বুধবার, ১৯ জুন ২০২৪, ০৭:৩৩ পূর্বাহ্ন

কবি জাকির আবু জাফর আধুনিক বাংলা কবিতার নবীন নায়ক

সাঈদ চৌধুরী
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২২

কবি ও সাহিত্যিক জাকির আবু জাফরের ৪৮তম জন্মদিন আজ।বাংলা কাব্য ভুবনে কবি জাকির আবু জাফরের আবির্ভাব নব্বই দশকে। সম্পূর্ণ আলাদা মেজাজ ও প্রসাদের কাব্য অভিজ্ঞান নিয়ে তিনি আমাদের সামনে হাজির হন। কবি হিসেবে তিনি যেমন খ্যাত, তেমনি চমৎকার গান লিখে নন্দিত গীতিকার হিসেবেও সমানভাবে জনপ্রিয়। উপন্যাস, থ্রিলার, প্রবন্ধ ও ছড়া সাহিত্যে অনবরত সাফল্য ও সম্ভাবনার তুর্য নিনাদ বাজিয়ে চলেছেন তিনি।
ফেলে আসা গ্রামের মেঠোপথ, আপনজনের মধুর স্মৃতি, সব কিছুকে পেছনে ঠেলে মানুষ যখন শহরমুখী। জীবনের তাগিদে কংক্রিটের দেয়ালে ঘেরা শহরে ছুটছে মানুষ। তখন জাকির আবু জাফর গ্রামের সবুজ-শ্যামলা গৃহে কাটান ঈদের ছুটি। ছুটে চলেন ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার দক্ষিণ পূর্ব চর চান্দিয়া গ্রামে। মমতার পরশ লাভে মা-বাবা আর দাদা-দাদির সান্নিধ্যে।
এমন একটা সময়ে জাকির আবু জাফর বিশ্বাসী কবিতায় ঝংকার তুলেন, যখন অন্য কবিরা সংশয়ী। পরলৌকিক বিষয় সমূহে অবিশ্বাসী হিসেবে তারা উন্নাসিকতা প্রদর্শন করছেন। অনেকেই পল্লী জীবন ছেড়ে নাগরিক কবি হবার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। আধুনিক কবি হিসেবে পরিচয় লাভের জন্য নগর কেন্দ্রিক জীবনকেই সাহিত্যের উপাদান হিসেবে বরণ করে নিচ্ছেন। পল্লীকে দেখছেন শহরের বাতায়নে উঁকি দিয়ে।
কবি জাকির আবু জাফরের কাছে এই পরিবর্তন একটি প্রহেলিকা মাত্র। কারণ এরা জানেনা যে, তাদের আরাধ্য নগরী কলকাতায় সংশয়বাদ অসুস্থতায় রূপ নিয়েছে। আর ইজারাদার ও রেভেন্যু সুপারভাইজারের অত্যাচারে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। বিক্ষুব্ধ বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, জীবন ফেনিল হয়ে উঠেছে শহরে – স্বার্থের আঘাতে, বিলাসিতার লাস্যে, দারিদ্র্রে ভয়াবহতায়, উপচে পড়ছে কূল ছাপিয়ে।
পল্লী জীবন ও চিরায়ত সমাজের গভীরতর মনন, আধুনিক জীবনবোধ ও নাগরিক জীবন জাকির আবু জাফরের কবিতার দ্যুতিতে ছড়িয়েছে নতুন বিভায়। গ্রাম বাংলার পথ-প্রান্তর, নদী-নালা, গাছ-পালা ও ধুলো-বালি আর নগর জীবনের হাসি-আনন্দ এবং ঘাত-অভিঘাতের মুখচ্ছবি অঙ্কিত হয়েছে তার কবিতায়।
স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও অপূর্ব ব্যঞ্জনা সমৃদ্ধ জাকির আবু জাফরের কবিতা
‘তুমি বাংলাদেশ’
