উত্তরের খাদ্য ভান্ডার হিসেবে পরিচিত নওগাঁ জেলা। আর ধান উৎপাদনে প্রসিদ্ধ উপজেলা রাণীনগর। বৃষ্টিহীন বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও চলতি রোপা-আমন মৌসুমে উপজেলার আটটি ইউনিয়নে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে আমন ধান চাষ হয়েছে যা বিগত পঞ্চাশ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। কিন্তু বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণ মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) এবং ট্রিপুল সুপার ফসফেট (টিএসপি) সারের সরবরাহ না থাকায় চরম বিপাকে পড়েছে উপজেলার হাজার হাজার আমনচাষীরা। এছাড়া জ্বালানী তেল ও কীটনাশকসহ সকল কৃষি উপকরনের দাম দ্বিগুনের চেয়ে বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় আমন মৌমুসে কৃষকদের লোকসানের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এত সমস্যার পরও চালের উৎপাদন বৃদ্ধি করার আশা নিয়ে জমি পরিত্যক্ত ফেলে না রেখে লাভের স্বপ্ন বুকে ধারন করে আমন ধান রোপনের পর বর্তমানে ধানের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন উপজেলার কৃষকরা। উপজেলার সাতানি গ্রামের কৃষক রমিজ উদ্দিন বলেন, এবার তিনি আট বিঘা জমিতে আমন ধান আবাদ করেছেন। এবার বৃষ্টি না থাকায় ও প্রচন্ড তাপদাহ উপেক্ষা করে সেচ দিয়ে জমি চাষ করেছেন। আবাদের শুরুতেই সারের প্রয়োজন হয়। কিন্তু দোকানে গিয়ে ধর্না দিয়েও প্রয়োজন মতো সার পাওয়া যাচ্ছে না। কয়েক ডিলারের দোকান ঘুরে বেশি দামে সার কিনতে হচ্ছে। জমিতে কাজ করবো নাকি দিনের পর দিন ডিলার ও সারের পেছনে ঘুরব? এভাবে কি চাষাবাদ করা যায়! তার উপর আবার জ্বালানী তেলে দাম আকাশ ছোঁয়া। তাহলে আমরা প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা কোথায় যাবো। দিন যতই যাচ্ছে ততই ধান চাষসহ সকল আবাদ চাষাবাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সিংগারপাড়া গ্রামের কৃষক মোস্তাক আহমেদ বলেন, এবার তিনি ৩২বিঘা জমিতে আমন ধান চাষ করেছেন যা কখনোও করেননি। পর্যাপ্ত সার না পাওয়ায় তিনি বর্তমানে মহাবিপদে পড়েছেন। কারণ বর্তমান সময়ে সার ও কীটনাশকই হচ্ছে ধানের প্রাণ। কিছুদিন পানি না থাকলে ধানের তেমন কোন সমস্যা হবে না কিন্তু সময় মতো সার ও কীটনাশক দিতে না পারলে ব্যাহত হবে উৎপাদন আর শুরু হবে পোকার আক্রমণ। অপরদিকে জ্বালানী তেলের দাম বাড়ানোর কারণে কীটনাশকসহ সকল কৃষি উপকরণের দাম দ্বিগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। এতো দাম বৃদ্ধি হলে আমরা প্রান্তিক কৃষকরা কোথায় যাবো? আমাদের দিকে কারো সুদৃষ্টি নেই। একডালা গ্রামের কৃষক রইচ উদ্দিন বলেন, সরকার যদি বিসিআইসি ডিলারের পাশাপাশি বিএডিসি ডিলারদের মাধ্যমে সকল সার খোলাবাজারে বিক্রি করতো তাহলে কৃষকদের অনেক সুবিধা হতো। কারণ উপজেলায় বিসিআইসি ডিলার হাতে গোনা কয়েকজন আর বিএডিসি ডিলার প্রতিটি মোড়ে মোড়ে রয়েছেন। একজন কৃষককে জমি থেকে ২০কিমি দূরের বিসিআইসি ডিলারের কাছ থেকে সার নিয়ে জমিতে আসতে খরচ পড়ে যায় অনেক বেশি কিন্তু বিএডিসি ডিলারদের যদি পটাশসহ সকল সার বরাদ্দ দেওয়া হতো তাহলে বাড়ির দুয়ার থেকে একজন কৃষক অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সারটি কিনে খুব সহজেই জমিতে ছিটাতে পারতো। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শহীদুল ইসলাম বলেন, চলতি আমন মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা ছিলো প্রায় ১৮হাজার হেক্টর জমি কিন্তু সেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ২০হাজার ৬শত হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ হয়েছে। প্রতি বিঘায় যদি একজন কৃষক ১২কেজি করে সার ছিটায় তাহলে এই উপজেলার জন্য সারের প্রয়োজন হবে ১৮লাখ ৬০হাজার কেজি যা বরাদ্দের তুলনায় অনেক অনেক বেশি। এবার অতিবৃষ্টি ও বন্যার সম্ভাবনা না থাকায় পরিত্যক্ত পড়ে থাকা খাল, বিল, গাড়িসহ সকল নিচু জমিতেও কৃষকরা আমন ধান চাষ করেছে। কিন্তু সেই তুলনায় উপজেলায় সারের বিশেষ করে ইউরিয়া ও পটাশ সারের বরাদ্দ বৃদ্ধি পায়নি যার কারণে কৃষকরা তাদের প্রয়োজন মাফিক সার পাচ্ছেন না। অপরদিকে যেটুকু বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে সেইটুকুও সঠিক সময়ে পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের যেসব বন্যা প্রবণ এলাকায় চলতি আমন মৌসুমে ধান চাষ কম হচ্ছে সেই সব এলাকার সারের বরাদ্দ যে সব এলাকায় বেশি পরিমাণ আমন ধান চাষ হয়েছে সেই অঞ্চলগুলোতে ওই সারগুলোর বরাদ্দ দেওয়া গেলে সার নিয়ে কৃষকদের এই হাহাকার আর দেখতে হতো না। তিনি আরো বলেন, এছাড়াও উপজেলাতে প্রতিনিয়তই পুকুরে মাছ চাষ, সবজির বাগান, ফলের ও ছাদ বাগান বৃদ্ধি পাচ্ছে যেগুলোতেও সারের ব্যবহারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। দিন দিন সারের এই রকম বহুমাত্রিক ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়াই সারের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু সেই তুলনায় উপজেলার জন্য সারের বরাদ্দ বাড়ছে না যার কারণে সারের সংকট দেখা দিচ্ছে। অপরদিকে বৃষ্টির পানিতে প্রচুর পরিমাণ নাইট্রোজেন থাকে যা ইউরিয়া সারের প্রয়োজন মিটায় কিন্তু এবার অনাবৃষ্টির কারণে ইউরিয়া সারেরও চাহিদা বেড়ে গেছে। কারণ ইউরিয়া সার ছাড়া ধান গাছ সতেজ হয় না। আর ইউরিয়া কম হলেই ধান গাছ হলুদ হবে আর ফলনে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটবে। যদি প্রতিবছরই প্রয়োজনের চাইতে সারের বরাদ্দ একটু বৃদ্ধি করা হয় এবং সঠিক সময়ে সারগুলো ডিলারদের কাছে সরবরাহ করা হয় তাহলে জমিতে যতই ধান চাষ বৃদ্ধি পাক সারের জন্য কোন কৃষককে দুর্ভোগ পোহাতে হবে না। তারপরও আমি যখন যে সার পাচ্ছি সেই পরিমাণ সার অফিসের উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তাসহ আমি নিজে মনিটরিং এর মাধ্যমে এলাকা ভাগ করে ডিলারদের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে সঠিক ভাবে বন্টন করে আসছি। আমি আশাবাদি আমন মৌসুমের জন্য উপজেলায় যে পরিমাণ সারের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সেই সারের সরবরাহ সঠিক সময়ে পেলে কৃষকরা প্রয়োজন মাফিক সঠিক সময়ে জমিতে সার ছিটাতে পারবেন। এবার যদি কোন বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা না দেয় তাহলে উপজেলাতে চলতি আমন মৌসুমে ইরি ধানের চাইতেও কৃষকরা অধিক ফলন পাবেন বলে আমি আশাবাদি।