মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৫ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::
ভোলার বিভিন্ন চরাঞ্চল অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত লালমোহনে ডা. আজাহার উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের সভাপতিকে সংবর্ধনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহিদ ও আহতদের স্মরণে স্মরণসভা সিংড়ায় পরিবেশ রক্ষার্থে ৫৩৬টি ডাস্টবিন বিতরণ কাজী আজিম উদ্দিন কলেজে শিক্ষার্থীদের সাথে ছাত্রদলের ৩১ দফা নিয়ে মতবিনিময় সভা পটুয়াখালীতে শিক্ষক দম্পতি হত্যাকান্ডের মূল রহস্য উদঘাটনের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন টুঙ্গিপাড়ায় ভিক্ষুক ও হতদরিদ্রদের আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলো সমাজসেবা অফিস জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের আওতায় এনে সহায়ক কর্মচারী অন্তর্ভুক্ত ও বিচার বিভাগের আলাদা সচিবালয় গঠনের নিমিত্তে দাবি পেশ দাউদকান্দিতে সড়কের মাটি ধসে পড়ল খালে, দুর্ঘটনার আশংকা সীতাকুন্ডে বিতর্কিত মাদ্রাসা পরিচালকের করা মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে মানববন্ধন

‘আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেলের সুদৃষ্টি কামনা’ ২২ বছরেও আলফ্রেড সরেন হত্যার বিচার হয়নি

