সোমবার, ০১ জুলাই ২০২৪, ১২:৫৪ অপরাহ্ন

ভেঙে ভেঙে পড়ছে বিরোধীদলীয় নেতার সেই ‘লাল বাড়ি’

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০

রাজধানীর ২৯ মিন্টু রোডে বিরোধীদলীয় নেতার জন্য বরাদ্দ করা আছে লাল রঙের একটি দোতলা বাসভবন। এটি ভাঙার উদ্যোগ নেয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদফতর। কিন্তু নানা কারণে জটিলতার মুখে পড়ে থমকে যায় সেই উদ্যোগ। কর্তৃপক্ষ বলছে, ভবনটি ভেঙে নতুন করে বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ থাকলেও তা ছিল মৌখিক। এ নিয়ে লিখিত বা দালিলিক কোনও অগ্রগতি হয়নি। এছাড়া হ্যারিটেজ হিসেবে ভবনটির নাম উঠে এসেছে। এ অবস্থায় ভবনটি ভাঙার সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেন হ্যারিটেজ কর্মীরা। তারা বলছেন, এ ধরনের বাড়ি ভাঙার ওপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। প্রয়োজন হলে আলাদা করে রিট করা হবে।
জানা গেছে, প্রায় আড়াই একর জমির ওপর ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ঐতিহাসিক এই ভবনটি বর্তমানে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে কেউ ব্যবহার না করায় আরও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। পরিত্যক্ত ভবনটি বাইরে থেকে অনেকটা চাকচিক্যময় দেখা গেলেও ভেতরের পরিবেশ ভুতুড়ে। যে কারণে ভবনটি ভেঙে বিরোধীদলীয় নেতার জন্য একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণ করা হবে। পাশাপাশি মন্ত্রীদের থাকার জন্য সেই ভবন ঘেঁষেই বেশ কয়েকটি বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণের চিন্তাভাবনা করছে সরকার।
সরেজমিন দেখা গেছে, ২৯ মিন্টু রোডে অবস্থিত বাড়িটির চারদিকে দেয়াল ও লোহার গ্রিলে আবদ্ধ। বাড়িটির প্রধান ফটকে একটি সাধারণ তালা ঝুলছে। ভেতরে তিন জন কর্মী ঘাস কাটার কাজ করছেন। তারা দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে বাড়িটি পাহারার দায়িত্বে রয়েছেন। জানতে চাইলে তাদের একজন জানান, আমরা শুধু বাড়িটি দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছি। মাঠে ঘাস গজালে সেগুলো কেটে ছোট করি। এর বাইরে আরও কোনও দায়িত্ব আমাদের নেই। তারা জানান, বাড়িটিতে কেউ বসবাস করে না। ভেতরের পরিবেশ খুবেই খারাপ। দেয়ালগুলো স্যাঁতসেঁতে। এরইমধ্যে দেয়ালের প্লাস্টার খসে পড়ছে। বৃষ্টি হলে পানিও পড়ে এই বাড়িতে।
গণপূর্তের কর্মকর্তারা জানান, বাড়িটির বয়স প্রায় ১১৫ বছর। ১৯০৫ সালের দিকে কর্তাদের বসবাসের জন্য বাড়িটি নির্মাণ করে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। প্রায় ২ দশমিক ৫ একর জমিতে নির্মিত দোতলা মূল ভবনের প্রত্যেক তলায় চারটি করে মোট আটটি কক্ষ রয়েছে। শত বছরেরও বেশি সময় আগে নির্মিত ভবনটি দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারও করা হয়নি। ফলে দিন দিন বাড়িটি জরাজীর্ণ হয়ে ওঠে। এই বাড়িটির মতো ওই সড়কে আরও পাঁচটি বাড়ি রয়েছে। এরমধ্যে এই বাড়িটি বিরোধীদলীয় নেতার জন্য নির্দিষ্ট করা রয়েছে। যে কারণে এখানে অন্য কারও বসবাস বা বরাদ্দ নেওয়ার সুযোগ নেই। গত দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে বাড়িটিতে কোনও বিরোধীদলীয় নেতা ব্যবহার করেননি। যে কারণে এর রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা সংস্কারে গণপূর্তের কোনও বরাদ্দও ছিল না।
গণপূর্তের কর্মকর্তারা জানান, ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর প্রথম বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে মিন্টো রোডের এ বাড়িতে ওঠেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বিরোধীদলীয় নেতা হলেও তিনি সেই বাড়িতে উঠেননি। তবে এ বাড়িটিকে তিনি তার রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করতেন। এরপর ২০০১ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া থাকেন এরশাদের দেওয়া ক্যান্টনমেন্টের মঈনুল রোডের বাড়িতে। আর বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা ওঠেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ‘সুধা সদনে’। এরপর থেকে এই লাল বাড়িটি আর ব্যবহার হয়নি।
