই দিয়ে থাকে। উচ্চশিক্ষার সনদ গ্রহণের আগে যেমন ধারাবাহিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়, তেমনি আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে অনেক সময় বিভিন্ন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়, যা ধৈর্য ও একনিষ্ঠতার সাথে গ্রহণ করে ইসলামের পথে অবিচল থাকার নামই আত্মত্যাগ। যে আত্মত্যাগের বিষয়টি ইবরাহিম আ:-এর ঘটনার মাধ্যম মুসলিমদের স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। অর্থাৎ ইসলামী শরিয়া মুসলিমদের যে সুনির্দিষ্ট পথে চলতে বলে তাতে কোনো সংশয় বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব না রেখে এক আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই যথাসাধ্য পালনের চেষ্টা করা। মানবসভ্যতার বিকাশে মুসলমানদের জন্য কোরবানির ত্যাগ ও স¤প্রীতির শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা, ত্যাগ ব্যতীত কোনো সমাজ ও সভ্যতা বিনির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। পিতা-মাতার ত্যাগ ও কোরবানির বদৌলতেই সন্তান প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠে। তেমনি কোরবানি মুসলমানদের শুধু আনন্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সব ধরনের হিংসা-বিদ্বেষ ও ভেদাভেদের কালো পাথরকে ভেঙে দিয়ে পারস্পরিক স¤প্রীতি ও সহানুভূতিশীল আচরণের শিক্ষাই দেয়, যা তাদের ঐক্যের বন্ধনে একীভূত করে শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে অনুপ্রাণিত করে। ঈদুল আজহার আত্মত্যাগের শিক্ষা ও আদর্শ গ্রহণ করে বাস্তব জীবনে সেটি প্রতিফলিত করতে পারলেই শান্তিপূর্ণ সামাজিক সহাবস্থান নিশ্চিত হবে। লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com