আমার প্রিয়তমা শ্যামল সৌন্দর্যের চিরপল্লব
তোমার বুকের শিরাগুলোর দুরন্ত প্রবাহ আমার
পদ্মা মেঘনা যমুনার যৌবন
আমার হৃদয়পুরে বাজাও যে বাঁশির সুর
পৃথিবীর আর কোনো বাতাসের বুকে নেই
এমন সুরের মোহিনি
একটি কাঁঠাল চাঁপার পাঁপড়ি দেখে অভিভূত আমি
মনে হয় চাঁপার গন্ধের মতই তোমার শরীর
ডুবে আছে সৌরভের জলে
সে জল যখন ধুয়ে দেয় আমার শ্যামল শরীরের সব অঙ্গের বাঁক
নতুন ভোরের মতো আমি পৃথিবীকে দেখি পাখির চোখে
যেমন পাখির চোখ হয়ে ওঠে মহাশূন্যের বুক
তেমনি আমার চোখ হয়ে ওঠে তুমি বাংলাদেশ।
জাকির আবু জাফরের কবিতা অন্য কবিদের চেয়ে স্বতন্ত্র ও পূর্ণাবয়ব। রোমান্টিকতা ও ক্ল্যাসিকতায় কোন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেনি তার ‘গ্রামের কাছে চিঠি’
চিঠিটি আমার গ্রামের কাছেই লিখবো বলে সাব্যস্ত করেছি
এইতো কিছুদিন আগেও যেভাবে মায়েদের কাছে পত্র দিতো
প্রবাসী পুত্ররা
এখন চিঠির সময় নয় একথা আমিও জানি
এখন এসএমএস অথবা ব্লুটুথ কিংবা ভিডিও চ্যাটের
বিস্ময়কর গতির ইথারে ভাসছে আমাদের সমস্ত যৌবন
আমরা কেউই মুঠোফোন মুক্ত জীবন সঙ্গে রাখার কথা
ভাবতেও পারি না
হৃদপি- যেমন সেঁটে আছে আমাদের বুকের ভেতর
মুঠোফোনও তেমনি আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ
আমাদের প্রেম পিরিতি বিরহ বন্ধন যৌবন লীলা অথবা
বার্ধক্যের সহায়হনীতা সব সবকিছুই
ঢুকে গেছে মুঠোফোনের বুকের ভেতর
স্ত্রীর-সন্তানের ভালোবাসা থেকে প্রেমিকার মুখ সবকিছু
জেগে থাকে মুঠোফোনের হৃদয়াস্তিনে
জাগরণ থেকে ঘুমের ঘোর সর্বময় জীবনকে কিভাবে চেপে ধরে
আছে এই ক্ষুদে যন্ত্রটি
এই অভিজ্ঞতা থেকে মুক্ত নয় কেউ আজ
জীবন নাকি এই যন্ত্রটি বেশি প্রিয় জানি না সে কথা
কিন্তু এ যন্ত্র ব্যতিত কোনভাবেই ভাবছি না জীবনের কথা
মাঝে মাঝে দেখি জীবন বাদ রেখেও যন্ত্রটি যখন
কোনো তরুণ অথবা তরুণীর প্রিয় হয়
তখন জীবনের অন্য অর্থের সন্ধান করা অপরাধ হবে কেনো
আমার গ্রামের হাতে কি সক্রিয় আছে মুঠোফোনের মতো
কোনো সেনসেশন ডিভাইস
আছে কি মুহুর্তের সংলাপ করার মতো কোনো তড়িৎ তরঙ্গ
ব্লুটুথের বিস্ময় সম্পর্কে জানে কি আমাদের নিরীহ বৃক্ষরা
একটি সেলফির জন্য যেভাবে ডাগর হয়ে ওঠে তরুণীর চোখ
যেভাবে সমস্ত পৃথিবী পাশে ঠেলে জেগে ওঠে মোবাইলের বুক
তার খবর কি জানে আমাদের প্রতিবেশি পাখিরা
আমাদের ধানক্ষেতগুলো ফেইসবুক আজো কবুল করেনি
ফেইসবুক একাউণ্ট খোলেনি আমাদের মাঠ মাঠ শর্ষের প্রান্তর
আমাদের নদীরাও নয় ফেইসবুক জগতের নাগরিক
এদের কারোর নেই সেলফির সাধ
এরা নিজেরাই সেলফি হয়ে জাগ্রত আমাদের
