অনুজতুল্য নুমান জামান (এখন ফরিদী নুমান) বাংলাদেশের কিংবদন্তিতুল্য কবি কথাশিল্পী সম্পাদক আল মাহমুদের ৮২তম জন্ম দিনে তিন দশকের বেশি সময় আগের একটি ছবি পোস্ট করে কিছু স্মৃতি চারণ করেছেন। নুমান এমন এক সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে সময়টা ছিল আমার মতো স্বল্প মেধার একজন ছাপোশা সংবাদকর্মীর জীবনের সম্ভবত একটি উজ্জল সময়। মফস্বলের একটি থানা শহরে প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা ডাইজেস্ট পাবার জন্য এক সময় পোস্ট অফিসের ডাক হরকরার অপেক্ষায় থাকতাম। তার ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত নতুন ঢাকা ডাইজেস্টের শুরুতেই নুমানের সাথে আমিও যুক্ত ছিলাম। বিখ্যাত সাংবাদিক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু ছিলেন এই পত্রিকার সম্পাদক ও প্রধান উদ্যোক্তা। পত্রিকাটির প্রকাশনার শুরু থেকে এর সাথে নানা ভাবে লেখক ও উপদেষ্টা হিসাবে যুক্ত ছিলেন কবি আল মাহমুদ। আসলে এইকিংবদন্তী কবি পত্রিকাটির সাথে লেখালেখি ও উপদেশ দেবার ব্যাপারে যুক্ত হওয়ায় পুরণো ধারাবাহিকতায় নতুনভাবে প্রকাশিত পত্রিকাটির মর্যাদা অনেক উপরে উঠেছিল। পত্রিকাটির সাথে আমি যুক্ত ছিলাম সহযোগি সম্পাদক হিসাবে। পরে সম্পাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু রয়টার ফেলোশীপ নিয়ে এক বছরের জন্য আমেরিকায় গেলে কিছু সময়ের জন্য নির্বাহি সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করি। পরে অবশ্য দৈনিক পত্রিকার পাশাপাশি যুক্ত হয়ে পড়ি পাক্ষিক পালাবদল ও অঙ্গিকার ডাইজেস্ট নামে দুটি পত্রিকার সাথে।কবি আল মাহমুদের কবিতার সাথে আমার পরিচয় স্কুল জীবন থেকে। তবে কবিতার গভীর রস আস্বাদনের ক্ষমতা আমার তখনো ছিলো না। এখনো তার কবিতার সব রহস্য শব্দ ও ভাব নিয়ে খেলাধুলা আমি ধরতে পারি এমনটি কোনভাবেই বলা যাবে না। আর স্কুল জীবনে আমার কাছে কবি আল মাহমুদ কাংক্ষিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন দৈনিক গণকণ্ঠের সম্পাদক হিসাবে। সেই ৭৩-৭৪ সালে প্রতিদিন তার সম্পাদিত গণকণ্ঠ পড়ার জন্য প্রহর গোনতাম। এই আকর্ষণের বেশ খানিকটা তৈরি হয় পারিবারিক পরিমন্ডল থেকে। গণকণ্ঠের থানা সংবাদদাতা বড় ভাই মাহফুজ খলিলীর (এখন কানাডা প্রবাসি চার্টার্ড একাউন্টেন্ট) কাছে নিয়মিত পত্রিকাটি আসতো। বড় ভাই এবং তার বন্ধুরা সবাই ছিলেন জাসদের রাজনীতির সাথে যুক্ত। মেজো ভাই মামুন খলিলীর যোগাযোগ ও সম্পর্ক ছিল একই ঘারানায়। এর প্রভাব কিশোর মানসে হয়তো স্থান করে নিয়ে থাকতে পারে। ভাইয়ের বন্ধুরা মাঝে মধ্যে আল মাহমুদ নিয়েও নানা আলোচনা করতেন। সে আলোচনার দূরবর্তী শ্রোতা হিসাবে আমার কাছে একটি রেডিক্যাল পত্রিকার সম্পাদক আল মাহমুদের ব্যক্তিত্বই অনেক বেশি আকর্ষণের বিষয় বড় মনে