রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৭:২৫ অপরাহ্ন

ডি-৮ : ২৫ বছরেও কেন সফল নয় ৮ মুসলিম দেশের এ সংগঠন

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বুধবার, ২৭ জুলাই, ২০২২

তিনটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেষ মুহূর্তে বাংলাদেশ সফর বাতিল করায় ঢাকায় ডি-৮ মন্ত্রী পর্যায়ের একটি বৈঠক শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হচ্ছে হাইব্রিড পদ্ধতিতে। অর্থাৎ কিছু দেশের মন্ত্রী এতে যোগ দেবেন সরাসরি, তিনটি দেশের মন্ত্রীরা যোগ দেবেন অনলাইনে। গতকাল বুধবার সকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় এই বৈঠক উদ্বোধন করেছেন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত থেকে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার কারণে এই হাইব্রিড বৈঠকের আয়োজন। আগে আসার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে সফর বাতিল করেন ইরান, পাকিস্তান ও তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের প্রতিনিধিরা। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খার যদি এই সফরে আসতেন তাহলে সেটা হতো বহু বছর পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের কোনো শীর্ষস্থানীয় নেতার প্রথম বাংলাদেশ সফর।
১৯৯৭ সালের জুন মাসে তুরস্কের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজমুদ্দিন এরবাকান ডি-৮ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ডি-৮ অর্গানাইজেশন ফর ইকনোমিক কো-অপারেশনের সদস্য দেশ বাংলাদেশ, তুরস্ক, ইরান, মিশর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও নাইজেরিয়ার মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি, বিশ্বের বাজারে তাদের অবস্থান উন্নত করা ছিল এই জোট গঠনের মূল উদ্দেশ্যে। কিন্তু ২৫ বছর পরে এসে দৃশ্যত এই জোটের কোনো ধরনের অর্জন দেখা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ে কাজ করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলছেন, একদম শুরুতে এই জোট এক ধরনের রাজনৈতিক বার্তা দিতে চেয়েছে। কিন্তু যে ধারণার ওপর ভিত্তি করে এই জোট তৈরি হয়েছে তার বাস্তবায়নে পরে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। পরের দিকে কোনো নেতা এটিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে জোরালো ভূমিকা পালন করেনি। তার ভাষায়, ‘অর্থনৈতিক সহযোগিতা গভীর করার জন্য একে অপরকে ট্যারিফ সুবিধা দেয়া, নিজেদের মধ্যে বিনিয়োগ বাড়ানো, রিজিওনাল গ্রুপিং করা যার মাধ্যমে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতো নিজেদের মধ্যে অগ্রাধিকারমূলক বাজার ব্যবস্থা তৈরি করা এসব কিছুই করা হয়নি। সদস্য দেশগুলোর মধ্যে পণ্য পরিবহন ও মানুষজনের যাতায়াত সহজ করা হয়নি। দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যের ভলিউম বাড়ানো, কোনো ধরনের উদ্যমী উদ্যোগ কোনো দেশ বা কোনো নেতার পক্ষ থেকে নিতে দেখা যায়নি।’
ডি-৮ সদস্য দেশগুলো প্রতিটি অন্য আরো জোটের সদস্য। প্রতিটি দেশই অন্য আঞ্চলিক চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী। যেমন বাংলাদেশ রয়েছে বিমসটেকে। অন্যদিকে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া আসিয়ানের সদস্য। ইরান ও তুরস্কের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক চুক্তি রয়েছে। আবার তুরস্ক চায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হতে। ইইউ-এর সাথে তাদের রয়েছে বাণিজ্যিক চুক্তি।
মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যে আঞ্চলিক চুক্তি বা জোট বেশি স্বার্থ সংরক্ষণ করে সেটি এক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ডি-৮-এর মাধ্যমে এর সদস্য দেশগুলোর অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণ সেভাবে হয়নি তাই এই জোটকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে উদ্যোগ দেখা যায়নি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান বলেন, যে দেশগুলো এই জোটের সদস্য ভৌগোলিকভাবে তাদের অবস্থান অনেক বিচ্ছিন্ন এবং তাদের একক কোনো স্বার্থ নেই বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বার্থের সংঘর্ষ রয়েছে। ডি-৮-এর সদস্য দেশগুলোর মধ্যে নানা বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যও রয়েছে। যেমন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের স্বার্থে বড় ধরনের দূরত্ব অনেক পুরনো ব্যাপার। দুটি দেশের মধ্যে বিবাদের বহিঃপ্রকাশ নিয়মিত দেখা যায়। সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক অবস্থানেও অনেক পার্থক্য রয়েছে।
অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান বলেন, ‘এর সদস্য দেশগুলোর কয়েকটি রয়েছে যাদের প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ। যে কারণে বিশ্বের অন্য বৃহৎ শক্তিদের সাথেই তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক হয়েছে। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সাথেই তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বেশি গড়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে জোটের সদস্যদের স্বার্থ তারা দেখবে না সেটাই স্বাভাবিক।’
তিনি বলেন, ‘ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে একক স্বার্থ তৈরি করা মুশকিল। ডি-এইটের দুটি দেশ মিশর ও নাইজেরিয়ার অবস্থান আফ্রিকায়। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া রয়েছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে।’ বাংলাদেশ ও পাকিস্তান রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়। অন্যদিকে ইউরোপ ও এশিয়ার কিছুটা মিলিয়ে তুরস্ক। ইরান রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। প্রতিটি দেশের আঞ্চলিক রাজনীতি রয়েছে। বিশ্বব্যাপী কিছু রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে টানাপোড়েন রয়েছে এবং তাতে কোন পক্ষে কার অবস্থান সেটিও এই জোটের গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছে।
অধ্যাপক শাহীদুজ্জামান বলেন, ‘ধরুন ইরানের ওপরে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অন্যদিকে ইরানের সাথে রাশিয়ার রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। আবার তুরস্ক রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক রেখেও নিজেকে একটা ডাইনামিক অবস্থানে নিয়ে এসেছে অনেক দিন ধরে। তুরস্ক একটি নেটো সদস্য দেশ।’ তিনি আরো বলেন, ‘কৃষ্ণ সাগরের নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই রয়েছে তুরস্ক। সেকারণে নেটোভুক্ত দেশগুলোর পক্ষে তুরস্ককে অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। তুরস্কের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক, ইরানকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ যেভাবে নেয়, ডি-৮-এর অন্য সদস্য দেশগুলোর পক্ষে কতটা সম্ভব এসব অগ্রাহ্য করে এই দেশগুলোর সাথে একটা জোটে থাকা এবং সেটিকে সফল করতে উদ্যোগ নেয়া?’
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও কিছু খাদ্যের সরবরাহ সঙ্কট দেখা দিয়েছে সেটি নিয়ে এবারের সম্মেলনে বেশি আলোচনা হবে বলে ধারণা আছে।
কিন্তু মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ’আগে থেকে এই জোটের যদি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা তৈরি থাকতো তাহলে এখন জ্বালানি তেল ও খাদ্যের সঙ্কটের ক্ষেত্রে সহযোগিতায় তা কাজে লাগানো যেত। কিন্তু এ রকম প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এই জোটে এতদিনেও তৈরি হয়নি।’
অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান বলেন, ’এই সম্মেলনটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের হওয়ার কথা। এর গুরুত্ব কতটা কম তা বোঝা যায় যখন দেখা যায় যে এই সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বদলে কয়েকটি দেশ সংসদ সদস্য, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিশেষ দূত, উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাঠিয়েছে। পূর্ণ মন্ত্রী নেই একজনও। দেশগুলো নিজেরাই যদি জোটটিকে গুরুত্ব দিত তাহলে তাদের উপস্থিতি আরো উচ্চ পর্যায়ের হতো।’ কিন্তু তিনি মনে করেন তারপরেও তুরস্ক ও ইরান যদি চায় তাহলে এই জোটের কর্মকা-ে এক ধরনের সংস্কার হতে পারে। তিনি বলেন, তুরস্ক যেহেতু ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য পতে পারেনি। তাই দেশটি অন্য জোটের মাধ্যমে সক্রিয় অবস্থানে থাকতে চায়। তিনি বলেন, ‘অন্যদিকে ইরানের অর্থনৈতিক সামর্থ্য রয়েছে, প্রচুর প্রাকৃতিক গ্যাস রয়েছে, কিন্তু দেশটির ওপর নানা রকম নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাই ইরান হয়তো চাইবে এই সম্মেলনে কার্যকর একটা ভূমিকা নিতে। ডি-৮-এর এই সম্মেলন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রেও কাজে আসতে পারে।’ সূত্র : বিবিসি




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com