বাংলাদেশে ইন্টারনেটের দাম তুলনামূলকভাবে কম হলেও এর মান ও গতির অবস্থা ভালো নয় বলে জানিয়েছে ইন্টারনেটের দাম ও গতি নিয়ে পর্যালোচনাকারী ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান কেবলডটকোডটইউকে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গতি ২২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৯৫তম।
অন্যদিকে ইন্টারনেটের গতি পরীক্ষা ও বিশ্লেষণের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ওকলার তথ্য অনুযায়ী, মোবাইল ইন্টারনেটের গতির দিক থেকেও বাংলাদেশ পিছিয়ে। ইন্টারনেটের গতির তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে জুলাই মাসের তথ্য অনুযায়ী, ১৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩০তম। ওকলার হিসাবে বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেটের ডাউনলোড গতি ৯ দশমিক ৬৪ এমবিপিএস। আপলোডের গতি ৭ দশমিক ৭৫ এমবিপিএস। এক বছর আগে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩১তম।
ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের সেবার মান দিন দিন বৃদ্ধি না পেয়ে কমে যাচ্ছে। আমাদের দাবি ছিল আইএসপিএবি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়ার প্রধান শর্ত থাকবে সরকার নির্ধারিত মূল্যে উন্নত এবং সর্বোচ্চ গতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা দেওয়া। বর্তমানে প্রায় দুই হাজারের অধিক লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান আছে। প্রায় দশ হাজার অবৈধ।
কেবলডটকোডটইউকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে গড়ে ১ জিবি ডেটার দাম শূন্য দশমিক ৩২ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় গড়ে ১ জিবির জন্য খরচ হয় ৩০ টাকা ৪১ পয়সা। যদিও গত বছর এ দাম ছিল শূন্য দশমিক ৩৪ ডলার তথা ৩২ দশমিক ৩১ টাকা। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে কম দামে মোবাইল ইন্টারনেট পাওয়া যায় ভারতে (শূন্য দশমিক ১৭ ডলার), নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় (শূন্য দশমিক ২৭ ডলার)।
তবে বিশ্বে মোবাইল ইন্টারনেটের দাম সবচেয়ে সস্তা ইসরায়েলে। মোবাইল ইন্টারনেটের কম দামের দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। তবে এটি গতবার ছিল অষ্টম অবস্থানে। এতে ২৩৩টি দেশের ৫ হাজার মোবাইল ডেটা প্ল্যানের ১ জিবি খরচের তুলনামূলক পর্যালোচনা করা হয়েছে।
কেবলডটকোডটইউকে ২২০টি দেশের বৈশ্বিক ব্রডব্যান্ডের তুলনামূলক দামও পর্যালোচনা করেছে। সেপ্টেম্বরে দেওয়া বিশ্বের মোবাইল ডেটার দাম সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের ব্রডব্যান্ড ও মোবাইল ডাটার মান দুটিই খারাপ। বাংলাদেশে ব্রডব্যান্ড ব্যবহারের জন্য মাসে গড়ে ১৭ দশমিক ৪০ ডলার অর্থাৎ দেড় হাজারের কিছু বেশি টাকা খরচ করতে হয়। বাংলাদেশে সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা খরচ করলে ব্রডব্যান্ড সেবা পাওয়া যায়। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে ব্রডব্যান্ডের দাম কম নেপাল (১১ দশমিক ৭০ ডলার), শ্রীলঙ্কা (১৪ দশমিক ৯৯ ডলার) ও ভারতে (১৫ দশমিক ৫৯ ডলার)।
যাদের লাইসেন্স আছে তাদের আমরা সতর্ক করতে পারি। কিন্তু যাদের লাইসেন্স নেই তাদের বিষয়ে অভিযোগগুলোর নাম-ঠিকানা বিটিআরসির কাছে দিচ্ছি। বিটিআরসি যদি অ্যাকশন না নেয় আমাদের তো করার কিছু থাকে না। তাদের যথেষ্ট লোকবল নেই। অফিস নেই।
কেবলডটকোডটইউকে তথ্য অনুযায়ী, ব্রডব্যান্ডে গতির দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অবস্থান ৭৭তম, মালদ্বীপ ১২৭তম, শ্রীলঙ্কা ১২৯তম, নেপাল ১৩৯তম এবং ভুটান ১৪৩তম। এর মধ্যে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে ইন্টারনেটের দাম বাংলাদেশের চেয়ে কম। বাংলাদেশের গড় ডাউনলোড গতি ৩ দশমিক ৭৪ এমবিপিএস। এখানে ৫ জিবির একটি সিনেমা নামাতে ৩ ঘণ্টা ২ মিনিট ৩২ সেকেন্ড সময় লাগে।
বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্রডব্যান্ডে ধীরগতির কারণ হলো নিয়মবহির্ভূতভাবে ব্যবসা চালানো, পেশিশক্তি ও বিটিআরসির নজরদারির অভাব। ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সদস্য নয় এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা সেবা পরিচালনা। আইনে না থাকলেও স্যাটেলাইট ক্যাবল অপারেটদের এই কাজ করতে দেওয়া।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের সেবার মান দিন দিন বৃদ্ধি না পেয়ে কমে যাচ্ছে। আমাদের দাবি ছিল আইএসপিএবি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়ার প্রধান শর্ত থাকবে সরকার নির্ধারিত মূল্যে উন্নত এবং সর্বোচ্চ গতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা দেওয়া। বর্তমানে প্রায় দুই হাজারের অধিক লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান আছে। প্রায় দশ হাজার অবৈধ। এদের নজরদারি করার মতো লোকবল বা সক্ষমতা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) নেই। অন্যদিকে যত্রতত্র ফাইবার স্থাপন ও কর্তনের ফলে সংযোগ নিরবচ্ছিন্ন রাখাও কঠিন হয়ে পড়েছে। ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) ও বেসরকারি নেটওয়ার্ক ট্রান্সমিশন সেবাদাতার (এনটিটিএন) সঙ্গে আইএসপিবির ইকো সিস্টেম না থাকাও মানহীন সেবার অন্যতম কারণ।
