জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়েছে উত্তরা লে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে। এ অ লে যোগাযোগ খাতে ডিজেলের চাহিদা ৬৪ শতাংশ। সরকারি ঘোষণায় গণ পরিবহনে ২২ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে করে যাত্রীদের পকেট থেকে বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে যাবে বলে যাত্রীদের অভিযোগ।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির দাবি, তেলের দামের কারণে ভাড়ার বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন রুটের ছোট, মাঝারি, বড় পরিবহনে দৈনিক ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় হবে। এক কিলোমিটার দূরত্বের জন্যে গাড়িতে উঠলেই বাড়তি ৪০ পয়সার পরিবর্তে ২-৩ টাকা পর্যন্ত বেশি দিতে ভাড়া দিতে হচ্ছে। এ অ লে পণ্যবাহী ট্রাক ভাড়াও বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। সংস্থাটির দাবি সড়কে চলাচলরত অনেক গাড়ির ফিটনেস নেই। সরকারকে নিয়মিত ট্যাক্স প্রদান করে না এমন গাড়ির সংখ্যাও অনেক। এরপরও প্রতিটি গাড়ি ভাড়া বাড়ার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে।
ঠাকুরগাঁ সদরের বাসিন্দা ফরিদুল হক বলেন, জ্বালানি তেলের সঙ্গে সবকিছুর সম্পর্ক জড়িত। তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সব পণ্যের দাম নতুন করে আবার বাড়বে। এ অ লের গরীব খেটে খাওয়া মানুষের বেঁচে থাকা আরও কঠিন হয়ে গেল। এখন সুস্থভাবে বেঁচে থাকার মতো কোনো উপায় দেখছি না।
গুড়ার একটি কারখানার কর্মকর্তা আমিনুল পারভেজ খান বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে নিশ্চিতভাবে নতুন করে বাড়বে সব ধরনের পণ্যের দাম। আমরা একদিকে পণ্য উৎপাদন করতে পারছি না, অন্যদিকে ক্রেতাদের জবাবদিহি করতে হচ্ছে। নওগাঁ বাড়ি বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফরিদা খাতুন বলেন, বাসে যেতে চাই, উপাই নেই। ৫০০ টাকার ভাড়া ৮০০ নিচ্ছে। তারা কোনো রেটের ধার ধারে না। তেলের দামের অজুহাতে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে। আমরা কিভাবে যাবো সেই চিন্তা করছেন না কেউ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতি কিলোমিটারে ৪০ পয়সা করে ভাড়া বৃদ্ধি করা হলেও মানছে না বাস মালিকরা। ভাড়া নিয়ে গত শনিবার থেকে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেটি রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে। সারাদেশে যোগাযোগের জন্য উত্তরা ল থেকে সবচেয়ে বেশি বাস-ট্রাক চলে। যার কারণে এখানে যাত্রীর চাপও সবচেয়ে বেশি। রোববার দিনভর বিভিন্ন জেলায় থেকে চলাচলকারী বাস-কোচের ভাড়া পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ৪০ পয়সার স্থলে এক থেকে দেড় টাকা পর্যন্ত বেশি ভাড়ার টাকা আদায় করা হচ্ছে। উত্তরের প গড় ও ঠাকুরগাঁও থেকে ঢাকার দূরত্ব ৫০০ কিলোমিটার। আগে এ রুটের ভাড়া ছিল ৯০০ থেকে সাড়ে ৯০০ টাকা। এখন একরাতে ভাড়া হয়ে গেছে ১৩০০ থেকে সাড়ে ১৩০০ টাকা। অর্থাৎ ২০০ টাকা স্থলে ভাড়া শতভাগ বাড়িয়ে ৪০০ টাকার বেশি নেওয়া হচ্ছে।
অন্য জেলা কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকা দূরত্ব কমবেশি ৪০০ কিলোমিটার। এখান থেকে প্রতিদিন শ্যামলী, হানিফ, অরিন, হক স্পেশাল, এনা গাড়ি চলাচল করে। এখানে ৭০০ টাকা ভাড়া রাতারাতি সাড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। একইভাবে জয়পুরহাট থেকে ঢাকার দূরত্ব ২৫০ কিলোমিটার। আগে এখানে ভাড়া ছিল সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। এখন সেখানে ভাড়া বেড়ে হয়েছে ৭২০-৭৫০ টাকা।