হতো। অগ্রজের বন্ধুদের মধ্যে সাধন মিত্র নামে একজন ছিলেন যিনি সম্পাদক আল মাহমুদের চাইতেও কবি আল মাহমুদের অনেক বেশি অনুরক্ত ছিলেন। একদিন কবির একটি কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। এখনো সেই কবিতার কয়েকটি চরণ নানাভাবে তরঙ্গ তুলে মানসপটে। কবিতাটির নাম ছিল সম্ভবত মোরগ । আল মাহমুদ ছিলেন ১৯৭১ সালের প্রত্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে, যে স্বল্প সংখ্যক কবি রণাঙ্গণের প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, আল মাহমুদ ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৭১ সালে তিনি শরণার্থী হয়ে কলকাতায় যান। সেখানেই তিনি যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। তারপর একদিন কবি তার প্রিয় কলমকে ফেলে হাতে তুলে নেন রাইফেল। দেশে ফিরে তিনি মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার আশায় রণাঙ্গণের সশস্ত্রযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তিনি বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করেন ঢাকায়। মুক্তিযুদ্ধের আগে আল মাহমুদ ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের মফস্বল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদক। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে দৈনিক গণকন্ঠ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব হাতে তুলে নেন তিনি। ৭১’র পরবর্তী বাংলাদেশের অস্থির রাজনীতি, দুর্ভিক্ষ, সর্বহারা আন্দোলন ও রক্ষীবাহিনী ইত্যাকার পরিস্থিতিতে দেশ যখন বিপর্যস্ত তখন গণকন্ঠের নিঃশঙ্ক সাংবাদিকতা এ দেশের পাঠক সমাজের কাছে ব্যাপকভাবে সমর্থিত হয়। বিশেষ করে আল মাহমুদের সংবাদ প্রকাশের স্টাইল ও সাহসী সম্পাদকীয় দেশবাসীর হৃদয় স্পর্শ করে। বিপরীত দিকে পত্রিকাটি পরিণত হয় শাসক গোষ্ঠীর চক্ষুশূলে। এর ফলে ১৯৭৩ সালে তিনি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। তাঁর আটকাবস্থায় সরকার দৈনিকটিও বন্ধ করে দেয়। ১৯৭৫ এ তিনি মুক্তি পান। এর মধ্যে রাজনৈতিক দৃশ্যপটে আমূল পরিবর্তন আসে। সম্পাদক আল মাহমুদের জীবিকা হয় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সাথে যুক্ত। সাংবাদিকতার প্রত্যক্ষ পেশা কলামিস্টের অপ্রত্যক্ষ নেশায় রূপ নেয়। আল মাহমুদের সাহিত্য চর্চা হয়ে উঠে অধিকতর বহুমুখি। ষাটের দশক পর্যন্ত মার্কসবাদ বা প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর মুক্তিকামী বাম দর্শন এই অঞ্চলের আদর্শ চর্চার জগত দাপটের সাথে শাসন করছিলো। এতে প্রভাবিত হয়েছিলেন আল মাহমুদও। কিন্তু তার জীবনের যে ঐতিহ্যের শেকড় এবং গ্রামের প্রতি গভীর অনুরক্তি, তা কখনো কবিতাকে শ্লোগান সর্বস্ব করেনি। আল মাহমুদের এসময়ের কবিতায় অন্যায্য