পেমের পৃথিবীতে
এরা সকলেই প্রাচীন আনন্দের প্রতিনিধি
এই পন্থায় আমিও আমার গ্রামের কাছে
লিখতেই পারি একটি অনবদ্য চিঠি।
আত্মতৃপ্ত কবি জাকির আবু জাফরের পূর্ণতৃপ্ত উচ্চারণ
‘শব্দহীন শব্দের উৎসবে’
যা চাই তার চেয়ে ঢের বেশি চাই না আমি
চাই না এইসব মানুষের কাছে
পৃথিবীর উদ্বাস্তু নগরের কাছে
চেয়ে চেয়ে কেউ কেউ বনে গেছে ভিখারী বণিক
কেউ কেউ ধনবান কাঙাল
আবার কেউ ঢনাড্য ফকির
কেউ কেউ হয়ে যান সম্মানিত নির্লজ্জ
এভাবেই কেউ হন ক্ষমতাধর মিসকিন
শ্রেষ্ঠতর অর্জন তা-ই যার পেছনে নেই লোভের হাত
নেই কোনো লালসার জিব
কতই না আনন্দময় সময়ের সুখ স্পর্শ করে মন
না চেয়ে পাওয়ার গান আমাকে জোগায় বিরল সুর
সেই সুরের সৌরভে মুদ্রিত আমার হৃদয়ফুল
এ ফুলই আমার সুন্দরতম সময়ের নতুন প্রকাশ
আমার ভেতর যখন আমাকে খুঁজি
পাই এক স্বপ্নবাজ দুরন্ত কিশোরের মুখ
যার চোখের সান্নিধ্যে রচিত পৃথিবীর সমস্ত
বৃষ্টির মেঘ
অঝোর ধারায় শ্রাবণ রাত্রীর বিরামহীন বর্ষণে
হয়ে উঠি স্বচ্ছ আঁধারের ঝরনী
যেখানে বৃষ্টির বর্ষণ ব্যতীত আর কোনো শব্দের জন্মই হয় না
আজন্ম শব্দহীন শব্দের উৎসবে আমার বসতি
আমার নয়ন ভরে ছুটে যায় পৃথিবীর রোদের নদীরা
উষ্ণতার তপ্ত উৎস জুড়ে থাকে যার সুখ
মুহূর্তে হাঁপিয়ে ওঠে মানুষের ভেতর জগৎ
মানুষের হৃদয়গুলো পলাশাশ্রিত দুপুরের মতো জ্বলে
যেখানে জন্মায় একজন প্রখর গ্রীষ্মের মুখ
এভাবেই জীবন বৈচিত্র্যে জাগে মানুষেরা
এভাবেই জেগে থাকে সময় শাসিত মানুষ।
দাম্ভিক শাসকেরা ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর মোহে অন্ধ হয়ে মিথ্যার বেসাতি করে। ক্ষয?িষ্ণু দাম্ভিকতার পরিণতি সম্পর্কে কবি জাকির আবু জাফর বলেন-
মানুষেরা আকাশের দিকে হা-দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে চিরকাল
অথচ আকাশের মালিক হবার বাসনা করেনি কোনোদিন
দৃষ্টির অক্ষমতা ছাড়া আর কিছুইতো পৌঁছে না
আকাশের কাছে
বিস্মিত হৃদয়ের হাপর ছাড়া আর কি থাকে বুকের ভেতর
কখনো কখনো মানুষ আকাশের দিকে দীর্ঘ করে তাদের দুটি হাত
আকাশের অসীমতা নামে তাদের বুকের ভেতর
বিশ্বহীনতার ভেতর জাগ্রত যারা তাদের শূণ্যদৃষ্টি
শেষ পর্যন্ত নিজের দিকেই ফেরে
ভাবেনি তারাও যে আকাশ এসে যাক তাদের করতলে
পৃথিবীতে একবারই আকাশ অকিারের দুঃসংকল্পে মেতেছিলো
দাম্ভিক শাসক নমরূদ
ক্ষুধার্ত শকুনের পাখায় ভর করে দুঃস্বপ্ন যাত্রা ছিলো তার
মহাশূন্যের সীমাহীনতায় নমরূদ তার ক্ষমতার ক্ষুদ্রতাই
আবিষ্কার করেছিল সেদিন
দেখেছিলো পৃথিবীর ক্ষমতা কতটা অসহায় আকাশ ঐশর্যের কাছে