অন্যদিকে টেলিকম প্রতিষ্ঠানগুলো তরঙ্গ বরাদ্দ নিলেও এখন পর্যন্ত তারা ইকুইপমেন্ট পর্যাপ্ত পরিমাণে বসায়নি। সেই সঙ্গে মোবাইল টাওয়ারগুলো ক্ষমতা এবং ট্রাফিক অনুপাতে বসানো হয়নি।
ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গতির মান খারাপ হওয়া প্রসঙ্গে আইএসপিএবি’র সভাপতি ইমদাদুল হক বলেন, এটার দুটি কারণ। এর একটি হলো লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলো কোয়ালিটি মেইনটেইন করেই সার্ভিস দিচ্ছে। কিন্তু লাইসেন্সবিহীন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা কোয়ালিটি মেইনটেইন করে না এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা মনোপলি ব্যবসা করেন। এলাকার দখলবাজ, চাঁদাবাজ কিছু লোকজন আছে তারা ওই এলাকা দখল করে এই ব্যবসা করেন। এখানে অন্য কোনো ভালো অপারেটরকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। তার মানে ওইসব এলাকায় যারা সার্ভিস দিচ্ছেন তারা কোয়ালিটি মেইনটেন করছেন না। এমনকি অন্য কাউকে ঢুকতেও দিচ্ছেন না। ফলে প্রতিযোগিতামূলক মার্কেট তৈরি হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে ধরনের সার্ভিস আছে ৩০ শতাংশ। এদের কারণেই এই সমস্যা। এটা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিটিআরসি চেষ্টা করেছে। কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে অ্যাসোসিয়েশনের কিছু করার আছে কি-না? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, যাদের লাইসেন্স আছে তাদের আমরা সতর্ক করতে পারি। কিন্তু যাদের লাইসেন্স নেই তাদের বিষয়ে অভিযোগগুলোর নাম-ঠিকানা বিটিআরসির কাছে দিচ্ছি। বিটিআরসি যদি অ্যাকশন না নেয় আমাদের তো করার কিছু থাকে না। তাদের যথেষ্ট লোকবল নেই। অফিস নেই। কোয়ালিটি মেইনটেইন করতে গেলে প্রত্যেক বিভাগে বিটিআরসি’র একটি সাব-অফিস থাকা দরকার।
তিনি বলেন, আরেকটি কারণ হলো ট্রান্সপোর্ট কস্ট। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে আমাদের ইকুপমেন্টের দামও বেড়েছে। ফলে গ্রাহক সংখ্যা বাড়াতে হয় এবং গ্রাহক সংখ্যা বাড়ালে গতি কমে যায়।
দেশে চারটি মোবাইল কোম্পানি থাকলেও সবচেয়ে বেশি গতির ইন্টারনেট দিচ্ছে বাংলালিংক। টানা চতুর্থবারের মতো ওকলা অ্যাওয়ার্ড দেয় বাংলালিংককে। অন্যদিকে সেবার মান খারাপ হওয়া গ্রামীণফোনের সিম বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার।
বাংলালিংকের চিফ কমার্শিয়াল অফিসার উপাঙ্গ দত্ত বলেন, আমরা সেরা ডিজিটাল সেবা প্রদানে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এজন্য ধারাবাহিকভাবে চারবারের মতো এ মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার অর্জন করেছি। এটি অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপার। আমরা আগামীতে গ্রাহকদের আরও ভালো সার্ভিস দিতে পারব।
ইন্টারনেটের ধীরগতি বা মান খারাপ সম্পর্কে জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, আমাদের দেশে মোবাইল নেটওয়ার্কে সমস্যা আছে। প্রযুক্তির গতি না থাকলে গ্রাহককে গতি দেব কীভাবে। আমরা ২০১৮ সালে ফোরজি চালু করেছি। এরপর ২০২১ সালে তরঙ্গ নিলাম করেছি। তখন করোনার মধ্যে ছিলাম। ফলে প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়নি। অপারেটরদের তথ্য অনুযায়ী দেশের ৯৮ শতাংশ অ লে ফোরজি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। নেটওয়ার্ক গড়ে তুললেও গ্রাহককে দুটি শর্ত পূরণ করতে হবে। ফোরজির জন্য সিম ও হ্যান্ডসেট আপডেট করতে হবে। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত ৪০ শতাংশের ওপরে স্মার্টফোন নিউট্রেশন করতে পারিনি। ফলে ব্যবহারকারীর কাছে যে গতি দেব সেটি গ্রহণ করার যন্ত্রটাও তো তার কাছে থাকতে হবে।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের জুলাই মাসে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে। বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, জুনের তুলনায় জুলাই মাসে প্রায় ১৪ লাখ নতুন ডেটা ব্যবহারকারী গ্রাহক বেড়েছে। জুলাই মাসের ৩ দশকিম ৮ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বেড়েছে। ফলে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ দশমিক ৭৬ কোটিতে পৌঁছেছে।