শাসন শোসনের অবসানের আকাঙ্খা রয়েছে, আমূল পরিবর্তনের ডাকও রয়েছে। কিন্তু সব কিছুকে অস্বীকার করে নাস্তিক্যবাদেও ঢঙ্কা উড়ানোর প্রয়াস তার কবিতায় দেখা যায় নি। এক পর্যায়ে বাম ধ্যান ধারণা ও দর্শনই মানুষের মুক্তির একমাত্র উপায় হতে পারে, এমন বিশ্বাসে তার চিড় ধরে। আর কবির ভাবনায়, জীবনাচরণে মহাশক্তিকে আবিষ্কার এবং অনুভবের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। তিনি অধ্যয়ন করতে শুরু করেন তুলনামূলক ধর্মতত্ব। কোরআন, বাইবেল, রাসূলগণের জীবনী অধ্যয়ন করেন তিনি। এটি ব্যক্তি আল মাহমুদের জীবনে আনে তাৎপর্যপূর্ন পরিবর্তন। ব্যক্তি আল মাহমুদের বিশ্বাস নিয়ে নানা সমালোচনাও করা হয়। এসব সমালোচনাকে তিনি খুব একটা পরোয়া করতেন এমন মনে হয়নি। আল মাহমুদের এই পরিবর্তনে নিয়ামক হয়ে উঠে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক দৃশ্যপটের পরিবর্তনও। এসময় জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব ঘটে বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে। জিয়ার আদর্শ স্বপ্ন ও ভাবনাকে তিনি বেশ গভীর এবং খানিকটা অন্তরঙ্গভাবে উপলব্ধি করার সুযোগ পান। জিয়া নিজের শক্তি বলে মাথা উঁচু করে সম্মানের সাথে টিকে থাকা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন সেই স্বপ্নই ছিল অন্যভাবে কবি আল মাহমুদের। দু’জনের লক্ষের এই অভিন্নতা দুটি ভিন্ন ক্ষেত্রে সৈনিকে পরিণত করে উভয়কে। একজন মাটির গভীরের রস আস্বাদনকারী স্বপ্নচারি কবি লেখক সাংবাদিক, অন্যজন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়ে জীবনের ঝুকি নিয়ে লড়াই করা এবং দু:সময়ে জাতির কান্ডারি হিসাবে আবির্ভুত রাষ্ট্রনায়ক। পরিবর্তনের এই সময়টাতেই কবি আল মাহমুদের ব্যক্তি পেশা এবং লেখক জীবনের ঘনিষ্ট অনুরক্ত হয়ে কিছু সময় পার করার সুযোগ ঘটে। কবি তখন শিল্পকলা একাডেমির উপ পরিচালক এবং পরে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সুহৃদ আবু জাফর মোহাম্মদ ওবায়েদ উল্লাহ ও বুলবুল সারওয়ারের সাথে তার অফিসে কিছু সময় কাটানো তখন দৈনন্দিন রুটিনের অংশ হয়ে উঠে।
রিপোর্টার হিসাবে সাংবাদিকতার প্রাত্যহিক কাজের বাইরে বড় সময়টাতে কখনো আল মাহমুদ কখনো সৈয়দ আলী আহসান আবার মাঝে মধ্যে আবদুর মান্নান সৈয়দ অথবা ফখরুজ্জামান চৌধুরির অফিসে যাতায়াত হতো। এসব কর্মকান্ডের কেন্দ্রে ছিলেন ওবায়েদ ভাই, যাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক করতে না পারার কারণে আনিসুজ্জামান স্যার ( বাংলাদেশে লোকপ্রশাসন পাঠের অন্যতম স্থপতি, এখন মরহুম) দু:খ করতেন, আর সাথে ছিলেন বুলবুল সারওয়ার যিনি এখন একটি মেডিক্যাল কলেজের প্রথিতযশা অধ্যাপক, একই সাথে ডাক্তার ও ডক্টর। কিন্তু ডাক্তারি বিদ্যার চেয়ে নানামুখি