পৃথিবীর বাতাসেরা যদি মনুষ্য ক্ষমতার অধীন হতো
অথবা কারো হাতের মুঠোয় হতো রোদের উৎসমুখ
তাহলে কেউ কি বেঁচে যেতো জালিম শাসকদের
নৃশংস বিলাস থেকে
এভাবে বৃষ্টির কথাও যদি ধরি
অথবা ধরি ছায়ার প্রাণস্পর্শী শীতলের কথা
অথবা দিন রাত্রির বিবর্তনের রীতি ও রহস্যের কথা
এসবের নিয়ন্ত্রক যদি হতো কোনো মানুষের হাত
পৃথিবী কোনোভাবেই তার সবুজ চাঞ্চল্যে থাকতো না জেগে
মানুষ জানে না তার সক্ষমতার পরিধি
জানে না অক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতার সীমানা
তবুও খেলে দম্ভ ও দহনের আগুন জলের খেলা
এভাবেই মানুষ ডুবে থাকে তার ক্ষুদ্রতার ভেতর
এভাবেই মানুষ হয়ে ওঠে দু:সহ অমানুষ।
প্রচারিত দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক ব্যক্তি জীবনের জন্য ‘দ্বিচারী চরিত্র’ নিয়ে কবি জাকির আবু জাফর লিখেন-
যাকে ঘৃণা করি যাকে ভাবি অসভ্যতা
তাকেও জানি নিরন্তর ভদ্রতার সম্ভাষণ
তাকেও বসার আমন্ত্রণ করি নির্বিশেষে
তাকেও বলি-আপনার গুণের প্রশংসার
ভাষা জানা নেই আমার
আপনার জগতে আপনিই সেরাদের সেরা
এভাবে আমরা সকলেই দ্বি-চারী মহান
অথবা কপটতার অবিস্মরনীয় নায়ক
ভেতরে এক বাইরে সম্পূর্ণ অন্য মানুষ
কারো কারো মুখের বচন মিথ্যের বেসাতি
জেনেও মূক হয়ে থাকি
আপনি একজন মিথ্যুক একথা বলার সাহস কোথায়!
অথবা আপনি খ্যাতির কাঙ্গাল
কিংবা রুচিহীনতাই বর্বর করেছে আপনাকে
না এসব কিছুই বলার হিম্মত নেই কোনো সুশীলের
ফলে অন্ধকার লালন করা ছাড়া উপায় কি!
পরচর্চ্চার মত পুতিময় দহনের দেশে জেগে থাকে মানুষ
এখানে সবাই পরশ্রিকাতর
সবাই হিংসানলের মূর্তি
নিজের মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস কারো নেই।
ঐতিহ্য চেতনাকে উজ্জীবিত করার প্রয়াসে কবি কণ্ঠে ধ্বনিত হয়
‘আরো একটি সকালের আয়োজন’
হোক না আরো একটি সমূহ সকালের আয়োজন
আরো একটি রৌদ্রময় শিশিরের মৌসুম
কেবল কোমল কেবল আরাম কেবল আনন্দের
বিপুল বিস্ময়ে উদ্বোধিত কোনো ক্ষণের নিয়তি
হোক হোক আরো কোনো সন্ধ্যার আকাশ নির্মিত
হোক রাত্রির রহস্যে রোপিত কোনো নক্ষত্র উদ্যান
যেখানে জাগ্রত থাকে আলোর নদীরা
তুমি সেই নদীর কোনো হৃদয় থেকে
বেছে নাও স্বপ্নের জল
যা দিয়ে ধুয়ে দিতে পারো মনোবৃক্ষের
সমস্ত পাতার শরীর
জগতের জন্য হয়ে যাও এক আশ্চর্য উপমা
যাকে ঠোঁটে করে ফিরবে পৃথিবীর সমস্ত পাখিরা
যে বাতাস ভেঙে যায় পাখির পাখা
তাকে পুরে দাও কবিতার হৃদয়ে
তোমার কবিতা হয়ে ওঠুক মহাশূন্যের সঙ্গী
শূন্যতাকে যেমন সকলেই দেখে
তোমাকেও তেমন করে দেখুক সবাই
বলুক তুমিও শিল্পী কবিতাপৃথিবীর।
