শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৫:৫৬ পূর্বাহ্ন

বিশ্বনবীর আগমন : আলোর হাতছানি

মাহমুদুর রহমান দিলাওয়ার:
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৪ অক্টোবর, ২০২২

গোটা দুনিয়া অন্ধকারে ডুবে ছিল। ধর্মীয় বিশ্বাসে ভ্রান্তিতেই ছিল বেশির ভাগ মানুষ। সামাজিক মূল্যবোধ বলতে কিছু ছিল না। চারিত্রিক অবস্থা ছিল অধঃপতিত। অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। রাজনৈতিক অবস্থাও ছিল নাজুক। শাসকরা বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল। প্রজা শ্রেণী ছিল মজলুম। অধিকার থেকে বঞ্চিত। এমন পরিস্থিতিতে আল্লাহ তায়ালার অপার কৃপায় দুনিয়ায় আসেন বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা:। তাঁর আগমন যেন অন্ধকারে আলোর ঝলকানি। পৃথিবী তাঁর আগমনী বার্তা পাওয়ার আশায় যেন ব্যাকুল ছিল! বাদশাহ নাজ্জাশির সাথে জাফর রা:-এর কথোপকথন থেকে আল্লাহর রাসূলের আগমনের পূর্বের অবস্থা ও তাঁর আগমন পরবর্তী অবস্থা সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। হাবশায় হিজরত সম্পর্কে উম্মে সালমা রা: থেকে সেই বর্ণনা পাওয়া যায়। ওই কথোপকথনে জাফর রা: বলেন, হে বাদশাহ! আমরা অজ্ঞ জনগোষ্ঠী। মূর্তিপূজা করতাম। মৃত প্রাণী ভক্ষণ করতাম। অশ্লীল কাজ করতাম। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করতাম।
প্রতিবেশীর সাথে মন্দ আচরণ করতাম। আর আমাদের সবল লোকজন দুর্বলদের শোষণের মাধ্যমে নিঃশেষ করে দিত। এ অবস্থায় আল্লাহ আমাদের কাছে এমন এক রাসূল প্রেরণ করলেন, যার বংশপরিচয়, সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা ও পরিচ্ছন্নতা আমাদের মধ্যে সুবিদিত। তিনি আমাদের মহান আল্লাহর দিকে ডাকলেন, যেন আমরা তাঁর একত্ববাদ মেনে নিই। তাঁর দাসত্ব করি ও আমাদের পিতৃপুরুষরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব মূর্তি ও পাথরের পূজা করতেন, আমরা যেন তা পরিত্যাগ করি। তিনি আমাদেরকে আদেশ দিলেন আমরা যেন সত্য কথা বলি, আমানত রক্ষা করি, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখি, প্রতিবেশীর সাথে উত্তম আচরণ করি ও নিষিদ্ধ কাজ সম্পাদন এবং রক্তপাত ঘটানো থেকে বিরত থাকি। আর অশ্লীলতা, মিথ্যা কথা, ইয়াতিমের সম্পদ ভক্ষণ ও সতী নারীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ আরোপ; এসব কাজ করতে তিনি আমাদের নিষেধ করলেন। হাইসামি বলেন, হাদিসটি আহমাদ, তাবারানি ও বাযযার বর্ণনা করেছেন। (সিরাতুন নবী : শায়খ ইবরাহিম আলী) হজরত আবু মূসা আশয়ারি রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘জাহেলি জমানার চারটি বিষয় আমার উম্মতরা (সম্পূর্ণরূপে) পরিত্যাগ করবে না। তা হলো- নিজ বংশের আভিজাত্যের গৌরব, অপরের বংশ পরিচয় নিয়ে কুৎসা রটনা, নক্ষত্রের মাধ্যমে বৃষ্টি কামনা ও বিলাপ করা’ (মুসলিম, আহমাদ, বায়হাকি)।