সোহেল রানা মহাদেবপুর (নওগাঁ) :
  • আপডেট সময় শনিবার, ২০ আগস্ট, ২০২২

২২ বছর আগের কথা। ২০০০ সালের ১৮ আগস্ট। বরেন্দ্র অঞ্চলের নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর আদিবাসী পল্লীর বাসিন্দারা অন্যান্য দিনের মতো নিজ নিজ কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ঠিক তখন ফিল্মি স্টাইলে হামলা চালিয়ে সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে দিবালোকে নৃসংশভাবে কুপিয়ে হত্যা করে সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর আদিবাসী স্বীকৃতি ও ভূমি অধিকার আন্দোলনের অন্যতম নেতা আলফ্রেড সরেনকে। হত্যার পর তার মরদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়। নারকীয় তা-বলীলা চালিয়ে ওই আদিবাসী পল্লীর প্রায় ১১টি পরিবারের বসতঘর ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে এলাকার কুখ্যাত ভূমিদস্যু হাতেম-গদাই গং। তাদের হামলায় আহত হয় নারী-শিশুসহ অন্তত ৩০ জন। সেদিন এতেই ক্ষান্ত হয়নি ঘাতকরা। কয়েকজন শিশুকেও প্রাণে মেরে ফেলার জন্য পার্শ্ববর্তী পুকুরের পানিতে ফেলে দিয়েছিলো। দেশবাসীকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল নির্মম এই দৃশ্য। গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়ায় ঘটনাটি এখনো মানুষ ভুলেনি। কিন্তু প্রকাশ্যে ঘটে যাওয়া চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকা-ের ২৩ বছরেও বিচারকার্য শেষ হয়নি। আদৌ ন্যায় বিচার পাবেন কিনা তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন নিহত সরেনের পরিবার ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নেতারা। তাদের দাবি এখনও প্রতিনিয়ত দেয়া হয় হুমকি-ধামকি। ফলে নিরাপত্তাহীনতায় কাটে প্রতিটি দিন। এ ঘটনায় স্থানীয় সচেতন মহল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, প্রায় ৯১ বছর আগে বিশ^কাব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘প্রশ্ন’ কবিতায় লিখেছিলেন ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাদে’।
বেঁচে থাকলে হয়তো এখন তাকে লিখতে হতো, ‘বিচারের বাণী সরবে প্রকাশ্যে কাদে’। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বহুল আলোচিত এই হত্যাকা- ও বর্বরোচিত হামলার পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মানুষ, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলসহ সচেতন মহলে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। নওগাঁ জেলা প্রশাসনের কার্যালয় ঘেরাওসহ সারাদেশে আদিবাসী সংগঠনগুলো ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। আলফ্রেড সরেন হত্যার পর তার ছোট বোন রেবেকা সরেন বাদী হয়ে মহাদেবপুর থানায় হত্যা মামলা ও তার ভাই বাদী হয়ে জননিরাপত্তা আইনে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় পুলিশ ৯১ জন আসামীর নামে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করে। এরমধ্যে কয়েক জন আসামীকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ। নওগাঁর দায়রা জজ আদালতে মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৩ জনের সাক্ষী গ্রহন সম্পন্ন হয়েছিল। বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর জননিরাপত্তা আইন বাতিল করলে শীতেষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ওরফে গদাই ও হাতেম আলীসহ অন্তত ৬০ জন আসামী জননিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন করলে তিন মাসের জন্য মামলার স্থগিতাদেশ দেন আদালত। এরপর আসামীরা জামিনে বেড়িয়ে আসে। গত ১৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর ভূমিপুত্র বলে খ্যাত আলফ্রেড সরেন এর ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়েছে। গেলো ২২ বছর ধরে এই দিনটিতে বিভিন্ন ভাবে বিচারের দাবি তুলে ধরে আসছেন স্থানীয়রা। এরই ধারাবাহিকতায় এবারও আলফ্রেড সরেন এর সমাধিতে পূষ্পমাল্য অর্পণ শেষে নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের নওহাটা মোড়ে (চৌমাশিয়া) মানববন্ধন ও আলোচনা সভা করেছে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ। এতে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, ভাষা, সংস্কৃতি ও পৃথক ভূমি কমিশন গঠনসহ আলফ্রেড সরেন হত্যার বিচার দ্রুত শেষ করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করার দাবী জানান বক্তারা। আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলার বাদী রেবেকা সরেন বলেন, আমার ভাইকে ভূমিদস্যুরা নির্মমভাবে চাইনিজ কুড়াল, রামদা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। হত্যাকা-ের পেছনে ছিল হাতেম-গদাই। এই হত্যার পর থানায় বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করি ও আমার বড় দাদা (ভাই) জননিরাপত্তা আইনে আরেকটি মামলা দায়ের করেন। ঘটনার সময় যে পরিবারগুলো বসবাস করতের তারা মামলার সাক্ষী হওযায় তাদেরকে বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হতো। জীবনের ভয়ে তারা বিভিন্ন জায়গায় চলে গেছে। তিনি বলেন, আমার ভাইকে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল একইভাবে ২০১২ সালে আমার ছোট ভাইকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। তারা এখনো আমাদের উপর বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। এবং আজও মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে জমির জন্য আমার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে সে জমিগুলোও তারা দখল করে খাচ্ছে। হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে তিনি আরও বলেন, আমি চোখের সামনে দেখেছি আমার ভাইকে হত্যার পর আমার মা-বাবা পাগলের মতো হয়ে মারা গেছে। হত্যান্ডের ২২ বছর অতিক্রম হয়ে গেলও আমরা বিচার পাইনি। আর বিচার পাব কিনা এইটা নিয়েও আমাদের মধ্যে সংশয় রয়েছে। একটি স্বাধীন দেশে আমরা কখনো এটা ভাবতে পারিনি। কবে বিচার পাবেন এমন প্রশ্ন তুলে কান্না জড়িত কন্ঠে আলফ্রেড সরেন এর মেয়ে ঝর্ণা সরেন বলেন, ২২ বছর অতিক্রম হচ্ছে আমার বাবার কোনো খুনিদের সঠিকভাবে ধরা হয়নি ও হত্যার বিচার করা হচ্ছে না। খুনিদের ফাঁসি চান তিনি। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সদস্য সাংবাদিক আজাদুল ইসলাম আজাদ বলেন, সমতলের আদিবাসীদের ভুমির অধিকার আদায়ের সংগ্রামের বীর সৈনিক আলফ্রেড সরেনের মেয়ে ঝর্ণা সরেন আর্তনাদ করে বাবা হত?্যার বিচার চাইছে। এই রাষ্ট্র কি তার আর্তনাদ শুনবে না? ভীমপুর আদিবাসী পল্লীতে হামলা চালিয়ে আলফ্রেড সরেনকে নৃশংসভাবে হত?্যার পর ওই দিনই নওহাটার মোড়ে প্রথম যে প্রতিবাদ সভা হয়, সেখানে চারজন বক্তার মধ্যে তিনিও ছিলেন। বাইশ বছর পর আজও সেই স্থানে দাড়িয়ে একই দাবী করতে হচ্ছে। তিনি মনে করেন, এ লজ্জা রাষ্ট্রের ও বাইশ বছর ধরে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় রয়েছে তাদের। মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী মহসীন রেজা বলেন, আলফ্রেড সরেনকে হত্যার পর তার বোন রেবেকা সরেন আসামিদের বিরুদ্ধে মহাদেবপুর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলার তদন্ত চলাকালে তার বড় ভাই জননিরাপত্তা আইনে আরেকটি মামলা দায়ের করেন। দুইটা মামলা একইসঙ্গে তদন্তে করে একটি অভিযোগ পত্র দায়ের করা হয়। মামলাটি নওগাঁ জেলা আদালতে বিচার কার্যক্রম শুরু হলে আসামিরা জননিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করলে পরবর্তীতে এই রিটগুলো খারিজ হয়ে গেলে আলফ্রেড সরেনের হত্যার বিচার কার্যক্রম চলতে থাকলে আসামিরা হাইকোর্টে রিটের খারিজের আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের ডিভিশনে মোকদ্দমা আনয়ন করেন। তিনি আরও বলেন, আপিল ডিভিশনে সে মোকাদ্দমা শুনানি অন্তে আপিল ডিভিশনের বিচারক পুনরায় সেই রিটগুলো শুনানির জন্য হাইকোর্টে পাঠালে রিটগুলো শুনানির জন্য অপেক্ষামান রয়েছে। আলফ্রেড সরেনের হত্যাকা-ের বিচার কার্যক্রম বর্তমানে নওগাঁর দায়রা জজ আদালতে স্থগিত অবস্থায় রয়েছে। এদিকে সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর লাখো মানুষ ও স্থানীয় বাসিন্দারা আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলার বিচারের জন্য আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেলের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com