স্মৃতিকাতরতা সকল কবিদের মধ্যে বহমান। কবি জাকির আবু জাফরের স্মৃতি পুষ্পমঞ্জরীর মতো।
‘স্মৃতির আয়নাঘর’ কবিতায় তিনি লিখেন-
সবার বুকে স্মৃতির গোলা থাকে
গোপন স্মৃতি হঠাৎ পিছু ডাকে
স্মৃতির ডাকে আনমনা হয় সব
বুকের ভেতর স্মৃতির কলরব
কোথায় কখন কি ঝরেছে তার
ফেলে আসা দিনটি চমৎকার
মনের ভেতর ফোটে সেসব দিন
স্মৃতি আরো বাড়ায় অতীত ঋণ
একলা হলেই জাগে স্মৃতির হাত
ঘুম তাড়িয়ে খেলে সারারাত
কিংবা দুপুর কিংবা বিকেল ভর
মন হয়ে যায় স্মৃতির আয়নাঘর
অতীত তখন ঘোরের মায়াজাল
আজ হয়ে যায় স্মৃতির গতকাল
স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ কবি কবি জাকির আবু জাফর ঐতিহ্য পুনঃনির্মাণ প্রয়াসে এক সাহসী যোদ্ধার মত কাব্য রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ‘জাফলং নদীর জলে’ কবিতায় তিনি লিখেন-
নদীটির নাম আপাতত: থাক
জাফলং নামেই তাকে ডাকি
কেননা আমরা জাফলং এর যৌবন দেখার আনন্দ
নিয়েই এলাম এখানে
জাফলং এর বুকের ভেতর শুয়ে আছে নদীটি
আমরাও বুকে নিলাম তাকে নিলাম তার শীতল অথচ নিরীহ জলের সুরভী
পাহাড়ের পাঁজর থেকে নদীটি উঠে এলো আমাদের বুকের ভেতর
নদীর হৃদয়ে আকাশের একান্ত বিশ্রামের আয়োজন দেখে
আমরা অবাক
পাথরে পাথরে ভরা নদীর হৃদয় অথচ শীতল কোমল
প্রাণ ছুঁয়ে ছুঁয়ে ছুটছে জলের বিতান
পানির শরীরে কিছুটা বরফ মেশানোর মতো আরাম অথচ বহমান
পৃথিবীর সব দগ্ধতা এখানে শীতল হতেই আসে
আমরাও আপ্লুত শীতল আনন্দে
আমাদের সাথী নিঝুম দুপুর এবং দুপুরের ঘনঘনে সূর্যটি
সূর্যও ভিজিয়ে নিলো নিজের শরীর

নদীটি নির্ভার। দেখে মনে হলো তার কোনো বেদনা নেই
বিদ্রোহ নেই
শুধু বিরহের জ্বলার মতো মৌনতা বিছানো তার বুক
পাহাড়কে নিতম্ব ছুঁয়ে নদীটি চলে গেছে অচিন পথে
এ পাহাড়েই ঠেকেছে আমাদের স্বাধীনতার সীমানা
এখানে কাঁটাতার এবং নৃশংস চোখের পাহারা
অপেক্ষায় থাকে মৃত্যুর বুলেট
একটি গাঙপাখি উড়ে গেলো পাহাড়ের দিকে
পাখিটি আমার নদীতেই শরীর ধুয়ে স্বচ্ছ করেছে নিজেকে
কী অনায়াসে কাঁটাতার পেরিয়ে পাখিটি
চলে গেলো এক ভূগোল থেকে আরেক ভূগোলে
পাখিদের কোনো ভিসা নেই
কেন তবে মানুষের তরে এত কাঁটাতার
বাংলা কাব্যে জাকির আবু জাফরের বিশেষ দান হল স্বদেশ প্রেমের উত্তেজনা সঞ্চার। তিনি এই প্রজন্মের দেশপ্রেমিক কবি হিসেবেই খ্যাত। ‘অত:পর বাংলাদেশ’ কবিতায় লিখেন-
তুমিও জানতে এই পথে একদিন নেমে আসবে
সূর্যের লোহিত উচ্চারণ
অগুনতি নক্ষত্রের অজস্র রূপালি আগুন
এবং পাখিদের কলগুঞ্জনে নিমগ্ন এক সংগীত সন্ধ্যা

মেঘের ওপর আমাদের স্বপ্নের রঙ ছিটিয়ে দিলে
