শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪, ১০:৫৭ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::

কবি তালিম হোসেন ও তাঁর কাব্যভাবনা

আবদুল হালীম খাঁ
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২২

॥ এক ॥
এক সময় তিন ‘আইল’ এর এক আইল এর কবি বলে তালিম হোসেনকে বামপন্থী লেখকরা ঠাট্টা-মন্তব্য করতেন। বলতেন, আজকাল কাব্য সাহিত্য চর্চা হচ্ছে তিন আইলের মধ্যে, অথবা বলতেন, আজকাল কাব্যসাহিত্য তিন আইলের ভেতরে আটকা পড়ে গেছে। তিন আইল বলতে তারা তিনজন কবিকে বুঝাতেন। তারা বলেন, যশোর জেলার মাঝআইল গ্রামের কবি ফররুখ আহমদ, টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল গ্রামের কবি মুফাখখারুল ইসলাম এবং নওগাঁ জেলার চাকরাইল গ্রামের কবি তালিম হোসেন। এই তিন কবির কবিতা তারা পত্র-পত্রিকায় দেখলে বা রেডিওতে কোনো অনুষ্ঠানে তাদের নাম শুনলেই সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠতেন, চায়ের কাপে ঝড় তুলতেন। উল্লেখ্য, এই তিন কবি পঞ্চাশ দশকে কাব্য সাহিত্য ক্ষেত্রে খুবই উজ্জ্বল এবং সরব ছিলেন। তারা কবিতায় মুসলিম জাতির আদর্শ এবং ঐতিহ্য রূপায়ণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কবি তালিম হোসেন ১৯১৮ সালে নওগাঁ জেলার চাকরাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় হাইস্কুল থেকে মাট্রিক পাস করে তিনি রাজশাহী কলেজে আই.এ ভর্তি হন। এ সময়ে সে কলেজের এক অনুষ্ঠানে করটিয়া সা’দত কলেজের প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ প্রধান অতিথি হিসাবে গিয়ে ছাত্রদেরকে লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাব্য সাহিত্য চর্চায় উৎসাহ দেন। তালিম হোসেন তার আলোচনা শুনে মুগ্ধ হন এবং রাজশাহী কলেজ ছেড়ে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর সঙ্গে এসে করটিয়া সা’দত কলেজে আইএ দ্বিতীয় বর্ষে (১৯৩৯-১৯৪০) ভর্তি হন।
সা’দত কলেজে কবি তালিম হোসেনের রয়েছে এক অম্ল-মধুর স্মৃতি। কলেজে তখন ছিল কাব্য সাহিত্য চর্চার মনোরম পরিবেশ। বিকেলে মহুয়া গাছের নিচে বসতো মহুয়া সাহিত্য মজলিশ। ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকদের মধ্যেও কেউ কেউ পাঠ করতেন স্বরচিত কবিতা। প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ সবাইকে উৎসাহ ও দিকনির্দেশনা দিতেন। কাব্যচর্চার চমৎকার পরিবেশ পেয়ে তালিম হোসেন হয়ে গেলেন একেবারে আত্মভোলা। দিন-রাত কাব্যচর্চা আর গান গেয়ে কাটাতে লাগলেন। স্বভাব প্রকৃতি, চলাফেরা, আচার-আখলাকে পুরেপুরি কবি। অল্প সময়ের মধ্যে কবিতা ও গানে করটিয়া মাতিয়ে তুললেন। হারমোনিয়াম হাতের কাছেই থাকতো। অধিকাংশ সময় নজরুলের গান এবং মাঝে মাঝে নিজের রচিত গান গাইতেন। কলেজ ম্যাগাজিনে ঝঃড়হব ভষড়বিৎ নামে একটি ইধষষধফ জাতীয় ইংরেজি কবিতা ও ‘অশক্ত প্রার্থনা’ আরেকটি চমৎকার কবিতা সেবার (১৯৩৯-৪০) প্রকাশ পায়। এ কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় তার উৎসাহে বান ডাকে। দিনরাত চলতে ফিরতে খাইতে নাইতে তার মুখ থেকে ঝরতে থাকে কবিতা আর গান।
আই,এ দ্বিতীয় বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষা।
লজিক পরীক্ষার প্রশ্ন খুব সহজ হয়েছে বলে পরীক্ষার হলে রোল ওঠে। কিন্তু তালিম হোসেনের তাতে লাভ কি? তার কাছে সহজ আর কঠিন এক সমান। কারণ সারা বছর তিনি তো বইয়ের পাতা উল্টিয়ে দেখেননি, কবিতা রচনা আর গান গেয়েই কাটিয়েছেন। তিনি পরীক্ষার খাতায় খুব সুন্দর করে একটি বেল সমতে বেলগাছ আঁকলেন। তারপর একটি কাক এঁকে দিলেন বেলের সামনে। নিচে লিখে দিলেন- ‘বেল পাকলে কাকের কী?’ অর্থাৎ পরীক্ষার প্রশ্ন যতই সহজ হোক তাতে তালিম হোসেনের লাভ কী?
