১২০৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে সেপ্টেম্বর, আনাতোলিয়া উপদ্বীপের বালখ (বর্তমান আফগানিস্তান) শহরের সুলতানুল উলামা, বাহা উদ্দিন ওয়ালাদ এবং মুইমিনা খাতুনের কোল জুড়ে আসে এক ফুটফুটে সন্তান। পিতা তার নাম রাখেন জালাল উদ্দিন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি রোমের আনাতোলিয়ার বিখ্যাত মাওলানা ও কবি হয়ে উঠলে তার পরিচিতি ঘটে মাওলানা এবং রুমি নামে। আর আজকে আমরা সেই বিখ্যাত মাওলানা বা কবি জালাল উদ্দিন রুমির গল্পই শুনবো, যার উক্তি শুনলে আমাদের হৃদয়ে দাগ কেটে যায়, যার কবিতা আমাদের নতুন করে ভালোবাসার সংজ্ঞা শেখায়, যার কবিতা আমাদের শেখায় সৃষ্টিকর্তাকে ভয়ে নয়, ভালোবাসায় খুঁজে পাওয়া যায়।
পিতা সেই সময়ের বিখ্যাত উলামা এবং আইনজ্ঞ হওয়ার কারণে ছোটবেলা থেকেই রুমির সুযোগ ঘটে ইসলামি শাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ে গভীরভাবে জ্ঞান অর্জন করার। আর তার মা মুইমিনা খাতুন খোয়ারিজমী রাজবংশের বংশধর হওয়ায় শৈশব থেকেই রুমি সমাজের উঁচু স্তরের লোকজনদের সাথে মিলেমিশে বড় হতে থাকেন। রুমির বয়স যখন ১১ বছর, বালখ শহরের রাজার সাথে এক বিবাদের জের ধরে বাহা উদ্দিন ওয়ালাদ তার পরিবার আর কয়েকশ অনুসারী নিয়ে মধপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে হিজরতের জন্য বের হয়ে যান। আর এই হিজরত চলাকালেই রুমির সাথে সাক্ষাৎ ঘটতে থাকে সে সময়ের বিখ্যাত সব মনিষীদের। তার ১৮ বছর বয়সে মক্কা যাওয়ার পথে নিশাপুরে তাদের সাথে দেখা হয় পারস্যের বিখ্যাত আধ্যাত্মিক কবি আত্তারের। তিনি রুমিকে তার বাবার পেছনে হাঁটতে দেখে বলে ওঠেন,“একটি হ্রদের পেছনে একটি সমুদ্র যাচ্ছে”। তিনি রুমিকে ইহজগতের আত্মার উপর লেখা একটি বই ‘আসারনামা’ উপহার দেন। যা রুমির কিশোর বয়সে গভীর প্রভাব ফেলে এবং তিনি রহস্যের উপরে আকৃষ্ট হয়ে ওঠেন। হিজরত চলার সময় কারামানে থাকা অবস্থায় ১২২৫ সালে রুমি গওহর খাতুনকে বিয়ে করেন। তাদের দুজন ছেলে- সুলতান ওয়ালাদ এবং আলাঊদ্দিন চালাবী। এরপর গওহর খাতুন মারা গেলে রুমি এক বিধবা মহিলাকে বিয়ে করেন, যার আগে একটি মেয়ে ছিল কিমিয়া খাতুন নামে। এখানে রুমির এক ছেলে আমির আলিম চালাবী এবং এক মেয়ে মালাখী খাতুনের জন্ম হয়।
১২২৮ সালে আনাতোলিয়ার শাসক আলাউদ্দিন কায়কোবাদ, বাহাউদ্দিন এবং তার পরিবারকে আনাতোলিয়ার কোনিয়ায় নিমন্ত্রণ দিয়ে নিয়ে আসেন এবং তাদের সেখানে থেকে যাওয়ার অনুরোধ জানান। বাহাউদ্দিন সেখানের মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। কিছুদিন পর তিনি মারা গেলে মাত্র ২৫ বছর বয়সে রুমি তার স্থলাভিষিক্ত হন এবং ধীরে ধীরে তিনি সেখানকার মৌলভী সাহেব বা মাওলানা সাহেব হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। শিক্ষক থাকা অবস্থাতেই রুমি বাহাউদ্দিনের এক ছাত্র সৈয়দ বুরহান উদ্দিন মোহাক্কিকি তীরমিযির কাছে টানা নয় বছর বিভিন্ন ইসলামি শরীয়া এবং সূফীবাদের শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং একসময় তিনি কোনিয়ার মসজিদের প্রধান বিচারক হয়ে ওঠেন।
