শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৪৪ পূর্বাহ্ন

কবি মতিউর রহমান মল্লিক ভাইকে যেমন দেখেছি

মোঃ ওসমান গণি
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০২২

বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির উজ্জ্বল নক্ষত্র কবি মতিউর রহমান মল্লিক, ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব, অনেকগুলো গুণে তিনি গুনান্বিত। বিশিষ্ট কবি, গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী। তাঁর সম্পর্কে লেখার সাহস আমার নেই। বাংলাদেশের প্রধান কবি আল মাহমুদ মল্লিক সম্পর্কে বলেছেন ‘মল্লিকের কাজের পরিমাপ করার সাধ্য আমার নেই। মল্লিকের মত শিল্পীর সহযোগীতাকে তিনি ভাগ্যবান বলে মনে করেন’। তাঁর বিশাল সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞের আমি একজন কর্মী হিসেবে তার সান্নিধ্য লাভ করেছি বলে লিখতে সাহস করলাম।
মল্লিক ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় ঢাকার আল ফালাহ মিলনায়তনে ১৯৯৯ সালের দিকে। সসাসের একটি সাংস্কৃতিক কর্মশালায় ঐ কর্মশালায় তিনি আল কুরআনের দারস দিয়েছিলেন। তার দারস শুনে মনে হয়নি তিনি একজন কবি বা শিল্পী, মনে হয়েছে তিনি কোরআনের একজন গবেষক। তখন তাঁর সুলোলিত কন্ঠের তিলাওয়াত হল ভর্তি সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। আমার জীবনে এত সুন্দর দারস্ আগে কখনো শুনিনি। ওই দিন থেকে মল্লিক ভাইয়ের ভক্ত হয়ে গেলাম। হেরাররশ্মি শিল্পীগোষ্ঠীর অডিও ক্যাসেট ‘নীল আসমান’র রেকর্ডিং করতে যখন ঢাকায় গিয়েছি তখন প্রত্যাশা প্রাঙ্গনে তাকে ভালোভাবে চিনেছি। সেই সময়ের পরিচালক আযাদ আলাউদ্দীনসহ আমরা দশজন শিল্পী তাঁর অফিসে প্রায় সপ্তাহ খানেক থেকে এই রেকর্ডিং এর কাজ সম্পন্ন করেছি। এই সময়ের মধ্যে তিনি কোন বিরক্তি বোধ কিংবা কোন আতিথেয়তার ঘাটতি চোখে পড়েনি। সব শিল্পীর ব্যক্তিগত খোঁজ খবর নিতেন তিনি। কে কোথায় কীভাবে থাকছেন, কার কী সমস্যা ইত্যাদি বিষয় অত্যন্ত কৌতুহলী মন নিয়ে জানতে চাইতেন। কেউ কোন সমস্যার কথা বললে তাকে কাছে ডেকে নিয়ে সমস্যার কথা ভালোভাবে শুনে, ভালো একটা সমাধানের পথ বলে দিতেন। এটা ছিল তাঁর একটা স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য । আমি নিজেও ব্যক্তিগত অনেক সমস্যার কথা তার সাথে শেয়ার করতাম। সমস্যার কথা শুনলে তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেত। মনে হতো সমস্যাটা তাঁর নিজের, মাথা নিচু করে কী যেন ভাবতেন, কিছুক্ষণ পর উঠে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলতেন, ‘ভেবো না সব ঠিক হয়ে যাবে’ আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করতে বলতেন। কবি ফররুখ আহমদের ঐ গানটিও শোনাতেন, ‘তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে- খোদার মদদ ছাড়া, তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাড়া’।