কবি তালিম হোসেনের স্মৃতিশক্তি খুবই প্রখর। কিন্তু তিনি পাঠ্যবাই খুলে দেখতেন না। কেবল গান আর কবিতা নিয়েই সময় কাটাতেন। পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো। তিনি ফেল করলেন। তালিম হোসেনের সহপাঠী বন্ধু ছিলেন মোকছেদ আলী। তিনি খুব দুঃখিত হলেন এবং কবিকে লেখাপড়ায় মনোযোগী হতে পরামর্শ দিলেন। কবি কারো কোনো কথাই শুনলেন না। চলে এলেন ঢাকা। আসার সময় মোকছেদ আলীর হাতে এক টুকরো কাগজ গুঁজে দিয়ে বললেন, পরে পড়ে দ্যাখো। তালিম হোসেন চিরকুটে লিখেছিলেন:
ভাই মোকছেদ,
তুমি আমাকে ভালোবাসো। এ জন্যে আমাকে নিয়ে চিন্তা করছো। পড়ায় অমনোযোগী দেখে ব্যথা পেয়েছো। আমার জন্যে তোমার এ ভালোবাসা আমাকে যেমন ব্যথিত করেছে, তেমনি আনন্দ লাগছে এ জন্যে যে, আমাকে কেউ ভালোবাসে, ভাবে। আমি কারো ভাবনার বিষয় হতে পেরেছি। তোমার এ ভালোবাসার ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারবো না। দোআ করো ভাই, তোমার মত ভালো ছাত্র হতে না পারলেও জীবনে ভালো মানুষ যেনো হতে পারি।
চির তোমার
তালিম হোসেন।
তালিম হোসেন সেই যে করটিয়া থেকে চলে গেলেন তার আর না পাওয়া গেল ঠিকানা এবং খোঁজ-খবর।
॥ দুই ॥
কবি তালিম হোসেন কবিতা লেখা শুরু করেন চল্লিশের দশক থেকে। সে হিসাবে তাকে চল্লিশের কবি ধরা যায়। যদিও তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরুয়েছে অনেক পরে পঞ্চাশের দশকে। দীর্ঘকাল যাবত কবিতা লিখলেও তার কবিতা এবং কবিতা গ্রন্থের সংখ্যা অনেকের তুলনায় খুবই কম। তার কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে, দিশারী (১৯৫৬), শাহীন (১৯৬২), ইসলামী কবিতা (১৯৮১) এবং নূহের জাহাজ (১৯৮৪)। ইসলামী কবিতা গ্রন্থটি আসলে সংগ্রহ, পূর্ব কিছু কবিতার সঙ্গে নতুন কিছু কবিতা সংযোজন করা হয়েছে। এসবের বাইরে অবশ্য তার আরো অনেক কবিতা পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে রয়েছে।
চল্লিশের কবিদের প্রধান লক্ষণ সমাজ ও রাজনৈতিক চেতনা। তালিম হোসেনের কবিতার কেন্দ্রীয় লক্ষণ তাই। তবে সামান্য একটু পার্থক্য আছে। অন্যদের বাস্তববোধ একটু বেশি, তার মধ্যে আদর্শবাদ প্রধান এবং প্রবল। চল্লিশের দশকে এই দেশ ছিল উত্তাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা এবং দেশ বিভাগের আন্দেলন। কবি যেহেতু প্রত্যক্ষ বাস্তবতা নিয়ে কাজ করেন না, কাজ করেন প্রতিফলিত বাস্তবতা নিয়ে। তাই তার কবিতায় স্বপ্নের অঙ্কন থাকে। সমাজ ও রাজনীতি সচেতন চল্লিশের কবিদের চোখেও স্বপ্ন লেগেছিল। যে স্বপ্ন চিরকাল কবিরা দেখে থাকেন।
