বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০৮:২১ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
কয়রায় সড়কের কাজ ফেলে ঠিকাদার লাপাত্তা, জনদুর্ভোগ চরমে ধনবাড়ীতে বিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ঢেঁকি মৌলভীবাজার জেলার ৫ উপজেলা ও ৫ পৌর শাখা বিএনপির আহবায়ক কমিটি অনুমোদন নড়াইলে তারুণ্যের উৎসবে বালক-বালিকাদের সাইক্লিং প্রতিযোগিতা লোহাগাড়া প্রেসক্লাবের উদ্যােগে পত্রিকার হকার ও অসহায়দের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ কালকিনিতে জাতীয় গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট অনুর্ধ্ব ১৭ এর ফাইনাল ম্যাচ নবাগত নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াজেদকে ফুলেল শুভেচছা মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান শ্রীমঙ্গলে কৃষি জমি থেকে মাটি কাটার অপরাধে লাখ টাকা জরিমানা শিক্ষকের দুর্ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং সাবেক এমপি’র তারাকান্দায় তারুণ্যের ভাবনায় আগামীর বাংলাদেশ শীর্ষক কর্মশালা

আবহাওয়ার সঠিক পূর্বাভাস বদলে দিতে পারে কৃষকের জীবন

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১ নভেম্বর, ২০২২

বরিশালের হিজলা উপজেলার দেলোয়ার হোসেন গত বছর এক বিঘা জমিতে গমের চাষ করেছিলেন। কিন্তু যখন ফসল আসতে শুরু করেছিল, তখন এক দিনের হঠাৎ বৃষ্টিতে সব চারা মরে গেছে। তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘এই সময় তো বৃষ্টি হবে, ভাবি নাই। তাহলে তো গমই লাগাইতাম না।’ কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে দেশের আবহাওয়ায়ও পরিবর্তন হয়েছে। ফলে এত দিন যেভাবে কৃষকরা অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে ফসলের চাষাবাদ করতেন, এখন মারাত্মক আবহাওয়ায় অনেক সময় তারা ক্ষতির শিকার হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আবহাওয়ার আগাম পূর্বাভাসের ভিত্তিতে চাষাবাদ করা গেলে দেশের ফসলের উৎপাদন অন্তত সাত শতাংশ বৃদ্ধি আর কৃষকের আয় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব। প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে কৃষিকাজে ব্যাপকভাবে আবহাওয়ার তথ্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে কী অবস্থা?