মল্লিকের পুরো জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় কারো কাছে কিছু চাওয়া তিনি পছন্দ করতেন না। একেবারে সাধাসিধে জীবনে অভ্যস্থ ছিলেন। সারাজীবন দারিদ্র, দ্রোহ আর অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। বাংলাদেশ থেকে যদিও অপসংস্কৃতি নির্মুল হয়নি তথাপি তিনি ব্যর্থ নন। বিপরীত একটি ‘স্রোত সৃষ্টি করে গেছেন। তার এই মিশন সফল করতে সারা দেশে অনেক শিল্পীগোষ্ঠী, অসংখ্য গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী তৈরি করে গেছেন, যারা বাংলাদেশে মল্লিকের সাংস্কৃতিক বিপ্লব বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের প্রতিটি বিভাগে এবং গুরুত্বপূর্ণ জেলাগুলোতে তিনি তৈরি করে গেছেন বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্রের শাখা। যারা নিজ নিজ এলাকায় সাহিত্য সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যার একটি বারিশাল সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, যার হাল ধরে আছেন মল্লিক ভাইয়ের অত্যন্ত স্নেহের সাংবাদিক আযাদ আলাউদ্দীন। তিনি আমারও অত্যন্ত কাছের মানুষ।
বরিশাল সংস্কৃতিক কেন্দ্রের জন্য মল্লিক ভাইয়ের মধ্যে যে পেরেশানী দেখেছি তা আজো মনে পড়ে। আজকের বরিশাল সংস্কৃতি কেন্দ্র যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, মল্লিক ভাই বেঁচে থাকলে ভীষণ খুশি হতেন। বরিশালে আসলেই তিনি সাংস্কৃতিক কর্মীদের সাথে আলাদাভাবে বসতেন। আর দিক নির্দেশনা দিতেন- কীভাবে বরিশাল সংস্কৃতি কেন্দ্রকে গতিশীল করা যায়। হেরাররশ্মি শিল্পীগোষ্ঠীর সহকারী পরিচালক হিসেবে আমিও ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য অর্জন করতাম। সংস্কৃতি কেন্দ্রর কাজ এগিয়ে নিতে তিনি যাদের উপর নির্ভর করতেন। তারাই আজ বরিশাল সংস্কৃতি কেন্দ্রের হাল ধরেছেন। কেন্দ্রের সভাপতি মাহমুদ হোসেন দুলাল ভাইকে সব সময় বলতেন, শিল্পীদেরকে বরিশালে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে। যাতে শিল্পীরা বরিশালে থেকে কেন্দ্রের জন্য কাজ করতে পারেন। উর্দ্ধতন দায়িত্বশীল, সমাজসেবক ও বিত্তশালীদের সাথে শিল্পীদের ক্যারিয়ার নিয়ে কথা বলতেন। তিনি শিল্পীদেরকে শিক্ষকতা পেশাকেই বেছে নিতে বলতেন। ব্যাংকের চাকুরিকে তিনি ব্যাঙের চাকরি বলে রশিকতা করতেন। কেউ শিক্ষক হলে তিনি বলতেন- মিষ্টি খাওয়াবো। শিল্পীদেরকে চাঙ্গা করতে যা করা দরকার সবই তিনি করতেন। এক্ষেত্রে তিনি তাঁর পদ পদবীর কথা ভুলে যেতেন।
আমি ২০১০ সালে মে মাসে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেছি। তার আগে আমি একটি সংস্থায় চাকুরি করেছি। সংস্থাটির অফিস ঢাকার পাশে হওয়ায় প্রতি সপ্তাহেই মল্লিক ভাইয়ের কল্যাণপুর অফিসে আসতাম। তাঁর কাছে আসলে মনের সব কষ্ট দুঃখ ভুলে থাকা যেত। এক্ষেত্রে তিনি একজন মনোরোগবিশেষরজ্ঞর ভূমিকা পালন করতেন বললেও ভুল হবে না।