বগুড়াগামী এক যাত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের পকেট থেকে টাকাটা বেরিয়ে যাচ্ছে। বাসভাড়া, খাবার, কেনাকাটা কোনো কিছুতেই স্বস্তি নেই। এতো সমস্যার মধ্যে আমরা বাঁচি কী করে। শ্যামলী কোচের ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমাদের কিছু করার নেই। তেলের দাম বাড়লে বাসভাড়াও বাড়াতে হয়। আমরা তো আর ভর্তুকি দিয়ে বাস চালাতে পারি না। এদিকে তেলের দাম বাড়ায় গাড়ি চলাচল কমে গেছে রোজিনা ট্রাভেলসের। রোজিনার ম্যানেজার আলী আকবর বলেন, আগে আমরা প গড় থেকে ঢাকার ভাড়া নিতাম ৮৫০ টাকা। শনিবার সকাল থেকে ১৩০০ টাকা করে নিচ্ছি। সকাল থেকে আমাদের ৫টি গাড়ি ছেড়ে গেছে। আরও বেশি সংখ্যক গাড়ি চলতো। যাত্রী কম হওয়ায় গাড়ি কমিয়ে দিয়েছি। বাসভাড়া বাড়ানোর ফলে সিএনজি, ট্রেন, ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য গণ পরিবহনের ওপর চাপ বেড়েছে। অভ্যন্তরীণ রুটগুলোতে বাসের বদলে অনেকে সিএনজি বা মোটরসাইকেলে চলাচল করছেন। এ অবস্থায় সিএনজি ভাড়াও বেশি নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। রংপুর থেকেও ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দূরপাল্লার সব বাসের ভাড়া বেড়েছে। শনিবার সকাল থেকে এসি বাসে ২০০ টাকা বাড়িয়ে ১৫০০ করা হয়েছে। নন-এসি বাসে ১১০ টাকা বাড়িয়ে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৮৫০ টাকা। ভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কামারপাড়া ঢাকা কোচ স্ট্যান্ডের শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মাহফুজ আলম নবিন।
ঢাকাগামী যাত্রী ফজলুল হক বলেন, আগামীকাল ঢাকা যাব। এজন্য এসআর ট্র্যাভেলসে এসির টিকিট নিলাম। ভাড়া নিলো এক হাজার ৫০০ টাকা। কাউন্টার থেকে বলছে তেলের দাম বাড়ানোর কারণে ভাড়া বেশি নেওয়া হচ্ছে। আলমগীর কবির সুমন নামের আরেক যাত্রী বলেন, বেশ কয়েকটি বাস কাউন্টারে গেছি। সবাই ভাড়া বাড়িয়েছে। ফতেহ আলী পরিবহনে ১১০ টাকা বেশিতে টিকিট নিলাম।
রায়হান শেখ নামের এক যাত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, কার কাছে অভিযোগ বা কার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব, করার কিছু নাই। চাঁপাইনবাবগঞ্জর রহনপুর-নাচোল বাসচালক আমিনুল ইসলাম জানান, তার গাড়িতে এক হাজার ৭৫০ টাকার তেলে চলতো। এখন দুই হাজার ৫১০ টাকার তেল লাগবে। ছোট গাড়িগুলোর জন্য আমরাতো এমনিতেই যাত্রী পাই না। ভাড়া বাড়ালে তো আরও যাত্রী পাব না।
উত্তরবঙ্গ পরিবহন মালিক শ্রমিক সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন সরকার বলেন, আমরা নিজেরাও চাই ভাড়া না বাড়িয়ে গাড়ি চলুক। এতে যাত্রী বেশি হবে। ব্যবসা ভালো হবে। কিন্তু তেলের যে পরিমাণ দাম বেড়েছে তাতে ভাড়া না বাড়িয়ে কোনোভাবেই পোষাবে না।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, গেল নভেম্বরে জ্বালানি তেলের মূল্য লিটার প্রতি ১৫ টাকা বৃদ্ধির সময়ে বাস ভাড়া ৩৫ শতাংশ হারে বাড়ানো হয়। এর ৯ মাসের মাথায় আবারও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সঠিক ব্যয় বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে এক লাফে বাস ভাড়া আবারও ২২ শতাংশ বাড়ানো হয়। তিনি আরও জানান, পুরোনো লক্কর-ঝক্কর বাসকে শো-রুম থেকে নামানো নতুন বাসের দাম, ব্যাংক সুদ ও অন্যান্য নতুন বাসের সুযোগ-সুবিধার হিসাব ধরে ব্যয় বিশ্লেষণ করা হলেও সিটি সার্ভিসে ৯৮ শতাংশ বাস-মিনিবাস চলাচলের অযোগ্য। আন্তঃজেলার ৪৮ শতাংশ বাস ২০ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে। এসব বাস অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। পুরোনো এসব বাসের যাত্রী সেবার মান তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। তিনি নতুন বাস এবং পুরাতন বাস আলাদা ব্যয় বিশ্লেষণ করে নির্ধারণের দাবি জানান।
ব্যয় বিশ্লেষণ ক্ষেত্রে সব ধরনের গাড়ি বর্ধিত ভাড়ার সুযোগ নিলেও বিআরটিএ তথ্য বলছে, সারাদেশে ৪৩ হাজার ৮৫৫টি বাস ও ২৭ হাজার ৬২৬টি মিনিবাস নিবন্ধিত। এরমধ্যে ২২ হাজার ৬৮৮টি বাস ও ১২ হাজার ৯৭৫ মিনিবাসের ফিটনেস নেই। অপরদিকে সারাদেশে এক লাখ ২৬ হাজার ২৩টি ট্রাক ও ২৯ হাজার ৬৮৩টি কাভার্ডভ্যান রয়েছে। এরমধ্যে ৬০ হাজার ৭০৯টি ট্রাক ও পাঁচ হাজার ৫৮১টি কাভার্ডভ্যানের ফিটনেস নেই। এছাড়া সড়কে ১৩ হাজার ১৩৪টি হিউম্যান হলার, অ্যাম্বুলেন্স এক হাজার ৬০৪টি, প্রাইভেটকার ৫২ হাজার ৪৪৮টি, ট্যাক্সিক্যাব ২০ হাজার, সিএনজি অটোরিকশা এক লাখ ৫১ হাজার ৩৪৯টি রয়েছে। এসবে বড় একটি অংশের কোনো ফিসটেস নেই।