আবহাওয়া তথ্য দিতে কী করছে কর্তৃপক্ষ?
ভারতে ১৯৪৫ সাল থেকেই কৃষিকাজে আবহাওয়ার পূর্বাভাস ব্যবহার শুরু হয়েছে। এখন তাদের অনেক প্রদেশেই এসব পূর্বাভাস কাজে লাগিয়ে কৃষকরা চাষাবাদ করছেন। কিন্তু বাংলাদেশে পাঁচ বছর আগেও কৃষি কাজে আবহাওয়া তথ্যের খুব একটা ব্যবহার শুরু হয়নি। সরকারিভাবেও যেমন এ নিয়ে উদ্যোগ ছিল না, কৃষকদের মধ্যেও খুব একটা সচেতনতা তৈরি হয়নি। বাংলাদেশের ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের ‘ইন্টিগ্রেটেড রাইস অ্যাডভাইজরি সিস্টেমস’ নামের একটি প্রকল্পে ধান চাষে আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। তাদের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের মাত্র পাঁচ শতাংশ ধানচাষি আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিয়ে ধান চাষ করছেন। কিন্তু প্রায় ৯৫ শতাংশ ধানচাষি এর বাইরে রয়ে গেছেন।
ব্রি অ্যাগ্রোমেট ল্যাবের কো-অর্ডিনেটর নিয়াজ মোহাম্মদ ফারহাত রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিয়ে চাষাবাদ করলে শস্য উৎপাদন সাত দশমিক তিন শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। এতে উৎপাদন খরচ প্রায় ১৫ শতাংশ কমে যাবে এবং কৃষকের আয় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব।’ গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, বাংলাদেশের কৃষকেরা আবহাওয়ার পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে তেমন সচেতন নন। এখনো তারা কৃষিকাজের জন্য স্থানীয় রীতি ও ধারণার ওপর নির্ভর করেন। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় আবহাওয়া অধিদফতর, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সমন্বয়ে একটি প্রকল্প নেয়া হয়। আগামী বছরের জুন পর্যন্ত এই প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে। প্রকল্পটি আবহাওয়া ও নদ-নদীর অবস্থার তথ্য কৃষকের কাছে পৌঁছানো ও সেগুলো ব্যবহারের সক্ষমতা তৈরি করার জন্য নেয়া হয়েছিল। এসব তথ্য ব্যবহার করে সময়মতো ফসল লাগানো, উৎপাদন খরচ কমানো আর নিরাপদে ফসল কর্তনের ওপর জোর দেয়া হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক ড. মোহাম্মদ শাহ কামাল খান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘এখন আমরা সপ্তাহে দু’দিন ৬৪ জেলার জন্য এবং এক দিন জাতীয় পর্যায়ে আবহাওয়া বুলেটিন দিচ্ছি। স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তা, মোবাইলের ম্যাসেজ ও ভয়েজ ম্যাসেজের মাধ্যমে এসব বার্তা কৃষকদের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে।’ এসব তথ্যের মধ্যে আগের চার দিনের আবহাওয়ার তথ্যসহ পরবর্তী পাঁচ দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়া হয়। তার মধ্যে বৃষ্টিপাত, আপেক্ষিক আর্দ্রতা, বাতাসের গতি ইত্যাদির তথ্য থাকে। যদিও বিবিসি বাংলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এই প্রকল্পের আওতায় প্রথমে অ্যানালগ পদ্ধতিতে তথ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করা হলেও সেটি খুব একটা কাজ করে না। কারণ সেখানে নিয়মিতভাবে তথ্য আপডেট করা হয় না। এমনকি মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এই বিষয়ে খুব একটা জানাশোনাও নেই।
এখন তারা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কৃষকের কাছে এসব তথ্য পৌঁছানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। সেই সাথে বিভিন্ন কৃষক গ্রুপ থেকে কৃষক প্রতিনিধির নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর নিয়ে ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। এই কৃষক প্রতিনিধিদের আবহাওয়ার তথ্য জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে অন্য কৃষকরা তথ্য পাচ্ছেন।
কৃষকরা কতটা ব্যবহার করছেন আবহাওয়ার তথ্য?
মাঠ পর্যায়ে কৃষক, কৃষি তথ্য কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে দেখা গেছে, এখনো বেশিরভাগ কৃষক আবহাওয়ার তথ্য নিয়মিতভাবে পান না। আবার অনেক কৃষকের এ নিয়ে কোনো আগ্রহও দেখা যায়নি। রাজবাড়ীর কৃষক হারুন-উর রশিদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ঋতু বা মাস দেখে তিনি ফসলের চাষাবাদ করেন, এজন্য যে আবহাওয়ার তথ্য নিতে হয়, এমনটা শোনেননি। তিনি বলেন,’ছোটবেলা থেকেই জানি, এই মাসে বৃষ্টি হইবে, এই মাসে শীত। গরমের সময় গরমের ফসল, শীতের সময় সরিষা বা শাকসবজি লাগাই। তয় এই বছর বৃষ্টি কম হয়ে পাটেতে মাইর খাইছি, ঠিকমতো শুকাইতে পারি নাই।’ আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বৃষ্টি কম হবে, এই পূর্বাভাস আগে থেকে জানতে পারলে হয়তো হারুন-উর রশীদের মতো অনেক কৃষক ক্ষতির মুখোমুখি হতেন না। বাংলাদেশে আনুমানিক এক কোটি ৬৫ লাখ থেকে দুই কোটি কৃষক রয়েছে বলে গবেষকরা ধারণা করেন। নিয়াজ মোহাম্মদ ফরহাত রহমান জানিয়েছেন, তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, এখনো কৃষকরা আবহাওয়ার ব্যাপারে অনেকটা চোখ বন্ধ রেখে চাষাবাদ করেন। অনেকের ধারণা রয়েছে, আবহাওয়ার তথ্য নিয়ে কৃষিকাজে তেমন কী লাভ হবে?