একটা কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছি, শিক্ষক হলেও এই পরিচয় নিয়ে মল্লিক ভাইয়ের কাছে যেতে পারিনি। বলতে পারিনি মল্লিক ভাই, শিক্ষক হয়েছি- আপনি খুশি হয়েছেন? মল্লিক ভাইয়ের প্রতিটি উপদেশ বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে আমার ভান্ডারিয়া উপজেলায় কয়েকজন ভাইয়ের সহযোগিতায় গড়ে তুলেছি ‘সুরকোরাস’ নামে একটি শিল্পীগোষ্ঠী। উল্লে যোগ্য কোন সাফল্য না থাকলেও শিল্পীগেষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কাজ করে যাচ্ছি। যাতে মল্লিক ভাইয়ের স্বপ্নের পথ পাড়ি দিতে পারি। মল্লিক ভাই যে স্বপ্ন দেখতেন জানি তা একদিন বাস্তবে রূপ লাভ করবে। সেদিন আমরা কেউই থকবো না। সকল অন্যায়, অনাচার ও অপসংস্কৃতি দূরিভূত হবে এটাই স্বপ্ন দেখতেন মল্লিক ভাই।
অনেকটা অসময়েই চলে গেছেন কবি মল্লিক। চোখ বুজলেই অবচেতন মনে গেয়ে উঠি, ‘জিহাদ করতে চাই আমি জিহাদ করতে চাই, জিহাদ ছাড়া অন্য কোন পথে মুক্তি নাই’ কিংবা ‘আল কোর আনের পথ- এই পথই আসল পথৃ, ‘আমাকে যখন কেউ প্রশ্ন করে ..’ ইত্যাদি কালজয়ী গান। প্রতিটি গান, তার কন্ঠস্বর এখনও আমার হৃদয় দিয়ে অনুভব করি। এরকম অসংখ্য বিখ্যাত গানের স্রষ্টা তিনি। যে গানগুলো বিশ্বাসী হৃদয় সব সময় গেয়ে ওঠে। শিল্পী মল্লিকের মৃত্যু হলেও এ গান গুলোর মৃত্যু হবেনা। তাঁর গান যেমন বঞ্চিত মানবতার জন্য- তেমনি রাশেদার যুগ ফিরে পেতে তার গানের বিকল্প নেই। এদিক থেকে তাকে গানের জগতে একজন যুগশ্রেষ্ঠ বললেও বেশি বলা হবে না। একটি সফল, বিকল্প, যুগোপযোগী নতুন ধারার তিনি জনক। এক্ষেত্রে তার কাছাকাছি আর কাউকেই আমি দেখি না। একটা মহামূল্যবান সময়ে তার সুবিশাল সৃষ্টিকর্ম, বিশাল কর্মযজ্ঞ এদেশের মানুষের সামনে সদা দৃশ্যমান, এটা কোনদিন ম্লান হতে পারে না।
কবি নজরুল, ফররুখের মতো, তাঁর সৃষ্টি কর্মের পরিধি যদিও ব্যাপক নয় তবে আবেদনের দিক থেকে মোটেও কম নয়। ‘মল্লিক রচনাবলী’ প্রথম খন্ডের তথ্য অনুযায়ী তাঁর তিনটি কাব্য গ্রন্থে তাঁর কবিতা ১৫২, প্রকাশিত দুইটি গানের বইতে গানের সংখ্যা ১৯৬, যদিও তিনি আরো অনেক গান লিখেছেন এবং সুর করেছেন। রয়েছে দুটি প্রবন্ধ ও দুইটি ছড়ার বই। মল্লিক রচনাবলী সম্পাদনার সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন- তাঁর সব লেখা একত্র করলে এমন আরো চারটি খন্ড প্রকাশিত হবে। সবমিলিয়ে তাঁর সৃষ্টি নেহাত কম নয়। যা পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করবে ‘দেশীয় সাংস্কৃতিক সংসদ’।
সুস্থ সংস্কৃতির এই প্রাণপুরুষ ২০১০ সালের ১২ই আগস্ট, পহেলা রমজান অসংখ্য ভক্তদের কাঁদিয়ে পরপারের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছেন, রেখে গেছেন অসংখ্য গুনগ্রাহী ভক্ত ও শুভাকাঙ্খী যারা তাঁর অবর্তমানে অসমাপ্ত কাজ বাস্তবায়নে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা কবি মতিউর রহমান মল্লিকের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমীন।
লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,ভান্ডারিয়া মজিদা বেগম মহিলা কলেজ,ভান্ডারিয়া, পিরোজপুর।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com