সুতরাং এ থেকেই বোঝা যায়, কোনিয়ায় রুমির জীবন বেশ ভালোমতোই চলছিল। তিনি ছিলেন কোনিয়ার উঁচু স্তরের সম্মানিত ব্যক্তি। কোনিয়ার তখনকার রাজা তার ছাত্র হওয়ায় অনেক সময় তাকে রাজা থেকেও উঁচু পর্যায়ে মানা হতো। তবে এতকিছুর মাঝেও তিনি ছিলেন কিছুটা ব্যতিক্রম। তিনি সকল স্তরের মানুষদের সাথে অবলীলায় মিশতেন। শ্রেণিবৈষম্য তার মধ্যে ঠাঁই পায়নি। কখনো কোনো মুচি, কখনো বা কোনো স্বর্ণকার হয়ে যেত তার অন্তরঙ্গ বন্ধু। আর এভাবেই ১২৪৪ সালের ১৫ই নভেম্বর তার সাথে পরিচয় হয়ে যায় শামস তাবরিজির। শামস তাবরিজি ছিলেন একজন চালচুলোহীন ভবঘুরে সাধু, লোকে যাকে ‘পাখি’ বলে ডাকতো। কারণ তিনি এক জায়গায় বেশিদিন স্থির থাকতে পারতেন না আর প্রচলিত ছিল, তাকে একইসময় দুই জায়গায় দেখা যেত, যাতে মনে হতো তিনি উড়ে বা নিজের ইচ্ছামতো চোখের পলকে অবস্থান বদল করতে পারতেন।
শামস তাবরিজি প্রথম রুমিকে দেখেছিলেন যখন রুমির বয়স ২১ বছর, এবং তিনি রুমিকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন রুমিই হতে পারবেন তার যোগ্য শিষ্য এবং প্রতিনিধি, যিনি তার আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং ক্ষমতাকে পরিপূর্ণভাবে ধারণ করতে পারবেন। কিন্তু রুমির বয়স তখন কম থাকায় তিনি তখন রুমিকে ধরা দেননি। তাই রুমির বয়স যখন চল্লিশ হয় এবং সেই আধ্যাত্মিকতা ধারণ করার জন্য তিনি যোগ্য হয়ে ওঠেন, তখন শামস তাবরিজি আবার তাকে খুঁজে বের করেন। রুমিও শামস তাবরিজির সাক্ষাৎ পেয়ে অভিভূত হয়ে পড়েন। তিনি বুঝতে পারেন এতদিন যে জীবন, যে বিশ্বাস নিয়ে তিনি বেঁচে ছিলেন, তার বাইরেও অনেক কিছু আছে। অনেক কিছু তার বোঝার ও ধারণ করার আছে। তাই তিনি শামস তাবরিজিকে তিনি তার বাড়িতে নিয়ে আসেন। তার সাথে দীর্ঘক্ষণ একান্ত সময় কাটাতে থাকেন এবং শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকেন।
কিন্তু শামস তাবরিজির সাথে রুমির মেলামেশার এই বাড়াবাড়ি সকলে ভালোভাবে নিতে পারেনি। তার পরিবার এবং সমাজের উঁচু স্তরের লোকেরা মনে করতে থাকেন, শামস তাবরিজির সাথে এত মেলামেশায় রুমির ‘সম্মানহানি’ ঘটছে। তাই তারা শামস তাবরিজিকে বিভিন্ন হুমকি-ধমকি দিতে থাকেন এবং তাবরিজিও এক পর্যায়ে কোনিয়া ছেড়ে দামেস্কে চলে যান। কিন্তু এই ঘটনায় রুমি প্রচন্ড ভেঙে পড়লে তার বড় ছেলে সুলতান ওয়ালাদ তাকে কোনিয়া ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হন। এরপর রুমি শামস তাবরিজিকে কোনিয়ায় ধরে রাখতে এক অদ্ভুত কাজ করে বসেন। তার ১২ বছর বয়সী সৎ মেয়ে কিমিয়া খাতুনকে ষাটোর্ধ্ব শামস তাবরিজির সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। এই ঘটনায় রুমির ছোট ছেলে আবদুল্লাহ চেলেবী প্রচ- ক্ষেপে ওঠে, কারণ সে কিমিয়া খাতুনকে মনে মনে পছন্দ করতো। বিয়ের কয়েক মাস পর কিমিয়া খাতুন মারা গেলে সমাজের উঁচু স্তরের ব্যক্তিদের মৌন সম্মতিতে আবদুল্লাহ শামস তাবরিজিকে হত্যা করে, এবং রাতের আঁধারেই রুমির অগোচরে তাকে দাফন করে ফেলে। রুমি তার জীবদ্দশায় এই ঘটনা কোনোদিনই জানতে পারেননি। তিনি প্রথমে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারেননি শামস তাবরিজি মারা গিয়েছেন। তাই তিনি লেখেন, “কে বলে, যে অমর সে মারা গিয়েছে?
