ঢাকাই সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেতা ওমর সানী। দেখতে দেখতে সিনেমার ভুবনে তার পথচলার ৩০ বছর পূর্ণ হলো। এ অভিনেতা নিজেই জানালেন সে কথা। সেই নব্বই দশকের শুরুতে চলচ্চিত্রে তার আগমন ঘটে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়ে। একজন রোমান্টিক হিরো হয়েই পর্দায় আসেন তিনি। এরপর তাকে দেখা গেছে নানামাত্রিক চরিত্রে। অভিনয় করেছেন ভিলেন হিসেবেও। নায়ক হিসেবে যেমন ভিলেন হিসেবেও তেমনি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন ওমর সানী। বর্তমানে চলচ্চিত্রে নানা সংকট চলছে। আগের মতো নেই সিনেমার ব্যস্ততা। আরও অনেকের মতো ওমর সানীও তাই অনিয়মিত হয়ে গেছেন ঢালিউডে। তবে নিজেকে তিনি জড়িয়ে রেখেছেন চলচ্চিত্রের সঙ্গেই। বাংলাদেশ ফিল্ম ক্লাবের মতো গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনটির সভাপতির দায়িত্ব তারই হাতে। ফখরুল হাসান বৈরাগীর ‘অগ্নিপথ’, আফতাব খান টুলুর ‘আমার জান’, নূর হোসেন বলাইয়ের ‘এই নিয়ে সংসার’ ছবিগুলোতে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ১৯৯০ সালের দিকে প্রথম শুটিং করেন ওমর সানী। তবে তার প্রথম ছবি ‘চাঁদের আলো’ মুক্তি পায় ১৯৯৩ সালে। শেখ নজরুল ইসলাম পরিচালিত এই ছবিতে তার নায়িকা হিসেবে ছিলেন অভিনেত্রী আনোয়ারার মেয়ে মুক্তি। নতুন দুই মুখ নিয়ে নির্মিত ছবিটি বেশ ভালোই সাড়া ফেলেছিলো দর্শকের মধ্যে। তবে এ ছবির ‘তুমি আমার চাঁদ আমি চাঁদেরই আলো’ গানটি আকাশ ছুঁয়েছিলো জনপ্রিয়তায়। আজও সেই গান অনেকেই গুনগুন করে গেয়ে উঠেন প্রিয় মানুষটির সঙ্গে রোমান্টিক মুহূর্তে।
এরপর তিন দশকের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে প্রায় ১৭০টির মতো সিনেমায় অভিনয় করেছেন ওমর সানী। নিজের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি জানিয়ে ওমর সানী বলেন, ‘আমি মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি আজকের এই চমৎকার জীবন, নাম-যশ তিনি আমাকে দান করেছেন। এটা আমার প্রতি তার বিশেষ অনুগ্রহ। আমি কৃতজ্ঞ আমার বাবা-মায়ের কাছে। যাদের জন্য এই পৃথিবীতে আসা। আমি ধন্যবাদ জানাই আমার ভক্ত, বন্ধু, সহকর্মীদের। যাদের ভালোবাসা, পরামর্শ ও সহযোগিতায় আমি ওমর সানী হয়েছি।’ নিজের ক্যারিয়ারের মুক্তি পাওয়া প্রথম সিনেমা ‘চাঁদের আলো’র পরিচালক শেখ নজরুল ইসলামকে নিজের ওস্তাদ দাবি করে তিনি বলেন, ‘উনার হাত ধরেই আমি নায়ক হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছি। তার প্রতি আমার অনেক শ্রদ্ধা। সেইসঙ্গে তিন দশক পূর্তির এই সময়টাতে আমার প্রথম নায়িকা মুক্তিকেও আমি স্মরণ করছি, ধন্যবাদ জানাচ্ছি। খুব চমৎকার অভিজ্ঞতা হয়েছিলো তার সঙ্গে কাজ করে। আমার সেই ছবির প্রযোজক শ্রদ্ধেয় দারাশিকোর কাছেও আমার কৃতজ্ঞতা।’