বাঙালি মুসলমান কবিদের মধ্যে ফররুখ আহমদ, সানাউল হক, আহসান হাবীব, গোলাম কুদ্দুস এই সময় জাগরণমূলক কবিতা লিখেছেন আরো অনেকের সঙ্গে। বাঙালি কবিদের একাংশ একটি স্বতন্ত্র জাতি সত্ত্বায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। তাদের প্রধান মুখপাত্র ফররুখ আহমদ এবং তালিম হোসেন। কবি তালিম হোসেনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ দিশারীর ২৯টি কবিতায় আলেখ্য অঙ্কিত হয়েছে।
দ্বিতীয় কবিতা গ্রন্থ শাহীন-এ কবির দৃষ্টি প্রসারের পরিচয় চিহ্নিত। রাষ্ট্রখ- ইসলামই এখানে বিষয়বস্তু নয়, নানা বিষয় কবি-চৈতন্যে প্রবেশ করেছে। আছে সুর স¤্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁকে উৎসৃষ্ট ‘আরাপ’ নামে কবিতা, যেখানে কবিতাকে একটি গানের মত অস্থায়ী-অন্তরা-সঞ্চারী-আভোগ এই চারটি অক্ষরবৃত্ত ও ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্তি একটি সঙ্গীতালেখ্যের মত ব্যবহৃত। সনেট শীর্ষক সাতটি সনেট পরম্পরা উজ্জ্বলতর কবিতা : আতীব্র প্রেমের এ রকম গাঢ়বন্ধ কবিতা তালিম হোসেন লিখেননি আর। এই সপ্তপদী সনেট-পরম্পরা তালিম হোসেনের কবিতার শ্রেষ্ঠাংশে তার আদর্শ ও বিশ্বাসকে এক পাশে সরিয়ে রেখে এখানে কবিরাই বিজয় পতাকা আকাশে উড্ডীন।
শেষ কবিতাগ্রন্থ নূহের জাহাজ-এ ১৯৪৮-৮৩ এই দীর্ঘ সময়ের কবিতা সংবলিত। তার শেষদিককার কবিতায় মেদুর বেদনাময় সহজ সুশান্তি দেখা দিয়েছে। আদর্শিক কবিদের ক্ষেত্রে এমন হয় অনেক সময়। আসলে এ বইয়ে তালিম হোসেন অনেকখানে ব্যক্তিগত। রচনাভঙ্গিতেও তালিম হোসেনের স্বভাবী, খানিকটা সুধীন্দ্রীয় গাম্ভীর্য, খসে গিয়ে মৃদু বিষন্ন আনন্দিত ব্যক্তিগত চাল দেখা দিয়েছে। ফররুখ আহমদ ও তালিম হোসেনের মধ্যে মিল আছে অনেক বিষয়ে। কিন্তু তাদের পার্থক্যও আছে। বস্তুত তালিম হোসেন কখনোই নন ফররুখ আহমদের অনুসারী বা অনুকারী। ফররুখের কবিতা তালিম হোসেনের কবিতার চেয়ে অনেক বেশি রোমান্টিক, স্বপ্নময়, অলঙ্কারমুখর, প্রতীকী ও ধ্বনিত-রণিত। তালিম হোসেন তুলনামূলকভাবে অক্ষরবৃত্তে ও ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্তে সুপ্রকাশিত। গদ্য কবিতায়ও তিনি লিখেছেন চল্লিশের আরো অনেক কবির মত, কিন্তু ছোট গদ্য কবিতাতেই তাকে সফল মনে হয়।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com