কে বলে, আশার সূর্য মারা গিয়েছে?
ঐ দেখো, এ তো সূর্যের শত্রু যে ছাদে এসেছে,
এবং চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে বলছে, “হে, সূর্যের মৃত্যু হয়েছে।”
এভাবে তিনি চল্লিশ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করেন এবং এরপর কালো পোশাক পরে শামস তাবরিজির মৃত্যুর ঘোষণা দেন। তাকে হারানোর এই শোকই রুমির জীবনের মোড় পরিপূর্ণভাবে ঘুরিয়ে দেয়। এবং তার কাব্যসাধনার সূচনা ঘটে এই আঘাতের পর থেকেই। নিজের প্রিয় শিক্ষক এবং বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা তাকে করে তোলে প্রেমের ও বন্ধুত্বের কবি। তিনি লেখেন,”তুমি চলে গেলে আমার চোখ দিয়ে রক্ত বাহিত হলো। আমি কেঁদে কেঁদে রক্তের নদী বহালাম। দুঃখগুলো শাখা-প্রশাখা বেড়ে বড় হলো, দুঃখের জন্ম হলো। তুমি চলে গেলে, এখন আমি কীভাবে কাঁদবো? শুধু তুমি চলে গেছো তা-ই নয়, তোমার সাথে সাথে তো আমার চোখও চলে গেছে। চোখ ছাড়া এখন আমি কীভাবে কাঁদবো প্রিয়!” শামসকে চিরস্মরণীয় করে রেখে যাবার জন্য রুমি তার প্রথম মহাকাব্যের নাম দেন, ‘তাবরিজ শহর থেকে শামসের সমষ্টিগত কবিতা’। এছাড়াও তিনি তার অসংখ্য কবিতায় ‘শামস’ ছদ্মনাম হিসেবে ব্যবহার করেন, যার সংকলনকে ‘দেওয়ানে শামস’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। তার বিভিন্ন গজল এবং চতুষ্পদী কবিতাগুলোতে শামসের প্রতি তার ভালোবাসার বিভিন্ন স্তরের প্রতিফলন ঘটতে থাকে। আবার অনেকে বলে থাকেন, শামস তাবরিজির মৃত্যুর পর রুমিই শামস তাবরিজি হয়ে ওঠেন। তাই রুমির লেখা কবিতাগুলো মূলত শামস তাবরিজিরই কবিতা।
রুমির কবিতার সতেজ ভাষা এবং ছন্দ সহজেই মানুষের মনে জায়গা করে নিতো। তার প্রতিটি শব্দ শুনে মনে হতো এগুলো সাধারণ ভাষা নয়, মানুষের হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনের অনুবাদ, প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের ভাষা। তিনি তার কবিতাগুলো বা গজলগুলো লেখার অনুপ্রেরণা পেতেন তার পারিপার্শ্বিকতা থেকেই। কখনো বা রাখালের বাজানো বাঁশির সুর শুনে, কখনো ঢাকের আওয়াজ শুনে, আবার কখনো স্বর্ণকারের হাতুড়ির আওয়াজ শুনে। তিনি বিশ্বাস করতেন, সৃষ্টিকর্তার খোঁজ কোনো মসজিদ বা গির্জার পাওয়া সম্ভব নয়, সৃষ্টিকর্তার খোঁজ করতে হয় নিজের হৃদয়ে। তাই তিনি বলেছিলেন,
“আমি সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজছিলাম। তাই আমি মন্দিরে গেলাম, সেখানে তাকে খুঁজে পেলাম না। আমি গির্জায় গেলাম, সেখানেও তাকে পেলাম না। এরপর আমি মসজিদে গেলাম সেখানেও তাকে পেলাম না। এরপর আমি নিজের হৃদয়ে তাকে খুঁজলাম, সেখানে তাকে খুঁজে পেলাম।”