জানতে চাইলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদফতরের মন্ত্রীপাড়া এলাকার দায়িত্বে থাকা নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত উল্লাহ বলেন, ‘এই বাড়িটি বিরোধীদলীয় নেতার জন্য সংরক্ষিত। কিন্তু গত দুই যুগের বেশি সময় এতে কেউ বসবাস করছেন না। তাছাড়া বাড়িটির অনেক বয়স হয়েছে। যে কারণে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শুধু এই বড়িটি নয়, এমন আরও যত লাল রঙের বাড়ি আছে সব বাড়ি ভেঙে নতুন করে নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। স্থাপত্য অধিদফতরের সাবেক প্রধান স্থপতি কাজী গোলাম নাসির বাড়িটি ভেঙে নতুন করে নকশা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এজন্য তিনি একদিন সরেজমিন পরিদর্শনেও এসেছেন। তার পরিকল্পনায় ছিল বাড়িটি ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা। পাশাপাশি আশপাশের খালি জায়গায় আরও কয়েকটি বহুতল ভবন নির্মাণ করে সেগুলো মন্ত্রীদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া। এরমধ্যেই চলে আসে মহামারি করোনা। এরপর তিনি অবসরে চলে যান। বিষয়টি এখন ওই পর্যায়েই রয়েছে। বাড়িটির বিষয়ে নতুন কোনও নির্দেশনাও নেই। তবে এ নিয়ে লিখিত বা দালিলিক কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। আর হ্যারিটেজ সংক্রান্ত একটা জটিলতাও থাকতে পারে।’ জানা গেছে, ঐতিহ্যবাহী এই ভবনটি হ্যারিটেজ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আর হ্যারিটেজ ভবন ভাঙনে আদালতের নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। ২০০৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার চারটি অঞ্চলকে ঐতিহ্য বা হ্যারিটেজ হিসেবে ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এলাকাগুলো হচ্ছে- পুরান ঢাকার শাখারীবাজার, সূত্রাপুর, ফরাশগঞ্জ, রমনা। রমনা এলাকায় মিন্টু রোডের মন্ত্রীপাড়াও ছিল। ওই গেজেটে ৯৩টি স্থাপনা ও ১৩টি সড়ক ঐতিহ্যবাহী এলাকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ২০১৭ সালে এ তালিকায় হ্যারিটেজ হিসেবে ৭৫টিতে নামিয়ে আনা হয়। আর ১৩টি সড়ক ঐতিহ্যবাহী সড়ক থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
রাজউকের ওই তালিকাকে ত্রুটিপূর্ণ দাবি করে আরবান স্টাডি গ্রুপ ২০০৪ সালে ঢাকার প্রায় দুই হাজার ৭০০ ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার তালিকা তৈরি করে। এরমধ্যে গ্রেড-১ ও ২-এ দুই হাজার ২০০ ভবন রয়েছে। এই তালিকা রাজউক, সিটি করপোরেশন, প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরে জমা দিয়ে উপেক্ষিত হওয়ার পর ২০১২ সালে হ্যারিটেজ সংরক্ষণের দাবিতে উচ্চ আদালতে একটি রিট করে সংগঠনটি। এতে আদালত রায় দেন, কোন কোন ভবন ঐতিহ্যবাহী ও সংরক্ষণ করা প্রয়োজন তার তালিকা চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত আরবান স্টাডি গ্রুপের খসড়া তালিকাভুক্ত ভবনে কোনও পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করা যাবে না। তালিকাভুক্ত এসব বাড়ির ক্ষেত্রে কোনও বাড়ি বা স্থাপনা নির্মাণের নকশা অনুমোদন না দিতে রাজউককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তালিকাভুক্ত এসব বাড়ি যথাযথ হয়েছে কিনা, তা এক এক করে পরীক্ষার জন্য একটি উপদেষ্টা কমিটি করতে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ওই কমিটিকে কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদন তিন মাস পর পর আদালতে দাখিল করতে হবে। আরবান স্টাডি গ্রুপের ওই তালিকায় মিন্টু রোডের ২৯ নম্বর বাড়িটিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

জানতে চাইলে আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটি একটি ঐতিহ্যবাহী বাড়ি। কোনোভাবেই সরকার এই বাড়িটি ভাঙতে পারে না। এ ধরনের বাড়ির ওপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এটা ভাঙা হলে আইনবিরোধী কাজ হবে। আমরা একে ভাঙতে দেবো না। প্রয়োজনে এই বাড়ির জন্য আলাদা করে রিট করবো।’ তিনি আরও বলেন, ‘ব্রিটিশ পিরিয়ডের এই বাড়িটি ইতিহাসের অন্যতম অংশ। শুধু এই বাড়ি নয়, এমন শতবর্ষী আরও যেসব লাল বাড়ি রয়েছে সেগুলোও হ্যারিটেজের অংশ। সরকার কেন ঐতিহ্যকে ধ্বংস করতে এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তা আমাদের বোধগম্য নয়।’- বাংলা ট্রিবিউন




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com