গত ৩১ মাসে শুধু দেশের বিভিন্ন রেলক্রসিংয়ে ১১৬টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২১৯ জন। এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে গেটম্যান না থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ১১ জন নিহত হওয়ার পর গত শনিবার এ তথ্য প্রকাশ করে সংগঠনটি। এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে রেলক্রসিংয়ে প্রযুক্তির ব্যবহারের পাশাপাশি জনবল বৃদ্ধির তাগিদ দিয়েছে সংগঠনটি। দেশে বর্তমানে রেলপথ রয়েছে ২ হাজার ৯৫৯ কিলোমিটার। এ রেলপথে ক্রসিং রয়েছে ২ হাজার ৮৫৬টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৪৯৫টি রেলক্রসিং বৈধ ও ১ হাজার ৩৬১টি অবৈধ। ৯৬১টি রেলক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান নেই। সে হিসেবে দেশে ৮২ শতাংশ রেলক্রসিংই অনিরাপদ বলে দাবি করেছে দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি এ সংগঠন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২২ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত সারা দেশের রেলক্রসিংগুলোয় ১১৬টি দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২১৯ জন। এর মধ্যে ২০২০ সালে ৩৮টি রেলক্রসিং দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬৯ জন। ২০২১ সালে দুর্ঘটনা ও মৃতের সংখ্যা দুইই বেড়ে যায়। ওই বছর ৪৩টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৭৬ জন ও ২০২২ সালের ২৯ জুলাই পর্যন্ত ৩৫টি দুর্ঘটনায় ৭৪ জন নিহত হয়েছেন।
গত শুক্রবার বেলা দেড়টার দিকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী ট্রেন পর্যটকবাহী একটি মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দিয়ে এক কিলোমিটার দূরে নিয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান ১১ জন। আহত হয়েছেন ছয়জন। হতাহত ব্যক্তিরা চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার আমানবাজারের পূর্ব খন্দকিয়া গ্রামের বাসিন্দা। নিহত ১১ জনের মধ্যে গাড়িচালক ও তার সহকারী ছাড়া অন্যরা স্থানীয় একটি কোচিং সেন্টারের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। এদিন সকালে তারা মাইক্রোবাসে মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝরনায় বেড়াতে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। প্রত্যক্ষদর্শী ও ট্রেনের যাত্রীদের অভিযোগ, দুর্ঘটনাস্থলে গেটম্যান না থাকায় কোনো সিগন্যাল বা প্রতিবন্ধক ছিল না। এ ঘটনায় গেটম্যান সাদ্দাম হোসেনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে মামলাও করেছে পুলিশ। সাদ্দাম হোসেনকে এরই মধ্যে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ।
শুধু এ দুর্ঘটনাই নয়, চার বছর আগে চট্টগ্রামের মিরসরাইতেই ঘটেছিল এমন আরেকটি দুর্ঘটনা। ২০১৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর ভোরে বারইয়ারহাট রেলক্রসিং দিয়ে চট্টগ্রামগামী বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনটি আসছিল। তবে কোনো সংকেত ছিল না। কোনো প্রতিবন্ধক দ-ও ফেলা হয়নি। গেট খোলা পেয়ে রেললাইনে উঠে পড়ে একটি যাত্রীবাহী বাস। আর সে সময় ছুটে আসা ট্রেন বাসটিকে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে যায় প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় দুই বাসযাত্রীর। আহত হন আরো ২০ যাত্রী। স্থানীয় বাসিন্দারা সে সময় অভিযোগ করেন, গেটম্যান যদি ঠিক সময়ে প্রতিবন্ধক দ- ফেলতেন তাহলে এ দুর্ঘটনা ঘটত না।
রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে গেটম্যান না থাকাকে চিহ্নিত করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। তাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, বহু রেলক্রসিংয়ে গেটম্যান ও গেটবারের ব্যবস্থা না থাকা, বৈধ রেলক্রসিংয়ে গেটম্যানদের দায়িত্বে অবহেলা, গেটম্যান হিসেবে লোকবলের সংকট, যানবাহনের চালক এবং সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে অসচেতনতা ও অধৈর্য মানসিকতা, দুর্ঘটনায় দায়ীদের উপযুক্ত শাস্তি না হওয়া এবং রেলপথ ব্যবস্থাপনায় আইনের শাসনের অভাব রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা রোধে তিন দফা সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানান রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা কমাতে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রেলক্রসিংয়ে গেটম্যান নিয়োগ ও উপযুক্ত গেটবারের ব্যবস্থা করা, রেলক্রসিংয়ে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, রেলপথ ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিতসহ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা। আমরা আশা করছি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।’ অবশ্য রেল দুর্ঘটনার পেছনে কর্তৃপক্ষের সক্ষমতার ঘাটতিকেও বড় একটি কারণ হিসেবে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এ ধরনের দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে পারে রেল কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা এবং সে অনুযায়ী সক্ষমতা অর্জনের উদ্যোগ। পাশাপাশি উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার রেল দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন তারা।