মানিকগঞ্জে প্রাকৃতিক কৃষি চাষাবাদ নিয়ে কাজ করেন দেলোয়ার হোসেন।
প্রাকৃতিক কৃষি কেন্দ্রের এই সংগঠক বলছিলেন, ‘সরকারিভাবে যে কৃষি-তথ্য দেয়া হয়, সেটা এখনো গ্রামের কৃষকদের কাছে ঠিকমতো পৌঁছায় না। যদিও তাদের মধ্যে আবহাওয়া বিষয়ে দশ বছর আগের তুলনায় সচেতনতা বেড়েছে। আবহাওয়া তথ্যের জন্য তারা ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমের ওপর বেশি নির্ভর করছেন।’ তিনি বলেন, ‘আমার কাছে অনেক সময় কৃষকরা জানতে চান, বৃষ্টি হবে কিনা, এখন এই ফসল রোপণ করা ঠিক হবে কিনা ইত্যাদি। তবে এজন্য সঠিক তথ্য তারা ঠিকমতো পায় না। সরকারিভাবে যে তথ্য দেয়া হয়, সেটা তৃণমূলের কৃষকদের কাছে পৌঁছায় না। কোথায় কোন ওয়েবসাইটে তথ্য রয়েছে, সেটা ঠিকভাবে তাদের পক্ষে খুঁজে বের করাও সম্ভব না। এতো বেশি মানুষের কাছে এই তথ্য পৌঁছানোর মতো সক্ষমতা এখনো তাদের নেই।’
পূর্বাভাস নিয়ে যে সমস্যায় পড়েন কৃষক
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সিত্রাং ঘূর্ণিঝড়ের সময় দক্ষিণাঞ্চলের যে জেলাগুলোয় ঝড় আঘাত হানার সম্ভাবনা ছিল, সেখানে ৮০ শতাংশ পেকে যাওয়া ধান কেটে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছিল কৃষি বিভাগ। তাতে অনেক কৃষক লাভবান হয়েছে। আবার অতিবৃষ্টির বিষয়ে সঠিক পূর্বাভাস দিতে না পারায় অনেক মাছের ঘের পানিতে ডুবে মাছ ভেসে গেছে। কৃষিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে বর্তমানে যে সাত দিনের পূর্বাভাস দেয়া হয়, তার মধ্যে প্রথম তিন দিন ৭০ শতাংশ নির্ভুলতা দেখা যায়। পরের দুই দিনে সেটির হার দাঁড়ায় ৬৫ শতাংশে। সেই দুই দিন এই পূর্বাভাসের সফলতা অনেকটা কমে আসে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক পারভেজ আনোয়ার বিবিসি বাংলাকে বলছেন, মাঠ পর্যায়ে বন্যা বা ঝড়ের মতো ক্ষেত্রে পূর্বাভাস ছাড়া হঠাৎ বৃষ্টি, মেঘলা আবহাওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে এখনো খুব বেশি পূর্বাভাস পাওয়া যায় না।
তিনি বলেন, কিন্তু যদি দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস পাওয়া যেতো যে, এই বছর খরা হবে অথবা বৃষ্টি বেশি হবে, সেটা বুঝে কৃষক চাষাবাদ করতেন, তাহলে সত্যিকারের লাভ হতো। এখনো তিন মাস বা চার মাসের আবহাওয়া পূর্বাভাস দেয়া হয়। সেখানে খরা হবে বা বৃষ্টি হবে, ইত্যাদি পূর্বাভাস দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু কোন মাসে খরা বেশি হবে, সেটি কতো ডিগ্রি সেলসিয়াস হবে বা বৃষ্টি কতটা হবে, সেটা পরিষ্কারভাবে বলা হয় না। ফলে কৃষক সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে পারে না।
কিন্তু কেন নির্ভুলভাবে আবহাওয়া সম্পর্কে পূর্বাভাস পাওয়া যায় না?
আবহাওয়া অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক শাহ আলম বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশ কেন, বিশ্বের কোনো দেশই নির্ভুলভাবে তিন বা চার মাসের পূর্বাভাস দিতে পারে না। এর অনেক কারণ আছে। প্যারামিটারগুলো চেঞ্জ হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশে সেটা আরো বেশি ঘটে। কোনোভাবেই এটা মীমাংসা করা যায় না। তাই কখনো বৃষ্টি বেশি হয়, কখনো খরা বেশি হয়। তিনি বলেন, পুরোপুরি নির্ভুল না হলেও সারের মজুদসহ বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে এসব তথ্য সহায়তা করে।
কৃষিতে আবহাওয়া তথ্য ব্যবহারে চ্যালেঞ্জ সমাধানের উপায়
কৃষিবিদরা বলছেন, বিশ্বের অনেক দেশ কৃষিকাজে আবহাওয়ার পূর্বাভাস ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন বাড়াতে এবং খরচ কমাতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট নয়টি জেলায় চালানো একটি গবেষণায় দেখতে পেয়েছে, যারা এভাবে পূর্বাভাস ব্যবহার করেছেন, তারা বেশি ফসল উৎপাদন করতে পেরেছেন। ব্রি অ্যাগ্রোমেট ল্যাবের কো-অর্ডিনেটর নিয়াজ মোহাম্মদ ফারহাত রহমান, ‘প্রথমে কৃষকদের আবহাওয়া তথ্য ব্যবহারের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। তাদের অবশ্যই আবহাওয়া বিষয়ে জানতে হবে, সেটার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।’
এজন্য মোবাইলের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষকদের কাছে তথ্য সরবরাহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ করে সরাসরি কৃষকদের কাছে এসব তথ্য সহজলভ্য করে তোলা দরকার। কৃষি সংগঠক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশ ছোট দেশ হলেও এখানে বৈচিত্র্য অনেক বেশি। দক্ষিণাঞ্চলের পূর্বাভাস উত্তরের জেলায় খাটবে না। আবার হাওর এলাকার পূর্বাভাস হয়তো অন্যরকম হবে। আমের সময় যে পূর্বাভাস হবে, সেটা দক্ষিণে ধান চাষের সাথে মিলবে না। পূর্বাভাসের ক্ষেত্রেও এরকম অঞ্চল ভিত্তিক ব্যবস্থা থাকা দরকার।’ সূত্র : বিবিসি




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com