সাহিত্য চর্চা ছিল তার ছাত্র জীবন থেকেই নিত্য কাজ। আমরা এই তিনজন মিলে বের করি একটি সাহিত্য পত্রিকা ‘অঙ্গীকার’। এর অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন আল মাহমুদ। অঙ্গীকারের কয়েকটি সংখ্যা নিয়ে বেশ আলোচনাও হয়েছিলো। কিন্তু সাহিত্য পত্রিকা ঠেকসই হবার জন্য আবেগের বাইরে যে আর্থিক ভিত্তি ও পরিণামদর্শী পরিকল্পনা থাকতে হয় সেটির অভাবে এটি স্বল্প আয়ুর স্মৃতিতে পরিণত হয়। তখন সাহিত্য পত্রিকার পাশাপাশি চিন্তা আসে সাহিত্যাশ্রয়ী সাময়িকী প্রকাশের। জ্যেষ্ঠ বন্ধু প্রতীম ব্যবসায়ী আবদুস সালামের (এখন মরহুম) বিশেষ আগ্রহে এসময় প্রকাশ হয় পাক্ষিক পালাবদল । একই সাথে ওবায়েদ ভাইয়ের বিশেষ উদ্যোগে জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক কাওসার হোসেইনকে (পরে সড়ক দুর্ঘটনায় পরলোকগত) ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক করে বের হয় অঙ্গীকার ডাইজেস্ট। দুটি পত্রিকারই উপদেষ্টা সম্পাদক হন আল মাহমুদ।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে একটি র্যাডিকেল বিরোধি দলীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদনার ঝড়ো পেশা থেকে শিল্পকলার নীতি নির্ধারক পর্যায়ের কর্মকতা হবার স্বস্তিকর কর্মজীবন আল মাহমুদের লেখালেখিতে এক ধরনের প্রভাব ফেলে। এ সময় বাড়তি আয় এবং সাংবাদিকতা জীবনের ধারাবাহিকতায় তিনি নামে বেনামে সংবাদপত্রে কলাম লিখতে থাকেন। কাব্য চর্চাও চলে সমানভাবে। সেসাথে ভিন্নধর্মী আত্বজীবনী, গল্পগ্রন্থ, উপন্যাস- এসব আলোচিত লেখা সৃষ্টি হয় এ সময়টাতে। একটি দৈনিকে ধারাবহিকভাবে প্রকাশ হয় আত্বজীবনীমূলক উপন্যাস ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’। অগ্রজ সাংবাদিক ও শিশু সাহিত্যক সাজ্জাদ হোসাইন খানের সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা ছিল কবির এই বই লেখার ক্ষেত্রে। ( কবি বইটি উৎসর্গ করেছিলেন সাজ্জাদ ভাই, ওবায়েদ ভাই এবং আমাকে)। এরপর আমরা নতুন ঢাকা ডাইজেস্টে প্রকাশ করি বহুল আলোচিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস ‘উপমহাদেশ’। কবির পরবর্তী জীবন ভিত্তিক গ্রন্থ বা উপন্যাস লেখার জন্যও আমরা উৎসাহিত করি, বলা যায় কবিকে নানাভাবে উত্তেজিত করার চেষ্টা করি। মাহমুদ ভাই কোন সময় আমাদের না বলতেন না। সব সময় আস্বস্ত করেছেন লিখবেন বলে। অবশেষে সত্যি সত্যি তিনি রাজি হলেন। কিন্তু পালাবদলে প্রথমে শুরু করলেন ব্যতিক্রমধর্মী উপন্যাস ‘ডাহুকি’। কবিরা যখন কথা সাহিত্য লিখেন তখন কোন কোন সময় পড়ে মনে হয় না তিনি একজন কবি। আবার অনেকের গল্প উপন্যাসের একেকটি অংশ হয়ে উঠে কবিতা। ‘দিনযাপন’ এর মতো ‘ডাহুকি’ পড়লেও কাউকে বলতে হবে না এই উপন্যাস লিখেছেন একজন খ্যাতিমান কবি। ডাহুকি শেষ হবার পর আরেকটি