জাহেলি যুগে আরবদের মধ্যে মূর্তিপূজা প্রাধান্য পেয়েছিল। যদিও এক সময় তারা দ্বীনে ইবরাহিমের অনুসারী ছিল। হজরত ইসমাইল আ:-এর দাওয়াতের প্রভাবে যথেষ্ট অনুগত ছিল; কিন্তু সময়ের ব্যবধানে তাদের মধ্যে পরিবর্তন এলো। মূর্তিপূজাতেই অধিক হারে মনোনিবেশ করল। হোবল, মানাত ও ওযযা ছিল তাদের সবচেয়ে বড় মূর্তি। শিরকের ভয়াবহতায় তারা ডুবে ছিল। পৌত্তলিকরা কাবাঘরেও মূর্তি স্থাপন করে। মক্কা বিজয়ের সময় কাবাঘরে ৩০০ মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। বিখ্যাত সিরাত গ্রন্থ আর রাহিকুল মাখতুমের বর্ণনায় পাওয়া যায়- জাহেলিয়াত যুগের পৌত্তলিকদের মধ্যে মূর্তিপূজার বিশেষ কিছু নিয়ম প্রচলিত ছিল। এর বেশির ভাগই ছিল আমর ইবনে লুহাইয়ের আবিষ্কার। লোকেরা আমর ইবনে লুহাইয়ের আবিষ্কারগুলোকে ইবরাহিমের দ্বীনের পরিবর্তন নয়; বরং এসবকে তারা মনে করত বিদয়াতে হাসানাহ। মূর্তিপূজার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রেওয়াজ প্রথা তুলে ধরা হলো-
এক. আইয়ামে জাহিলিয়াতে পৌত্তলিকরা মূর্তির সামনে নিবেদিতচিত্তে বসত এবং তাদের কাছে আশ্রয় চাইত। তারা বিশ্বাস করত, মূর্তিরা আল্লাহর কাছে সুপারিশ করে তাদের উদ্দেশ্য পূরণ করিয়ে দেবে।
দুই. জাহেলিয়াত যুগের মূর্তিপূজারীরা মূর্তিগুলোর উদ্দেশে হজের তাওয়াফের মতো তাওয়াফ করত। তাদের সিজদা করত।
তিন. মূর্তিগুলোর জন্য কোরবানি ও নজরানা পেশ করা হতো। কখনো কখনো মূর্তির আস্তানায় নিয়ে কোরবানির পশু জবাই করা হতো। তবে সেটি করা হতো মূর্তির নামে। জবাইয়ের এ উভয় প্রকারের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা- ‘(সে পশুও হারাম) আর যা মূর্তির বেদির ওপর বলি দেয়া হয় তা’ (৫. সূরা আল-মায়েদাহ-৩)।
ইবনে কাসিরের বর্ণনায় এসেছে : ওই জন্তু, যাকে নুছুবের ওপর জবাই করা হয়। নুছুব ওই প্রস্তর বা বেদিকে বলা হয়, যা কাবাগৃহের আশপাশে স্থাপিত ছিল। জাহেলিয়াত যুগে আরবরা এদের উপাসনা করত ও এদের উদ্দেশ্যে জন্তু কোরবানি করত। একে তারা ইবাদত বলে গণ্য করত। জাহিলিয়াত যুগের আরবরা উপরোক্ত সব প্রকার জন্তুর গোশত ভক্ষণে অভ্যস্ত ছিল। আল্লাহ তায়ালা এগুলোকে হারাম করেছেন।
চার. মূর্তির সন্তুষ্টি লাভের একটি উপায় এটিও ছিল যে, পৌত্তলিকরা তাদের পানাহারের জিনিস, উৎপাদিত ফসল ও চতুষ্পদ জন্তুর একাংশ মূর্তির জন্য পৃথক করে রাখত। মজার ব্যাপার হচ্ছে- তারা আল্লাহর জন্যও একটি অংশ রাখত। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দেন- আল্লাহ যে শস্য ও গবাদিপশু সৃষ্টি করেছেন সে সবের মধ্য থেকে তারা আল্লাহর জন্য এক অংশ নির্দিষ্ট করে ও নিজেদের ধারণা অনুযায়ী বলে, এটি আল্লাহর জন্য এবং এটি আমাদের শরিকদের জন্য। অতঃপর যা তাদের শরিকদের অংশ তা আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না এবং যা আল্লাহর অংশ তা তাদের শরিকদের কাছে পৌঁছায়, তারা যা ফায়সালা করে তা কতই না নিকৃষ্ট ( সূরা আল-আনয়াম-১৩৬)। এ আয়াতে মুশরিকদের একটি বিশেষ ভ্রষ্টতা তুলে ধরা হয়েছে। এরকম আরো অনেক ভ্রান্ত ধারণা জাহেলিয়াত যুগে পৌত্তলিকদের মধ্যে বিরাজমান ছিল।
জাহেলি জামানায় মানুষগুলো জঘন্য প্রকৃতির ছিল। তারা কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দিয়ে দিত। আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিয়েছেন : আর যখন জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে, কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল (সূরা আত-তাকভির: ৮-৯)?