অনেক ভালো-মন্দ উপলব্দি নিয়ে নিজেকে সিনেমায় জড়িয়ে রেখেছেন, একজন মানুষ হিসেবে সমৃদ্ধ হয়েছেন বলে জানান ওমর সানী। সিনেমার এই পথচলায় তিনি অভিনয় করেছেন ইন্ডাস্ট্রির অনেক নামি ও সম্মানী নির্মাতাদের ছবিতে। তাদের উদ্দেশ্যে এ অভিনেতা বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে শ্রদ্ধেয় দেলোয়ার জাহান ঝন্টু, এজে মিন্টু, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, অভিনেতা রাজীব, নূর হোসেন বলাই, উত্তম আকাশ’সহ আরও অনেক জ্ঞানী ও গুণি মানুষদের সান্নিধ্য এবং বিশেষ ভালোবাসা পেয়েছি আমি। তারা আমাকে বিকশিত করেছেন নানাভাবে। আমি অনেক কৃতজ্ঞ আমাদের নন্দিত অভিনেত্রী শাবানা আপার কাছেও। তিনি আমাকে সন্তানের মতোই আগলে রেখেছেন সবসময়। সত্যি কথা বলতে আমি যদি বলি যে স্নেহ কাকে বলে, বিনয় কাকে বলে সেটা তাকে দেখে শিখেছি। তিনি আঙুল দিয়ে আমাদের আচার ব্যবহার শিখিয়েছেন। সেটে যখন আনোয়ার হোসেন, সৈয়দ হাসান ইমাম সাহেবদের মতো মুরুব্বীরা আসতেন শাবানা আপা দাঁড়িয়ে যেতেন। এগিয়ে গিয়ে তাদের খোঁজ খবর নিতেন। এসব দেখে দেখেই শিখেছি বড়দের কীভাবে সম্মান দেখাতে হয়। আজকাল তো এসবের বালাই নেই। সিনিয়ররাও এজন্য সেটে যেতে চান না।’ নায়িকা হিসেবে পেয়েছেন চম্পা, অঞ্জু ঘোষ, মৌসুমী, শাবনূর, লিমা, পপি, শাহনাজ, শিল্পী, ঋতুপর্ণা, জিনাত, নিশিসহ আরও অনেককে। তবে মৌসুমী, শাবনূর, শাহনাজ ও পপিকে নিজের সেরা ছবিগুলোর নায়িকা হিসেবে একটু এগিয়েই রাখেন সানী। এ অভিনেতা বলেন, ‘যাদের সঙ্গে আমি কাজ করেছি সবাই দারুণ অভিনেত্রী, স্মার্ট আর সফল। তবে স্ত্রী বলে বলছি না, শাবানা আপার পর ইন্ডাস্ট্রিতে আমার কাছে সবচেয়ে আদর্শ বলি বা ইউনিক, সেটা মৌসুমীকেই মনে হয়। তার সঙ্গে জুটি হয়ে সফল হয়েছি আমি। সে আমার সিনেমা এবং জীবন; সবখানেই সেরা নায়িকা। এরপর আমি শাবনূরের কথা বলবো। সে একজন ডাইনামিক অভিনেত্রী। তার সঙ্গেও সফল সিনেমা আছে আমার। শাহনাজের সঙ্গে কিছু ছবিতে খুব ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। খুব ভালো একটা মেয়ে। পপির প্রথম নায়ক আমি। এটা একটা অন্য রকম স্মৃতি। আমি আমার নায়িকাদের কাছেও কৃতজ্ঞ।’ চিত্রনায়িকা মৌসুমীর সঙ্গে জুটি বেঁধে ওমর সানী অনেক ব্যবসা সফল এবং জনপ্রিয় চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন। ১৯৯৪ সালে ‘দোলা’ চলচ্চিত্রে প্রথম মৌসুমীর সঙ্গে অভিনয় করেন ওমর সানী। সেই ছবির সেটেই দুজনের পরিচয় থেকে পরবর্তীকালে সেই সম্পর্ক প্রণয় পেরিয়ে বিয়েতে গড়ায়। ‘দোলা’ ছিলো সুপারহিট চলচ্চিত্র। সুপার জুটি সালমান-শাবনূরের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই এগিয়ে চললো সানী-মৌসুমীর জুটির। কখনো কখনো সালমান-শাবনূর জুটিকেও ছাড়িয়ে গেছে এই জুটির সিনেমা। দীর্ঘদিন তারা একসঙ্গে কাজ করেছেন ৪০টির বেশি সিনেমায়। উপহার দিয়েছেন ‘আত্ম অহংকার’, ‘লাট সাহেবের মেয়ে’, ‘রঙিন রংবাজ’, ‘মুক্তির সংগ্রাম’, ‘হারানো প্রেম’, ‘গরীবের রানী’, ‘প্রিয় তুমি’, ‘শান্তি চাই’, ‘মিথ্যা অহংকার’, ‘ঘাত প্রতিঘাত’, ‘লজ্জা’, ‘সংসারের সুখ দুঃখ’, ‘কথা দাও’, ‘তুমি সুন্দর’, ‘রুপসী রাজকন্যা’ ইত্যাদি। বলার অপেক্ষা রাখে না সবগুলো ছবিতেই সুপারহিট নায়ক হিসেবে দেখা দিয়েছেন ওমর সানী।
১৯৯৩ সালের ২ নভেম্বর রায়হান মুজিব পরিচালিত ‘আত্ম অহঙ্কার’ সিনেমার শুটিংয়ের সময় ওমর সানী তার নিজের একটি স্বর্ণের চেন উপহার দিয়েছিলেন মৌসুমীর জন্মদিন উপলক্ষে। তখন সিলেটের জৈন্তাপুরে শুটিং চলছিল। সেই থেকে ওমর সানী মৌসুমীর প্রেম, ভালোবাসার শুরু। শুরু একসঙ্গে জুটিবদ্ধ হয়ে সিনেমায় অভিনয় করা। সেই সম্পর্কের হাত ধরেই ১৯৯৬ সালে বিয়ে করেন তারা। এই দম্পতি বর্তমানে দুই সন্তানের জনক ও জননী। তারা হলেন পুত্র ফারদিন এবং কন্যা ফাইজা। এরপর শাবনূরের সঙ্গে জুটি বেঁধেও তুমুল সাফল্য পেয়েছেন ওমর সানী। এ জুটির ‘অধিকার চাই’, ‘রঙিন নয়নমণি’, ‘কে অপরাধী’ ছবিগুলো এখনো ঢাকাই সিনেমার দর্শককে মুগ্ধ করে। ছবিগুলোর বেশ কিছু গানও হয়েছে শ্রোতাপ্রিয়। আর শাহনাজের বিপরীতে ওমর সানীর ‘চালবাজ’ ছবিটি বেশ সাফল্য পেয়েছিলো। অন্যদিকে ১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়া নায়িকা পপির সঙ্গে ‘কুলি’ ছবিটি সুপারহিট ছিলো। এই ছবি দিয়েই ইন্ডাস্ট্রিতে অভিষেক ঘটে পপির। ছবিতে ‘আকাশেতে লক্ষ তারা চাঁদ কিন্তু একটা রে’ গানটি খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ৩০ বছরের অভিনয় জীবনে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি কী? এমন প্রশ্নের ওমর সানীর সদাহাস্য উত্তর, ‘অভিনয় জীবনের সেরা প্রাপ্তি দর্শকের ভালোবাসা। এখনও দর্শক আমাকে ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন। এর চেয়ে সুন্দর আর বড় পাওয়া কী হতে পারে। আর নিজের অপ্রাপ্তিগুলোকে আসলে ভাবতে চাই না। অপ্রাপ্তি বা না পাওয়ারা সবসময়ই বেদনার। সেসব এড়িয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করতে হয়। তবে শুধু এটুকু বলবো যে সময়টাতে আমি ভালো কিছু ছবি করেছি সেই সময়টাতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান বন্ধ ছিল। নইলে একটা পুরস্কার হয়তো আমিও পেতাম।’ ক্যারিয়ারের চমৎকার এই দিনটিতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে সুন্দর ও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য দোয়া চেয়েছেন ওমর সানী।