বড় ক্যানভাসের উপন্যাস লেখার জন্য প্ররোচিত করতে থাকি কবিকে। শেষ পর্যন্ত তিনি কাবিলের বোন নামের এই উপন্যাস শুরু এবং শেষ করেন। এর পর শুরু করেন নতুন উপন্যাস ‘যে পারো ভুলিয়ে দাও’। অঙ্গীকারে লিখেন আরেকটি উপন্যাস ‘মরু মুষিকের উপত্যকা’। পালাবদলের অফিস তখন ফকিরাপুলে। আনুষ্ঠানিক অনানুষ্ঠানিকভাবে এর সাথে সম্পাদক আবদুস সালাম ছাড়াও ইসলামী ব্যাংকের দীর্ঘ সময়ের সাবেক চেয়ারম্যান কমোডর অব. আতাউর রহমান, বাংলাদেশ টাইমস ও টেলিগ্রাফের সিনিয়র সাংবাদিক ফিরোজ আহমদ, ফটো সাংবাদিক আবদুর রাজ্জাক, বন্ধু সাংবাদিক হুমায়ুন সাদেক চৌধুরি, অনুজ প্রতিম ডা. আবু হেনা আবিদ জাফর, এখন অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসি চাটার্ড একাউন্টেন্ড এস এস মিলন ইসলাম, একসময়ের ক্রীড়া সাংবাদিক এখন পোশাক শিল্পের সাথে জড়িত মুহাম্মদ ইকরাম আর এখন ব্যাংকার হিসেবে থিতু হওয়া রফিকুল ইসলাম আজাদ যুক্ত ছিলেন।
পত্রিকার নিয়মিত মাসিক সভায় যোগ দিতেন শিক্ষাবিদ পন্ডিত কবি জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর এমাজুদ্দিন আহমদ, কথাশিল্পী অনুবাদক ফখরুজ্জামান চৌধুরি, কবি আব্দুল মান্নান সৈয়দ, কথাশিল্পী আবুল খায়ের মুসলেহ উদ্দীন, শিক্ষাবিদ ড. আশরাফ সিদ্দিকী, নাট্যকার আসকার ইবনে শাইখ, গীতিকার অধ্যাপক আবু জাফর, সাহিত্যিক জুবাইদা গুলশান আরা, শাহাবুৃদ্দিন নাগরি, ড. তারেক শাসমুর রেহমান সহ আরো অনেকে। আল মাহমুদ থাকতেন এসব অনুষ্ঠানের মধ্যমণি । ফকিরাপুলের অপরিসর পালাবদল অফিসের একটি কক্ষ ছিল আল মাহমুদের লেখালেখির জন্য সংরক্ষিত। এখানে বসেই তিনি লিখেছেন অনন্য সাধারণ উপন্যাস ‘ডাহুকি’। বাংলা কথা সাহিত্যে বহু বছর ধরে আলোচনা হবার মতো দীর্ঘ উপন্যাস ‘কাবিলের বোন’ কবি লিখেছেন এখানে বসেই। পালাবদল এবং অঙ্গিকার ডাইজেস্টের এই তিন চার বছর সম্ভবত ছিল আল মাহমুদের লেখক জীবনের সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীল সময়। তিনি এ সময়ে বিভিন্ন ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত উপন্যাসিকা এবং বখতিয়ারের ঘোড়াসহ কয়েকটি কাব্যগ্রস্থের অধিকাংশ কবিতা লিখেছেন। তার লেখা উপন্যাস ‘উপমহাদেশ’ ছিল প্রত্যক্ষ ও বিস্মৃত প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধকে ধরার প্রয়াস। অন্যদিকে ‘কাবিলের বোন’ শেষ পর্যায়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে উপনীত হলেও এর প্রধান অনুষজ্ঞ মুক্তযুদ্ধ পূর্ববর্তী ও চলাকালীন বাংলাদেশে অবস্থারত বিহারীদের অস্তিত্ব বিপর্যয়ের কাহিনী। সন্দেহ নেই ‘কাবিলের বোন’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক অনালোচিত অধ্যায়ের শব্দরূপ। মুক্তিযুদ্ধের আগের পটভূমি এবং শেষের দিকটা এসেছে ‘কাবিলের বোন’ এ। মাঝখানটা জুড়ে রয়েছে ‘উপমহাদেশ’। এই দু’ উপন্যাস মিলে মুক্তিযুদ্ধের এক সম্পূর্ণ কাহিনী।