জাহেলিয়াত যুগের কোনো কোনো আরব গোত্র কন্যাসন্তানকে লজ্জাকর মনে করত এবং জীবন্তই মাটিতে প্রোথিত করে দিত (ইবনে কাসির, কুরতুবি)। পরবর্তীতে ইসলাম এই কুপ্রথার মূলোৎপাটন করে। ৯ নম্বর আয়াতের তাফসির করতে গিয়ে কোনো কোনো মুফাসসির বলেন, এই আয়াতের বর্ণনাভঙ্গিতে মারাত্মক ধরনের ক্রোধের প্রকাশ দেখা যায়। যে পিতা বা মাতা তাদের মেয়েকে জীবন্ত প্রোথিত করত, আল্লাহর কাছে তারা এত বেশি ঘৃণিত যে, তাদেরকে সম্বোধন করে এ কথা জিজ্ঞেস করা হবে না, তোমরা এই নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করেছিলে কোন অপরাধে? বরং তাদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ছোট্ট নিরপরাধ মেয়েকে জিজ্ঞেস করা হবে, তোমাকে কোন অপরাধে হত্যা করা হয়েছিল (ইবনে কাসির)। এরকম অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশকে আমূল পরিবর্তন যিনি করলেন তিনি হজরত মুহাম্মদ সা:। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ইলমুল ওহির আলোয় তিনি দুনিয়াকে আলোকিত করেছিলেন। বিখ্যাত অনেক অমুসলিম ব্যক্তিদের উক্তি থেকেও পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়, বিশ্বনবী কতটা মহান ও শ্রেষ্ঠ ছিলেন।
নেপোলিয়ন বোনাপার্টের মন্তব্য : মুহাম্মদ সা: আরববাসীর ঐক্যের দীক্ষা দিয়েছেন। তাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহ নিরসন করেছেন। অল্প কিছু দিনের ভেতর তাঁর অনুসারী উম্মত বিশ্বের অর্ধেকের চেয়েও অধিক অংশ জয় করে ফেলে। ১৫ বছর সময়ের মধ্যে আরবের লোকেরা মূর্তি ও মিথ্যা দেবতাদের পূজা থেকে তওবা করে ফেলল। মাটির মূর্তি মাটির সাথেই মিশিয়ে দেয়া হলো। এ বিস্ময়কর সাফল্য মুহাম্মদ সা:-এর শিক্ষা ও তাঁর অনুসরণের কারণেই হয়েছে।
টমাস কারলাইলের মন্তব্যটিও চমৎকার : আঁধার থেকে আলোর পথের দিশারি ছিলেন মুহাম্মদ সা:। আমি বলছি, স্বর্গের জ্যোতির্ময় আলো ছিলেন এ মহান ব্যক্তি। বাকি সব লোক ছিল জ্বালানির মতো। পরিশেষে তারাও পরিণত হয়েছিল আগুনের স্ফুলিঙ্গ। (অন্যদের চোখে আমাদের প্রিয়নবী) আজকের অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি ও স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে শাশ্বত জীবনাদর্শ; হজরত মুহাম্মদ সা:-কে অনুসরণ ও তাঁর নির্দেশনা মেনে চলার বিকল্প নেই। লেখক : সহকারী জেনারেল সেক্রেটারি, বাংলাদেশ মাজলিসুল মুফাসসিরিন




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com