তিনি আরো বিশ্বাস করতেন ভালোবাসাই সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজে পাওয়ার সর্বোত্তম পন্থা। এজন্য তিনি বলেছিলেন,
“স্রষ্টার কাছে পৌঁছানোর অজস্র পথ আছে। তার মাঝে আমি প্রেমকে বেছে নিলাম।”
রুমি প্রায়ই তার অনুসারীদের নিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে যেতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে প্রকৃতির মাঝে ঈশ্বর অদৃশ্য জগতের বার্তা ছড়িয়ে দেন। তিনি প্রকৃতিকে ঈশ্বরের ভালোবাসার প্রতিফলন রূপে দেখতেন এবং সেখান থেকে কবিতা গজল রচনা করার অনুপ্রেরণা পেতেন। তিনি বলেছিলেন,
“প্রত্যেক বৃক্ষপত্র অদৃশ্য জগতের বার্তা বহন করে। চেয়ে দেখো, প্রতিটি ঝরা পাতায় কল্যাণ রয়েছে।”
প্রায়ই তিনি কবিতা বা গান রচনা করার সময় অন্যমনস্ক হয়ে যেতেন। কখনো কখনো তিনি তার গজলগুলোর সাথে এতটাই একাত্ম সাথে হয়ে যেতেন যে গভীর মগ্নভাবে ঘুরে ঘুরে নাচতে শুরু করতেন। তার নাচ দেখে মনে হতো, নাচের মাঝেই অন্য কোনো জগতে চলে গিয়েছেন, বাস্তব জগতের সাথে তার আর কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি নাচতেন, যখন তিনি সৃষ্টিকর্তা এবং সৃষ্টিকর্তার ভালোবাসার সাথে একাত্মতা অনুভব করতেন। তার নাচ তার কাছে একধরনের ইবাদত ছিল। তিনি বলেছিলেন,
“আমরা শূন্য থেকে ঘুরতে ঘুরতে এসেছি
যেমনটা তারারা আকাশে ছড়িয়ে থাকে।
তারারা মিলে একটি বৃত্তের সৃষ্টি করে,
এবং তার মাঝে আমরা নাচতে থাকি।”
শামস তাবরিজির মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর পর রুমির আবার গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে সালাউদ্দীন জাকুব নামক এক স্বর্ণকারের সঙ্গে। তিনি একদিন সালাউদ্দিন জাকুবের দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন এমন সময় তার হাতুড়ির আঘাতের শব্দ শুনে তিনি নাচতে শুরু করেন, তিনি জাকুবের হাতুড়ির আঘাতের শব্দের মাঝে যেন সৃষ্টিকর্তার করুণার সুর শুনতে পান, আর এভাবেই তাদের বন্ধুত্বের সূচনা হয়। এরপর থেকে দীর্ঘদিন যাবত জাকুব রুমির ঘনিষ্ঠ সহচরী হয়ে ছিলেন। রুমি তার বড় ছেলের সাথে সালাউদ্দিন জাকুবের মেয়ের বিয়ে দেন। সালাউদ্দিন জাকুবের মৃত্যুর পর রুমির এক ছাত্র হুসাম আল চেলেবীর সাথে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। হুসাম আল চেলেবীকে তিনি ‘দিয়া আল-হাক’ বলে ডাকতেন। যার অর্থ ছিল ‘সত্যের প্রদীপ’। তার পরামর্শেই রুমি তার সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রন্থ ‘মাসনাভি’ লেখা শুরু করেন। মাসনাভির মাঝে ১৩ শতকের সূফীবাদের বেশ নিদর্শন পাওয়া যায়। এছাড়াও রুমি মাসনাভিতে ফুটিয়ে তুলেছেন শামস তাবরিজি, সালাউদ্দিন জাকুব এবং হুসাম আল চেলেবীর প্রতি তার ভালোবাসার কথা।
