আভিধানিক অর্থে কবিতা হলো কাব্য; পদ্য; শ্লোক; কল্পনামিশ্রিত ছন্দোময় রচনা। ছড়া, পদ এসবও কবিতার অংশ। এক কথায় কবিতা ভাবসমৃদ্ধ সরস রচনা। অবশ্যই তা ছন্দোময় হতে হবে।
তবে গদ্যভাষায়ও কবিতার চল আছে, এটাকে আমরা গদ্য কবিতা বা আধুনিক কবিতা বলে থাকি। অধুনা পাঠক এ ধরনের ছন্দহীন কবিতাকে গ্রহণও করেছেন। ‘অবশ্যই তা ছন্দোময় হতে হবে’ কবিতার ক্ষেত্রে জোর দিয়ে বলা এ কথার পরও গদ্য কবিতাকে কবিতা বলা সমীচীন কি না পরবর্তী অধ্যায়ে সে বিষয়ে আলোচনায় আসব।
এর আগে আমরা, কবি ও কবিতা সম্পর্কে একটা ধারণা অবশ্য পেয়েছি, তারপরও আরো একটু স্পষ্ট হওয়া দরকার। কবিতার আগে কবির কথা বলা উচিত।
সহজ কথায় যিনি কবিতা রচনা করেন তিনি কবি। তবে প্রাচীনকালে কবির সংজ্ঞা ছিল ভিন্ন। তখন যেকোনো বিদ্যায় পারদর্শী ব্যক্তিকে কবি হিসেবে অভিহিত করা হতো। এ বিবেচনায় অভিজ্ঞ চিকিৎসক, শাস্ত্রবিদ, প্রযুক্তিবিদ, কাব্যকার, জ্যোতির্বিদ, বিজ্ঞানী, আঁকিয়ে, সঙ্গীতশিল্পীÑ গড়পরতায় সবাই ছিলেন কবি। সে ধারণা এখন অতীত। এখন কবি মানে, কবিতা রচয়িতা। কবিসত্তার অধিকারী। তার মধ্যে কবিত্বশক্তি কাজ করে। কবিত্ব হচ্ছে কবিতা লেখার শক্তি; কবিতা লেখার অনুকূল ভাব বা কল্পনা; কাব্যময়তা; কাব্যবিলাস; কল্পনার সৌন্দর্য ইত্যাদি। কবিতা লেখা কি খুব সহজ? সহজ না হলে ক্লাস ফোরের একটি ছাত্র ভাব এলো আর কবিতা লিখে ফেলল!…কিভাবে? যেহেতু তার লেখায় ছন্দ-অন্ত্যমিল ঠিক আছে। কথার পাশে কথাও গেথেছে বেশ; তাহলে ওটাকে কবিতা হিসেবে ধরে নিতে বাধা কোথায়? নিশ্চয় কবিত্বশক্তির অধিকারী সে। যারা কবি হয়ে ওঠে তারা হঠাৎ অল্প বয়সে অমন কবিতা লিখে ফেলে। কবিতার কিছু নিয়ম-কানুন আছে অবশ্য, ছন্দ ছাড়াও কিছু উপাদান থাকে কবিতায়। যেগুলো না থাকলে তা পূর্ণাঙ্গ কবিতা হয়ে ওঠে না। সেসব উপাদান সম্পর্কে নবীন কবির ধারণা থাকে না। সে লিখে যায় আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজের মতো করে। তবে বয়স হওয়ার সাথে সাথে সে বুঝতে শেখে কী কী উপাদান থাকলে একটি কবিতা পরিপূর্ণ কবিতা হয়ে ওঠে।
বাংলাভাষার প্রথম কবি ও কবিতা: বাংলা ভাষার প্রথম কবি ও কবিতা সম্পর্কে আমরা এখনো ধোঁয়াশায় আছি। জানি না কোন বাঙালি মানুষটি আপন ভাষায় প্রথম কবিতা রচনা করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, আমরাও কবিতা লিখতে পারি। শুধু বাঙালি কেন, কোনো ভাষাভাষীরাই জানেন না তাদের ভাষার প্রথম কবি ও কবিতা সম্পর্কে। তবে এক বাঙালি প-িত কিছু কবিতার সন্ধান পেয়ে অবহিত হয়েছেন, বাংলাভাষার প্রাচীন কবি কারা এবং সেই কবিতার ধরনই বা কেমন ছিল। সেই প-িতের নাম প-িত মহামহাপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তিনি ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে নেপালে রাজদরবার থেকে আবিষ্কার করলেন কিছু ছন্দোবদ্ধ অনু রচনা। পরে সেগুলো ‘হাজার বছরের পুরনো বৌদ্ধ গান ও দোহা’ নামে প্রকাশ করলেন ১৩২৩ বঙ্গাব্দে। আবিষ্কারের সময়কালে সেগুলোকে হাজার-বারো শ’ বছর আগের রচনা বলে অনুমান করা হয়।
সেসব অনুপদ্যের দু-একটা তুলে ধরলে বোঝা যাবে আমাদের ভাষাটা আগে কেমন ছিল। যেমন
“কাহরে ঘেনি মেলি আছহু কীস।
বেঢ়িল হাক পড়স চৌদীস।
আপনা মাংসে হরিণা বৈরী।
খনহন ছাড়অ ভুসুকু আহেরী।”
ওই ঝাপসা ভাষাকে যদি এখনকার ভাষায় তর্জমা করি, তাহলে অর্থ দাঁড়াবেÑ
“কাকে ছাড়ি কাকে রাখি।
চারদিকে হাঁকাহাঁকি।
মাংসই থাকে না যে হরিণের পক্ষে
শিকারি ভুসুকা তাকে দেয় কি গো রক্ষে।”
ওই অনুপদ্যের রচয়িতার নামও তেমনি, ভুসুকাপাদ। ভুসুকাপাদ, কাহ্নপাদ, ডোমনিপাদ, এমন সব নাম তাদের। পাদ শব্দটি এসেছে যথাসম্ভব পদ থেকে। ছড়ার মতো এই অনুপদ্যগুলোকে পদ বলা হতো। পদের রচয়িতারা পাদ বা পদকার হিসেবে পরিচিত হতেন। আর সব পাদই তখন ছিলেন বৌদ্ধ সহজিয়া গোত্রের। গানের মতো সুর করে এসব পাঠ করা হতো। অতীতের অতল থেকে তুলে আনা এসব কবিকেই আমরা আমাদের আদি কবি হিসেবে ধরে নিতে পারি এবং আমাদের আদি কবিতা হিসেবে এই পদগুলোকে আদর করে বুকের মধ্যে রেখে দিতে পারি।
কবিতার প্রকারভেদ: রচনা বা বিষয় বৈচিত্র্যে কবিতা বা কাব্য নানা ধরনের হয়ে থাকে। যেমন মহাকাব্য, ঐতিহাসিক কাব্য, রাজনৈতিক কাব্য, দূতকাব্য, খ-কাব্য, স্তোত্রকাব্য, শতককাব্য, চম্পুকাব্য, চরিতাকাব্য, পদাবলিকাব্য, পালাকাব্য, গীতিকাব্য, মঙ্গলকাব্য, প্রণয়কাব্য, গদ্যকাব্য ইত্যাদি।
আবার ছন্দের রকমফের ও কাঠামোগত কারণেও কবিতা নানা ধরনের হয়ে থাকে। ছন্দ নিয়ে আলোচনা করলে, সেই রকমফেরটা বোঝা যাবে।