গোটা আকাশ হয়ে যাবে আমাদের স্বাধীনতার পতাকা
অত:পর গ্রহলোকে ছায়াপথে বেড়ে উঠবে
দোআঁশ মাটির গন্ধ
বাতাসের পাপড়িতে উড়বে আমার ধানের সুবাস
পৃথিবীর বুকে বুকে বাঙময় হবে পদ্মকুড়ির দিন

আমাদের স্বপ্নের ভেতর বেজে উঠলো সেই অহংকার
সেই অনবদ্য রক্তিম সময়ের বিস্ফোরণ
পৃথিবীর মানচিত্রে মুখরিত হলো অজস্র নদীর গুঞ্জন
একটি চির শ্যামল শিহরণ
প্রকৃতির সমস্ত সবুজ বেটে
মেখে নিলাম আমাদের পতাকায়
অত:পর একটি রক্তিম সূর্য উড়িয়ে
নাম লিখে দিলাম বাংলাদেশ
জাকির আবু জাফরের কবিতা যেন বাংলাদেশের চিরচেনা সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি। এই কবিতাগুলো পাঠ করলে তার নিজস্ব রচনা কৌশলই পরিস্ফুট হবে। বিমূর্ত ছন্দ প্রকরণে, উপমা উৎপ্রেক্ষায় যে কোনো পাঠক মুগ্ধতায় বিভোর হবেন। সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সংকোচ ও অসুন্দরকে ঠেলে সুন্দরের জয়গানে মুখরিত জাকির আবু জাফর সাহিত্যাঙ্গনে উদ্ভাসিত করে রেখেছেন নিজেকে। জাগিয়ে রেখেছেন ভালোবাসার ভেতর। অল্প বয়সে এত খ্যাতি ঈর্ষা করার মতো। কবিতা, ছড়া, কিশোর কবিতা, উপন্যাস গল্প ও গীতিকবিতা মিলে জাকির আবু জাফরের বইয়ের সংখ্যা ৩৭। প্রায় প্রতিটি বই-ই পাঠক নন্দিত। বর্তমানে জাতীয় দৈনিক নয়াদিগন্ত পএিকায় সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
প্রকাশিত কবিতা গ্রন্থ: ব্যক্তিগত জোছনার বিজ্ঞাপন, মেঘের মানচিত্র অথবা বনান্তরের দিন, অজস্র বর্ষণে চিরদিন, তোমার সমস্ত গোপন, রোদেরও আছে অন্ধকার, তোমাকে ভিজিয়ে দেবো চাঁদের বৃষ্টিতে, রাত ও রৌদ্র, বৃষ্টির বৃত্তান্ত শোনে রাতের আকাশ, মুখোমুখি আজীবন, নন্দিত বেদনা, কালের সমুদ্র, নির্বাচিত কবিতা, প্রকৃতি ও প্রেমের কবিতা, নির্বাচিত ১০০ কবিতা, বাছাই কবিতা। ১৯৭১ সালের পহেলা জুলাই কবি জাকির আবু জাফর ফেনীর সোনাগাজীর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকপ্রশাসনে অনার্স ও মাস্টার্স। সদালাপী ও বাগ্মি এই কবি দারুন আত্মবিশ্বাসী। নিজের পথ নিজেই রচনা করেন ক্রমাগত। তার কবিতায় নিজস্ব বোধ-বিশ্বাস, ঐতিহ্য, প্রকৃতি ও নর-নারীর জটিল রহস্য উন্মোচন, সর্বোপরি দেশ প্রেমের প্রগাঢ় উচ্চারণ ধ্বনিত। প্রায় তিন দশক ধরেই তিনি একের পর এক কবিতার সোনালী ফসল আমাদের উপহার দিচ্ছেন। তার অমীয় কবিতার পাতা দেশাত্ববোধে ভরপুর। জীবনকে জীবনের সাথে এবং স্বপ্নকে স্বপ্নের সাথে মিলিয়ে দেবার এক অভিভূত আকর্ষণে জাকির আবু জাফরের কবিতা ঋদ্ধ।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com