মাসনাভি লেখার কিছুদিন পরই জালাল উদ্দিন রুমি মারা যান। তাকে তার পিতার পাশে কোনিয়ায় দাফন করা হয়। তিনি কোনিয়ার সমাজের অতি সম্মানিত এক ব্যক্তি ছিলেন। শুধু মুসলিমরা ছাড়াও অন্য ধর্মের লোকেরাও তাকে সম্মানের চোখে দেখতেন। তাই তার জানাজায় সকল ধর্ম-বর্ণের অসংখ্য লোক যোগ দেন। কোনিয়ায় তার মাজার বা সবুজ দরগা এখনো বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের, বিশেষ করে তুর্কিস্তানের মুসলিমদের কাছে তীর্থস্থান বলে পরিগণিত হয়। রুমির মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে সুলতান ওয়ালাদ এবং এবং শিষ্য হুসাম আল চেলেবি রুমির অনুসারীদের নিয়ে মৌলভী সম্প্রদায় গড়ে তোলেন, যারা বর্তমানে তুর্কিস্থানের ‘ঘূর্ণায়মান দরবেশ’ নামে পরিচিত। রুমি তার কবিতা বা গজল গাওয়ার সময় যে ঘূর্ণায়মান নৃত্যে মেতে উঠতেন, তার নির্দিষ্ট কোনো ধরন ছিলো না।
সুলতান ওয়ালাদ পরবর্তীতে এই নাচের অনুসরণ করে তার বাবার সম্মানার্থে একটি নির্দিষ্ট ধরনের নাচের সূচনা করেন, যেখানে একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্রে রাখা হয় রুমির রূপক হিসেবে এবং বাকিরা তাকে ঘিরে গোল করে ঘুরতে থাকে, যেভাবে সূর্যের চারপাশে গ্রহরা ঘুরে থাকে। আর এভাবেই রুমি নয় বরঞ্চ সুলতান ওয়ালদের হাত ধরে বিখ্যাত ‘সূফী নৃত্য’ বা ‘সামার’ সূচনা ঘটে। রুমির বিভিন্ন কবিতা এবং গানের পাশাপাশি ‘ফিহি মা ফিহি’ নামে তার বিভিন্ন উক্তির সংগ্রহ পাওয়া যায়, যা তার অনুসারীরা এবং বন্ধুরা বিভিন্ন সময় লিখে রেখেছিলেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তিকে লেখা তার বেশ কিছু চিঠিও পাওয়া গিয়েছে। রুমির চিন্তা বা ধারণাগুলোকে আসলে কোনো নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলা সম্ভব নয়। অনেক সময় এদের নিজেদের মাঝেই বিভিন্ন পার্থক্য ও বৈচিত্র্য দেখা যায়। তার বিভিন্ন রূপকের ব্যবহার এবং ধারণার পরিবর্তনশীলতা অনেকসময় পাঠকদের ধাঁধায় ফেলে দেয়। তার কবিতা বা লেখাগুলো আসলে বিভিন্ন রহস্যময় ও বিচিত্র অভিজ্ঞতায় মানুষের অভিব্যক্তিরই প্রতিফলন যেখানে মানুষ তার প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন অনুভূতিকে খুঁজে পায়। তাই তো জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমিকে কোনো নির্দিষ্ট জাতি বা গোষ্ঠী দিয়ে বেঁধে ফেলা সম্ভব নয়, কারণ তিনি সারা বিশ্বের মানুষের হৃদয়ের কথা বলেন, আর তিনি সবকিছু হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন। আর এ কারণেই তিনি সকলের হৃদয়ের সাথে মিশে যান। -সূত্র:roar.media/bangla