কবি আত্বজৈবনিক উপন্যাস ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ যখন লিখেন অনেকের মধ্যে প্রশ্ন ছিল এটি কি আত্বজীবনী নাকি উপন্যাস। কবি এখানে নিজের বেড়ে উঠার কাহিনী বর্ণনা করেছেন। কিন্তু ঢং ছিল না নিজ জীবনের গতানুগতিক বর্ণনা। একজন কবিকে বলেছিলেন, এই যে বইটা আপনি লিখলেন এর তো ২০ ভাগই ভুয়া। জবাবে কবি বলেছিলেন, তার মানে এখানকার ৮০ ভাগ খাটি! এটা কি কম নয়?
যেভাবে বেড়ে উঠি’র পর কবির জীবনের পরবর্তী অধ্যায় নিয়ে লিখতে আমরা প্রায়ই উত্তক্ত করতাম। এক সময় রাজিও হলেন। ঢাকা ডাইজেস্টে ধারাবাহিকভাবে লেখা শুরু করলেন উপমহাদেশ। যেভাবে বেড়ে উঠি’র মতো উত্তম পুরুষে লেখা হয়নি এটি। ঢং গতানুগতিক উপন্যাসের। কিন্তু উপন্যাসের নায়ক যে কবি নিজেই সেই আন্দাজ আমরা করতাম। কবি কখনো তা অস্বীকার করেননি। বরং কবি এই দুটি উপন্যাস প্রসঙ্গে বলেছিলেন, উপমহাদেশ উপন্যাসের কথা তুমি বললে এটা একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফসল। সত্য ঘটনা অবলম্বনে। উপমহাদেশ খুব হেলায়-ফেলায় লিখেছিলাম। পরে এটার গুরুত্ব বুঝলাম। কাবিলের বোনও তাই। কাবিলের সাথে রোকসানার যে প্রেমপর্ব এবং সে অধ্যায়ের জটিলতা উপন্যাসটির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কিন্তু সেসব কিছুকে ছাপিয়ে ‘কাবিলের বোন’ উপন্যাসে যে প্রসঙ্গটি আরও প্রাসঙ্গিক হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে তা হলো মুক্তিযুদ্ধ প্রাক্কালে বাঙালি-বিহারী দ্বন্দ্ব এবং সে দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের অবস্থানরত বিহারী জনগণের নিরাপত্তাহীনতার মর্মন্তুদ চিত্র। জাতিগতভাবে ‘মাইনরিটি’ হওয়ায় একটি পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের জীবন কীভাবে বদলে যায় উপন্যাসটিতে আল মাহমুদ তা গভীর মমতায় আঁকতে সমর্থ হয়েছেন। আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যে কত বড় একজন ব্যক্তি তা যারা তার গভীর সান্নিধ্যে এসেছেন তারা বুঝতে পারবেন। এক অদ্ভুত সরলতা তার জীবন যাপনে। এতো বড় কবি নি:সঙ্কোচে মোটর সাইকেলের পেছনে বসে গেছেন কোন অনুষ্ঠানে, অথবা ফিরেছেন বাসায়। সংসারের পুরো ভার স্ত্রী নাদিরা মাহমুদের উপর দিয়ে তিনি ছিলেন নিশ্চিন্ত। নিজের আয়ের পুরোটো তিনি তুলে দিতেন আর সংসারে কোথায় কি সব করতেন দীর্ঘকায় সহধর্মিনী নাদিরা। তিন ছেলে ও তিন মেয়ের পড়াশুনা আর বিয়ে এবং তাদের সংসারের সবকিছু সামাল দিতেন তিনি। বড় সংসারের চাহিদার কোন শেষ নেই। কবির বড় মেয়ের নাম আতিয়া। ফরিদী নুমানের ফেইসবুক পোস্ট এবং অন্য এক জনের মন্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে গিন্নির বোন আর কবির সাহিত্যকর্মের একনিস্ট অনুরাগি ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপিকা আতিয়া ইসলাম। কবির সরল জীবনকে মূল্যায়নে অনেক সময় বিপত্তি ঘটে। তাতে আতিয়া ও তার বান্ধবি কিছুটা বেদনাহত হয়েছেন। কবির স্ত্রীর বিদায়ের পর কবি আল মাহমুদ খানিকটা অসহায় হয়ে পড়েন। তার সংসারে আগের সেই শৃঙ্খলা থাকেনি। গুলশানে কবির একটি ফ্লাট ছিল। ছেলেদের ভাগ বাটোয়ারাতে সেটি বিক্রি হয়ে গেছে। কবি থাকেন বড় ছেলের সাথে তার কেনা মগবাজারের ছোট একটি ফ্লাটে। দৃষ্টিহীন শীর্ণকায় কবিকে দেখে এখন অনেকেই হয়তো চিনতে পারবেন না। তবুও লিখে চলেছেন কবিতা গল্প উপন্যাস । নিজের পড়ার বা লেখার সাধ্য নেই। কবি বলেন আর কেউ একজনকে লিখে নিতে হয় । তবে লেখা বা কবিতার পাঠকরা ধরতে পারবেন না এই হলো আল মাহমুদের কথা থেকে অনুলিখন করে নেয়া। রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের সম্মৃদ্ধ ব্যক্তিরা এই গুণি ব্যক্তির খবর রাখার খুব বেশি সময় পান বলে মনে হয় না। গুণগ্রাহিরা আসেন। গল্প করেন, কবিকে সান্নিধ্য দেন। নি:শ্বঙ্গতার মধ্যেও আল মাহমুদ পরম করুণাময়ের দিকে ফিরে আসার প্রতি রয়েছেন অবিচল।
কতটা অবিচল সেটি তার একটি অখ্যাত সাক্ষাতকারের একটি অংশ পড়লে বুঝা যাবে। সেই সাক্ষাতকারে কবির বলা কথাগুলো এখনো কানে বাজে। তিনি বলেছিলেন, “তুমি যদি অভিজ্ঞতার কথাই বলো তাহলে তা মিশ্র অভিজ্ঞতা। সাহিত্য কখনো কাউকে খালি হাতে ফেরায় না। আমি হয়তো অনেক কিছু পেয়েছি, যা পাবো ভাবিনি। আলহামদুলিল্লাহ। জীবনের কাছে আমি তৃপ্ত। পূর্ণতা না থাকলেও শূন্যতা নেই। অপ্রাপ্তিও হয়তো নেই। আমি মুগ্ধ, আনন্দিত। তবে আমি এখনো ভাবি জীবন নিয়ে, জগৎ নিয়ে। ভাবি, কোথা থেকে এলাম, কোথায় যাবো। আই উইস টু বি এ পয়েট। অ্যাই অ্যাম এ থিংকার- নট আদারস। আমি চিন্তা করি। চিন্তার ভেতর দিয়েই আমি আল মাহমুদ। লিখতে পেরেছি। আরো অবশ্য লিখতে ইচ্ছে হয় অনেক- অনেক কিছু। কিন্তু এত শক্তি-সামর্থ্য কিংবা আয়ু কোথায় আমার? আল্লাহ চিন্তাশীলদের পছন্দ করেন- তাই চিন্তা করতে ভালো লাগে। আমার এই একাকী স্বেচ্ছা নির্বাসিত জীবনে শুয়ে-বসে, বিশ্রাম নিয়ে দিন কাটাচ্ছি বর্তমানে। ইচ্ছে হলে লিখি, না হয় অলসতা করি। পেছন অতীতের কথা চিন্তা করি। অনেক মুখ মনে পড়ে। ফিরে যাই পেছনে। ভাবতে ভাবতে ফিরে যাই কৈশোরে। মায়ের আঁচল ধরে যেন অলক্ষ্যে বলে উঠি, বাড়ি যাব। মাঝে মাঝে ভাবি আমার বাড়ি কই, আমার বাড়ি কি কখনো ছিল। জীবনে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি, তা যেন ফুরোবার নয়। আমি কৃতজ্ঞ এই মা, মাটি আর মানুষের কাছে। আমি আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকি। আর এরই মধ্যে তোমরা একদিন শুনবে ‘আল মাহমুদ আর নেই’।” ( সিনিয়র সাংবাদিক মাসুমুর রহমান খলিলীর ফেসবুক ওয়াল থেকে নেয়া)